কোনো প্রয়োজন নেই, ব্যবহারেরও সুযোগ নেই। তবুও তিনটি সাইক্লোট্রন যন্ত্র কিনতে মরিয়া ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার মেডিকেল ফিজিক্স (আইএনএমপি) প্রকল্প। এই যন্ত্রগুলো কেনা, স্থাপন ও আনুষঙ্গিক ব্যয় প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। এসব কেনাকাটার অনিয়মের অভিযোগ ওঠে প্রকল্পের পরিচালক ডা. এম মঞ্জুর আহসানের বিরুদ্ধে। অনিয়মের তদন্তে গঠিত হয় কমিটি, সুপারিশ করা হয় তাকে অপসারণের। কিন্তু তিন বছর পেরিয়ে গেলেও সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি। আর প্রকল্প পরিচালক এখনো বহাল তবিয়তে থেকে আগের মতোই করে যাচ্ছেন স্বেচ্ছাচারিতা।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, ডা. এম মঞ্জুর আহসান দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচার শুরু করেন। তার দুর্নীতি, কেনাকাটায় অনিয়ম, অদক্ষতা, অসদাচরণ ও অসৎ কার্যকলাপের অভিযোগে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন থেকে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্তে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণিতও হয়। এ ক্ষেত্রে কমিটি প্রকল্প পরিচালকের পদ থেকে তাকে অপসারণের সুপারিশ করে।
তদন্ত প্রতিবেদনে কমিটি তিনটি সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে প্রথমটিতে বলা হয়, ‘কর্তব্যে অবহেলা, উন্নাসিকতা, অদক্ষতা, অসৎ উদ্দেশ্যে ভুল তথ্য সরবরাহ করে কর্ম সম্পাদনের প্রচেষ্টা এবং নৈতিক ও পেশাগত অসদাচরণের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রকল্প পরিচালকের পদ থেকে ডা. মোহাম্মদ মঞ্জুর আহসানকে অপসারণের সুপারিশ করা হলো।’ দ্বিতীয়টিতে বলা হয়েছে, ‘পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুল (পিপিআর) ২০০৬-এর ৬৪/১ ধারা অনুযায়ী পিপিআর ২০০৬-এর ১১/১,৩, ৫,৬ ধারা এবং পিপিআর বিধিমালা ২০০৮-এর ১৬/১,৫,৫ (ক) এবং (খ) বিধি লঙ্ঘন করে আহ্বানকৃত দরপত্রে উল্লিখিত যন্ত্রপাতি অতিরিক্ত দামে কেনার প্রচেষ্টা করেছেন বিধায় পিপিআর আইন ২০০৬-এর ৬৪/৩ ধারা অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হলো।’ এ ছাড়া কমিটি প্রকল্পটি পুনর্বিবেচনা ও পুনর্গঠনের সুপারিশ করেছে। ২০২১ সালের ১৯ আগস্ট তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল হলেও সেটি এখনো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়নি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, ডা. এম মঞ্জুর আহসান বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের উচ্চপর্যায়ের আস্থাভাজন হওয়ায় তদন্ত কমিটির সুপারিশ আলোর মুখ দেখেনি। এতে প্রকল্প পরিচালক দিনে দিনে আরও স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠেন।
ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার মেডিসিন অ্যান্ড অ্যালায়েড সায়েন্সেসের প্রাক্তন পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. সানোয়ার হোসেন বলেন, বিএসএমএমইউতে যে সাইক্লোট্রন যন্ত্র আছে, সেটি দিয়ে ঢাকার সব পেট-সিটিস্ক্যান চালানো সম্ভব।
