‘তিন দিন ধরে আগুন জ্বলছে এখানে, মানুষ দুই দিন ধইরা পইড়া ছিল, পোড়া মানুষ। আলামত বা মামলার নথি পাবো কইত্থেকে?’ গত ৫ আগস্ট সরকার পতন হলে ঢাকা মহানগর পুলিশের যাত্রাবাড়ী থানায় অগ্নিসংযোগের পর সেখানে সংরক্ষিত নথি ও আলামতের বিষয়ে এ কথা বলছিলেন ওই থানার বর্তমান ওসি ফারুক আহমেদ।
শুধু যাত্রাবাড়ী থানা নয়, গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের দিন উত্তেজিত জনতা সারা দেশে ৫৮টি থানায় অগ্নিসংযোগ করে। জনরোষে ভাঙচুরের পর তছনছ করা হয় ৫৬ থানায়। এসব থানার প্রায় সব নথি ও সংরক্ষিত বিভিন্ন আলামত নষ্ট হয়েছে। থানা ছাড়াও ২৬টি ফাঁড়ি ও দুটি তদন্ত কেন্দ্রে অগ্নিসংযোগ এবং ২৪টি ফাঁড়ি ও ১০টি তদন্তকেন্দ্র ভাঙচুর হয়। এসব স্থাপনায়ও বিভিন্ন মামলার তদন্ত সংক্রান্ত নানা নথি নষ্ট হয়েছে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।
পুলিশ কর্মকর্তা ও আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যেসব মামলার নথি ও আলামত পুড়েছে, সেই মামলাগুলোর ভবিষ্যৎ অনেকটা অনিশ্চিত। কারণ কিছু নথি উদ্ধার করা সম্ভব হলেও নষ্ট হওয়া আলামত আর ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। আদালতে মামলা প্রমাণের ক্ষেত্রে এই আলামত অতি গুরুত্বপূর্ণ। নথি ও আলামত পুড়ে যাওয়ায় মামলাগুলোর তদন্তেও দীর্ঘসূত্রতার সৃষ্টি হতে পারে। পাশাপাশি কোনো কোনো মামলার নতুন করে তদন্তও করতে হতে পারে। তবে বড় ক্ষতিটা হয়েছে আলামত পুড়ে যাওয়ায়।
ভাঙচুর বা অগ্নিসংযোগের শিকার থানার তালিকা করা হলেও এখন পর্যন্ত কত মামলার নথি পুড়েছে, হারিয়েছে বা আলামত নষ্ট হয়েছে—সেই তালিকার কাজ পুরো শেষ করতে পারেনি পুলিশ। ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন থানার ওসিদের সঙ্গে কথা বলে এর কারণ জানার চেষ্টা করা হয়। তারা বলছেন, থানাগুলোয় অগ্নিসংযোগে আসবাব থেকে শুরু করে নথি সংরক্ষণের কম্পিউটার পর্যন্ত পুড়েছে। অনেক থানায় ভাঙচুর করে কম্পিউটার বা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও নিয়ে গেছে কেউ কেউ। তা ছাড়া পুলিশ কর্মকর্তারা ক্ষতিগ্রস্ত থানাগুলোয় নতুন দায়িত্ব নিয়ে এখনো কিছু গুছিয়ে উঠতে পারেননি। অনেক তদন্ত কর্মকর্তার বদলির কারণে পুরোনো মামলাগুলোর সর্বশেষ অবস্থাও তারা জানতে পারছেন না। তবে এসব সংগ্রহের চেষ্টা চলছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) ইনামুল হক সাগর কালবেলাকে বলেন, নথি ও আলামত পুড়ে যাওয়ায় মামলার তদন্তে একটা চ্যালেঞ্জ তো থাকেই। তবে পুলিশপ্রধান এসব সমস্যা আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে দ্রুত সমাধানের নির্দেশ দিয়েছেন এবং সে অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত থানাগুলো কাজ করছে।
এই কর্মকর্তা বলেন, পুলিশের কী কী ক্ষতি হয়েছে, তা এরই মধ্যে নিরূপণ করা সম্ভব হয়েছে। অনেক নথি ও আলামত ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কিছু কিছু নথি একাধিক জায়গায় থাকে। আইজিপি দ্রুততার সঙ্গে এসব নথি উদ্ধার করে সংশ্লিষ্টদের মামলার তদন্ত কার্যক্রম চালাতে নির্দেশনা দিয়েছেন।
পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মামলার এজাহারসহ কিছু নথি ক্রিমিনাল ডেটাবেজ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমে (সিডিএমএস) সংক্ষিত থাকে। আদালতেও মামলার কপি ও সাক্ষ্য, জবানবন্দি সংরক্ষিত থাকে। তবে অনেক মামলার আলামতের বিবরণ, জব্দ তালিকা, বিভিন্ন সাক্ষ্য-প্রমাণের তথ্যসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক ডকুমেন্ট সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তার কাছে থানায় থাকে। কোনো মামলার অভিযোগপত্র দেওয়ার সময়ে বা সাক্ষী হাজিরের সময়ে তা কাজে লাগে। কিন্তু থানাগুলোর কাগজপত্র ও কম্পিউটার পুড়ে যাওয়া বা লুট হওয়ার কারণে এসব গুরুত্বপূর্ণ নথি ও আলামত নষ্ট হয়েছে। এতে যেসব মামলার তদন্ত কার্যক্রম শেষ হয়নি বা কিছুটা তদন্ত হয়েছে, এমন মামলা তদন্ত শেষ করতে বেগ পেতে হবে।
অবশ্য আইনজীবী ওমর ফারুক ফারুকী কালবেলাকে বলেন, থানায় সংরক্ষিত যেসব মামলার নথি নষ্ট হয়েছে, নতুন করে তা সংগ্রহ করতে হবে তদন্ত কর্মকর্তাকে। এগুলো সংগ্রহ করা সম্ভব। এজন্য তদন্তে সময় লাগতে পারে। তা ছাড়া আলামত পুড়ে গেলে তা নতুন করে তো সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে একটু সমস্যা তো থেকেই যাচ্ছে।
এই আইনজীবী বলেন, কী ঘটেছিল, কী পরিস্থিতিতে এমনটা হয়েছে, তা আদালতসহ সবাই অবগত। তাই নথি পুড়ে যাওয়া বা আলামত নষ্ট হওয়া মামলার বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে খুব বেশি সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সূত্র জানায়, ডিএমপির ৫০টি থানার মধ্যে ২১টি থানায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এর মধ্যে যাত্রাবাড়ী, শ্যামপুর, মোহাম্মদপুর, আদাবর, বাড্ডা, ভাটারা, খিলগাঁও, পল্টন, খিলক্ষেত, শেরেবাংলা নগর, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল ও ওয়ারী থানায় অগ্নিসংযোগ করা হয়। এসব থানার মধ্যে যাত্রাবাড়ী থানার মামলার নথি ও আলামতের সঙ্গে কম্পিউটার পুড়ে যাওয়ায় মামলার নথি ও আলামত কোনোটিরই তালিকা তৈরি করা যায়নি এখনো। মোহাম্মদপুর, আদাবর, মিরপুর, বাড্ডা, ওয়ারী ও পল্টন থানায় আগুনে ১ হাজার ২২৬টি মামলার নথিপত্র পুড়ে গেছে। অন্যান্য থানায় কী পরিমাণ নথি ও আলামত পুড়েছে, তা নির্ধারণ করা যায়নি।
জানতে চাইলে যাত্রাবাড়ী থানার ওসি ফারুক আহমেদ বলেন, এখনো তারা থানা ভবনেই কার্যক্রম শুরু করতে পারেননি। ডেমরা থানা থেকে যাত্রাবাড়ী থানার কাজ চলছে। তবে নথি ও আলামত পুড়ে যাওয়ার বিষয়গুলো যাচাই করা হচ্ছে।
মোহাম্মদপুর থানার ওসি ইফতেখার আহমেদ জানান, আগুনে মোহাম্মদপুর থানার ৯০টি মামলার নথি পুড়েছে। তবে কতগুলো মামলার আলামত ছিল, তা তারা বের করতে পারেননি। যেসব নথি পুড়ে গেছে সেগুলো সিডিএমএস থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, যেসব মামলার আলামত পুড়ে গেছে, সেসব মামলার বিষয়ে আদালতকে অবহিত করা হবে।
