প্রতি বছরই জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দেয় বাংলাদেশ। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে তিনি ২০০ থেকে আড়াইশ লোক নিয়ে অধিবেশনে যোগ দিতেন। তার পতনের পর এবার ৭৯তম অধিবেশনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সফরসঙ্গী মাত্র ৫৭ জন। আজ মঙ্গলবার তিনি নিউইয়র্কে পৌঁছার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে একান্ত বৈঠক করবেন। গত তিন দশকের মধ্যে অধিবেশন চলাকালে বাংলাদেশের কোনো সরকারপ্রধানের সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্টের এটাই প্রথম বৈঠক। বৈঠক ঘিরে বিশ্বের অন্য দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়েছে। গণঅভ্যুত্থানে হাসিনার পতন ও বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার আশ্বাস প্রতিবেশী দেশ ভারতকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। ইউনূস-বাইডেনের বৈঠকও তাদের নতুন করে ভাবাচ্ছে। দুই নেতার বৈঠকে কী হয়, তা জানতে বিশ্বনেতারা অধীর আগ্রহে রয়েছেন বলে বেশ কয়েকটি দেশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে।
কূটনৈতিক বিশ্লেষক ও যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত ড. এম হুমায়ূন কবির কালবেলাকে বলেন, একটা নতুন বাস্তবতার মধ্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবার
জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে গেছেন। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তৈরি হওয়া বাংলাদেশের নতুন সরকারপ্রধান হিসেবে তিনি যান। বাংলাদেশের জন্য এর চেয়ে স্ট্রং (শক্তিশালী) প্রতিনিধি আর হয় না। কারণ ড. ইউনূস নিজে সরকারপ্রধান এবং তিনি একজন বিশ্ববরেণ্য অর্থনীতিবিদ। বিশ্বনেতাদের কাছে তার আলাদা গ্রহণযোগ্যতা আছে। তার মুখ থেকে বিশ্বনেতারা বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে শুনলে দেশের প্রেক্ষাপট, বর্তমান চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যতে এটি কোথায় যাবে—তার একটা ধারণা সবাই পাবে। ড. হুমায়ূন বলেন, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে সাইডলাইনে বিশ্বনেতাদের সঙ্গে কিছু বৈঠক হবে। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে বৈঠকটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নতুন বাস্তবতায় বাইডেনের সঙ্গে বৈঠক হওয়াটা জরুরি ছিল। তাদের কাছ থেকে আমরা যে বিভিন্ন সহযোগিতা পেতে পারি সে সম্ভাবনা ছাড়াও, বর্তমানে আঞ্চলিকভাবে আমরা কিছু প্রতিকূলতার মুখে আছি। সেক্ষেত্রে আমার ধারণা, বাইডেন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের আলোকে এ বিষয়ে আমাদের সহায়তা করতে পারেন। সেটি যদি হয়, তাহলে এটি বাংলাদেশের জন্য খুবই ইতিবাচক হবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মূলত বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান তুলে ধরবেন ড. ইউনূস। সরকারপ্রধানের বাইরেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক রয়েছে। ফলে তার সরকার বর্তমানে যেসব চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে সেসব চ্যালেঞ্জ দূর করতে বাইডেন প্রশাসন তার পাশে থাকবে। তাদের দুজনের বৈঠকে এ বিষয়টি গুরুত্ব পাবে। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া বিশ্বের অন্যান্য প্রভাবশালী রাষ্ট্র নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ইউনূসকে পছন্দ করেন। তার ব্যক্তিগত যে ইমেজ বিশ্বব্যাপী তৈরি হয়েছে, তা তিনি দেশ গঠনে কাজে লাগাবেন।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্কে সু-বাতাস বইছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিতে কাজ শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সম্প্রতি মার্কিন একটি প্রতিনিধিদল ঢাকা ঘুরে যাওয়ার পর পরই দুই দেশের মধ্যে শীর্ষ পর্যায়ে বৈঠক হতে যাচ্ছে। সর্বোচ্চ পর্যায়ের এই বৈঠকে দুই দেশের শীর্ষ নেতা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ভবিষ্যতে কোথায় নিতে চান, সহযোগিতার বিষয় চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারগুলো কী হতে পারে, সে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হতে পারে বলে মনে করছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তারা আরও বলেন, ২৭ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সাধারণ বিতর্ক পর্বে বক্তব্য দেবেন। তার বক্তব্যে জনভিত্তিক, কল্যাণমুখী ও জনস্বার্থে নিবেদিত একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার দৃঢ় প্রত্যয় বিশ্ব দরবারে তুলে ধরবেন এবং বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে বিশ্ববাসীর সহযোগিতা চাইবেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দীর্ঘ ২৫ বছর পর দুই দেশের শীর্ষ পর্যায়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এর আগে ২০০০ সালে ঢাকা সফরে এসেছিলেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। সেই সময় দুই দেশের শীর্ষ পর্যায়ে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়েছিল। সেই সময় ক্লিনটনের ঢাকা সফরের পেছনেও অন্যতম প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছিলেন ড. ইউনূস। মার্কিন প্রেসিডেন্ট সাধারণত স্বল্পসময়ের জন্য জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যোগ দিতে নিউইয়র্কে যান এবং কোনো দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন না। সেখানে ইউনূসের সঙ্গে তার দেখা হওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও সম্মানের। ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও জো বাইডেনের মধ্যকার বৈঠকটি দুই দেশের সম্পর্ক জোরদার এবং বিশ্ব ঢাকার প্রতি ওয়াশিংটনের সমর্থনের বার্তা পাবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা আরও বলছেন, বিশ্ববরেণ্য অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস সারা বিশ্বেই জনপ্রিয় ও পরিচিত এক মুখ। তার ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ তত্ত্ব আজ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। তিনি জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন নামকরা প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। ভাষণ দিয়েছেন সিনেটসহ অনেক রাষ্ট্রের আইনসভায়। তবে এবারের জাতিসংঘ অধিবেশনে সম্পূর্ণ নতুনরূপে হাজির হচ্ছেন বরেণ্য এই অর্থনীতিবিদ।
মুখোমুখি আওয়ামী লীগ-বিএনপি: ড. ইউনূসের সফর উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। আওয়ামী লীগ নেতারা ইউনূসের সরকারকে অবৈধ আখ্যা দিয়ে জাতিসংঘের সামনে কালো পতাকা দেখাবেন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপি ইউনূস ও তার সরকারকে স্বাগত জানিয়ে মিছিল করবে। দল দুটির পক্ষ থেকে কর্মসূচি সফল করতে এরই মধ্যে প্রস্তুতি সভা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, বিমানবন্দরে প্রতিবাদ জানানোর পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকারকে অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়ে দেশে স্বাভাবিক রাজনীতি ফিরিয়ে আনতে স্মারকলিপি দেওয়া হবে। অন্যদিকে অবস্থান নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে খুন-গুম-নির্যাতন আর লুটপাটের বিচার চাইবে বিএনপি।
সফর শেষে প্রধান উপদেষ্টা নিউইয়র্ক থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর রাতে ঢাকার পথে রওনা হবেন।
যুক্তরাষ্ট্র যুবদল নেতা মাসুদ রানা জানান, প্রধান উপদেষ্টাকে অভিনন্দন জানানোর জন্য নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসের কাবাব কিংয়ে প্রস্তুতি সভা করা হয়েছে। গত ২২ সেপ্টেম্বরের ওই সভায় বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কর্মসূচির দিন আওয়ামী লীগ কোনো বাধা দিলে প্রতিহত করা হবে।
অন্যান্য দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে ইউনূসের সাক্ষাৎ: জাতিসংঘের মূল অনুষ্ঠান ছাড়াও ড. ইউনূসের সঙ্গে বিভিন্ন সংস্থার প্রধান সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। এ ছাড়া ড. ইউনূসের সঙ্গে নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি, বাহরাইনের ক্রাউন প্রিন্স হামাদ বিন ইসা আল খালিফা, নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী ডিক শফ, মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহামেদ মুইজ্জু, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ও ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লিয়েনের সৌজন্য সাক্ষাতের কথা রয়েছে। পাশাপাশি জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক, বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গা, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) প্রধান কৌঁসুলি করিম খান, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার পরিচালক সামান্থা পাওয়ার, জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মহাপরিচালক গিলবার্ট এফ হংবোসহ জাতিসংঘের আরও অনেক সংস্থার প্রধান ড. ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন বলে জানা গেছে।