এসব বিষয়ে কথা বলতে ডা. এম মঞ্জুর আহসানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তার ব্যক্তিগত ফোন নম্বরে একাধিকবার কল করলেও তিনি ধরেননি। খুদেবার্তা পাঠানো হলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।
বিষয়টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) মো. নিজামউদ্দিনকে অবহিত করা হলে কালবেলাকে তিনি বলেন, এটি অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) মুহাম্মদ আশরাফ আলী ফারুক দেখেন। পরে মুহাম্মদ আশরাফ আলী ফারুককে ফোন করা হলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
সাইক্লোট্রন যন্ত্র কী: সাইক্লোট্রন যন্ত্র মূলত রেডিও-আইসোটপ উৎপাদনে ব্যবহার হয়। যে আইসোটপ পেট-সিটিস্ক্যানে রোগীর ক্যান্সার নির্ণয়ে ব্যবহার হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে মোট ৯টি পেট-সিটিস্ক্যান যন্ত্র রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠানে চারটি। বাকি তিনটি বেসরকারি পর্যায়ে। এই যন্ত্র দিয়ে প্রতিদিন গড়ে আটজন রোগীর সিটিস্ক্যান করা যায়। এসব পেট-সিটিস্ক্যান যন্ত্রের আনুমানিক মূল্য প্রতিটি ১৬ কোটি টাকা। বর্তমান পরিসংখ্যান থেকে দেখা গেছে, বিএসএমএমইউর সাইক্লোট্রন মেশিনে উৎপাদিত রেডিওআইসোটপ দিয়ে দেশের সব পেট-সিটিস্ক্যান যন্ত্র পরিচালনা করা সম্ভব। যদিও বেসরকারি বিশেষায়িত ইউনাইটেড হাসপাতালের নিজস্ব পেট-সিটিস্ক্যান ও সাইক্লোট্রন যন্ত্র রয়েছে।
এ-সংক্রান্ত অনিয়ম: প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সাল থেকে আইএনএমপি প্রকল্পের পরিচালক ডা. এম মঞ্জুর আহসান। তিনি দেশের তিন জেলায় তিনটি (ঢাকা, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ) সাইক্লোট্রন যন্ত্র কিনতে নানা উদ্যোগ নেন। ইতোমধ্যে আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি কিনতে ৩০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় জনবল না থাকায় সেগুলো অব্যবহৃত অবস্থায় থেকে বিকল হয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ডা. এম মঞ্জুর আহসান ফের সাইক্লোট্রন যন্ত্র কিনতে দুইবার দরপত্র আহ্বান করেন। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে নিজেই আবার ক্রয় প্রক্রিয়া বন্ধ রাখেন। তৃতীয়বার তিনটি সাইক্লোট্রন কিনতে আবারও দরপত্র আহ্বান করা হয়। এবার একটি যন্ত্র কেনায় কার্যাদেশ দিলেও অজ্ঞাত কারণে বাকি দুটি যন্ত্রের দরপত্র বাতিল করে দেন। পরবর্তী সময়ে ওই দুটি যন্ত্র কিনতে দুই দফা দরপত্র আহ্বান করা হলেও সেটি আর আলোর মুখ দেখেনি। শেষ পর্যন্ত ২০২১ সালের নভেম্বরে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয় এবং ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে একটি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। ২০২৪ সাল শেষ হতে চলেছে, এখনো সেই প্রতিষ্ঠানকে এলসি (ঋণপত্র) প্রদান করা হয়নি। বর্তমানে ডলার রেট অনেক বেড়ে গেছে। এখন যন্ত্র দুটি কেনা হলে সরকারের ব্যয় হবে অতিরিক্ত ২৫ থেকে ৩০ কোটি টাকা।