আদাবর থানার ওসি মাহফুজ ইমতিয়াজ ভূঁইয়া বলেন, এমনভাবে থানা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, আলামত রক্ষা করার কোনো সুযোগই ছিল না। তবে মামলার নথি উদ্ধার করা সম্ভব। নথি উদ্ধার করে তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে প্রতিটি মামলার বিষয়ে তদন্ত শুরু করা হবে।
ঢাকার বাইরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানা। সরকার পতনের আগের দিন ওই থানায় কয়েকশ লোক আক্রমণ করে। গোলাগুলির একপর্যায়ে লোকজন থানার ভেতর ঢুকে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে। এতে ১৩ পুলিশ সদস্য ভেতরে নিহত হন। তাদের কারও মরদেহ ঝুলন্ত অবস্থায় এবং কয়েকজনের পোড়া মরদেহ স্তূপ আকারে পাওয়া যায়। আগুন পুরো থানায় ছড়িয়ে পড়ায় সব ধরনের কাগজপত্র ও আলামত পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
ওই থানায় ১০ সেপ্টেম্বর ওসি হিসেবে যোগ দেন রওশন ইয়াজদার। তিনি কালবেলাকে বলেন, এখনো সেখানে কার্যক্রম শুরু করা যায়নি। পাশে একটি ভাড়া ভবন থেকে থানার কাজ চলছে। সবকিছুই পুড়ে গেছে। সেই তালিকা করে তারা একটি জিডি করে রাখবেন।
ওসি বলেন, পুড়ে যাওয়া আলামত পাওয়া সম্ভব নয়। তবে সার্কেল এএসপি বা এসপি অফিস থেকে তারা পুরোনো মামলার পরিসংখ্যান নিচ্ছেন। এরপর আলামত নষ্ট হয়ে যাওয়ার বিষয়ে আদালতকে অবহিত করা হবে।
ডিএমপির প্রসিকিউশিন বিভাগে দীর্ঘ বছর দায়িত্ব পালন করেছিলেন অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মিরাস উদ্দিন। মামলার নথি ও আলমত পুড়ে গেলে তদন্ত বা বিচারকাজে এর প্রভাবের বিষয়ে জানতে চাইলে অবসরপ্রাপ্ত এই পুলিশ কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, হয়তো আদালতে আবেদন করে নথি উদ্ধার করা সম্ভব। তবে তা সময় লাগবে। তা ছাড়া অনেক তদন্ত কর্মকর্তার কাছে ১০ থেকে ১৫টি করে মামলা তদন্তাধীন থাকে। এসব মামলার ডকেটসহ নানা তথ্য-প্রমাণ ও নথি থাকে তাদের হেফাজতে। এসব পুড়ে গেলে বা হারিয়ে গেলে তদন্ত কাজে দীর্ঘসূত্রতা হওয়া স্বাভাবিক।
আলামতের বিষয়ে তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ধরেন কেউ গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন, এখন সেই মামলায় ভিকটিমের গুলিতে ছিদ্র হওয়া জামা বা কাপড়ের আলামত তদন্ত কর্মকর্তার কাছে সংরক্ষিত ছিল। বিচার চলাকালে সেটি উপস্থাপনের প্রয়োজনে যদি হাজির করা না যায়, তাহলে তো ন্যায়বিচার পেতে শঙ্কা থেকেই যায়। তা ছাড়া মাদকের মামলায় থানায় আলামত হিসেবে গাঁজা বা এ ধরনের মাদক সংরক্ষণ থাকলে তা নষ্ট হলে মামলা প্রমাণ করতেই কষ্টকর হবে। কারণ আদালতে সাক্ষ্যের পাশাপাশি এই আলামত অতি গুরুত্বপূর্ণ।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, ৫ আগস্ট ও এর আগে কয়েকদিনের সহিংসতায় সারা দেশে পুলিশের ২২৪টি স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ করা হয়। এর মধ্যে ৫৮টি থানা, ২৬টি ফাঁড়ি, দুটি তদন্ত কেন্দ্র, ১০৬টি পুলিশ বক্স ও ২৯টি অফিস রয়েছে। এ ছাড়া পুলিশের ২৩৬টি স্থাপনায় ভাঙচুর করা হয়। এর মধ্যে ৫৬টি থানা, ২৪টি ফাঁড়ি, ১০টি তদন্ত কেন্দ্র, ৩০টি পুলিশ বক্স, ২৮টি অফিস, ১৫টি পুলিশ লাইন্স ও ৭৩টি অন্যান্য স্থাপনা রয়েছে।