ডা. মঞ্জুর আরও যত অনিয়ম: বিএসএমএমইউতে একই যন্ত্র (সাইক্লোট্রন-১৮এমইভি) স্থাপন করা হয়েছে। এই যন্ত্র প্রতি শিফটে (আনুমানিক ২ ঘণ্টা) কমপক্ষে ৪ হাজার মিলি কিউরি রেডিওআইসোটপ উৎপাদন করতে সক্ষম। সেই হিসেবে প্রতিদিন তিনটি শিফট যন্ত্রটি পরিচালনা করলে দৈনিক উৎপাদন ১২ হাজার মিলি কিউরি আইসোটপ উৎপাদন করা যায়। তবে এ ক্ষেত্রে একটি জটিলতা রয়েছে। উৎপাদিত আইসোটপ প্রতি দুই ঘণ্টায় অর্ধেকে পরিণত হয়। যদিও একজন রোগীর ক্যান্সার নির্ণয়ে মাত্র ১০ মিলি কিউরি আইসোটপ প্রয়োজন হয়। সেই হিসেবে প্রথম শিফটে উৎপাদিত আইসোটপ ঢাকার মধ্যে হস্তান্তরে দুই ঘণ্টা লাগবে। অবশিষ্ট রেডিওআইসোটপ দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ২০০ জন রোগীর পেট-সিটিস্ক্যান করা সম্ভব। দ্বিতীয় শিফটে উৎপাদিত রেডিওআইসোটপ চট্টগ্রাম নিয়ে গেলে (আকাশ পথে চার ঘণ্টা) অবশিষ্ট ১ হাজার মিলি কিউরি দিয়ে প্রতিদিন চট্টগ্রামে কমপক্ষে ১০০ জন রোগীর পেট-সিটিস্ক্যান করা সম্ভব হবে। তৃতীয় শিফটে উৎপাদিত রেডিওআইসোটপ ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ (সড়ক পথে ৬ ঘণ্টা ধরলে) অবশিষ্ট ৭৫০ মিলি কিউরি রেডিওআইসোটপ দিয়ে কমপক্ষে ৭৫ জন রোগীর পেট-সিটিস্ক্যান করা যাবে। ফলে বিএসএমএমইউতে স্থাপনকৃত সাইক্লোট্রন যন্ত্র প্রতিদিন তিন শিফট পরিচালনা করলে প্রতি সপ্তাহে (গড়ে পাঁচ দিন) আনুমানিক ঢাকায় প্রায় ৯০০ জন, চট্টগ্রামে ৪৫০ এবং ময়মনসিংহে ৪০০ জন রোগীর পেট-সিটিস্ক্যান করা সম্ভব।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রকল্প পরিচালক ডা. এম মঞ্জুর আহসান বিগত সরকারের আস্থাভাজন প্রতিষ্ঠান প্লিয়েডস ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডকে নিয়মবহির্ভূতভাবে প্রায় ২৫ কোটি টাকার কার্যাদেশ দেন। তিনি সিমুলেটর এমআরআই মেশিন কেনার ক্ষেত্রে একইভাবে দুইবার দরপত্র আহ্বান করেন এবং কারিগরি নির্দেশনাবলি এমনভাবে প্রস্তুত করেন, যাতে তার মনোনীত প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নিতে না পারে। কেউ অংশ গ্রহণের সুযোগ পেলেও পরবর্তী সময়ে সেই প্রতিষ্ঠানকে কারিগরি দিক দিয়ে নন-রেসপনসিভ করা হয়। এই দরপত্রেও প্রকল্প পরিচালক প্রি-বিড সভার সুযোগ রাখেননি। তিনি ২০২৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর (আইএফটি নং ৩৯.০১.২৬৭২.২৭৮.০৭.০৪২,২৩-১০১৬) ক্যান্সার সেল রিসার্চ ল্যাব স্থাপনের লক্ষ্যে যে দরপত্র আহ্বান করেন, সেখানে তার মনোনীত প্রতিষ্ঠান বড় ধরনের ভুল করায় বাকি দুটি কোম্পানি যোগ্য (রেসপনসিভ) হয়। বাজেটের মধ্যে থাকার পরও ওই দুই কোম্পানির দরপত্র বাতিল করে দেন ডা. মঞ্জু। পরবর্তী সময়ে (আইএফটি নং ৩৯.০১.২৬৭২.২৭৮.০৭.০৫২.২৪-১১৫৯) ফের দরপত্র আহ্বান করে তার মনোনীত কোম্পানিকে কাজ দেন তিনি। অথচ ওই কোম্পানির দরপত্রের জন্য কোনো যোগ্যই ছিল না। এমনকি ওই ধরনের জটিল গবেষণাগার স্থাপনেরও কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না।