ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বলেছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরও প্রতিটি ক্ষেত্রে দখল ও আধিপত্য বিস্তারের সংস্কৃতি এখনো চলমান। রাষ্ট্র সংস্কার ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত অর্জনের লক্ষ্যে অতিদ্রুত সরকারের একটি রোডম্যাপ (রূপরেখা) ঘোষণা করা প্রয়োজন। শুরুতেই এ দাবি উঠলেও এখনো করা হয়নি। তবে তা করার সময় এখনো আছে। সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ করা হলে চলমান নানা প্রশ্ন ও বিতর্ক থাকবে না।
গতকাল সোমবার রাজধানীর ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে ‘নতুন বাংলাদেশ: কর্তৃত্ববাদী সরকার পতন-পরবর্তী ১০০ দিনের ওপর টিআইবির পর্যবেক্ষণ’ প্রসঙ্গে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে গবেষণা তথ্য তুলে এসব কথা বলে টিআইবি। সংবাদ সম্মেলনে গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করে টিআইবির প্রধান গবেষক শাহজাদা এম আকরাম।
টিআইবির গবেষণা পর্যবেক্ষণ অনুসারে, রাষ্ট্র সংস্কার এবং নতুন রাজনৈতিক ও সামাজিক বন্দোবস্তের মাধ্যমে ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার অভূতপূর্ব সুযোগ তৈরি হয়েছে, যেখানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ক্ষমতার বহুমাত্রিক ভিত্তি ও অংশীজনের ভূমিকা রূপান্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। অন্যদিকে চলার পথে বহুমুখী চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকি রয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর অর্পিত দায়িত্ব বাস্তবায়নে যথাসময়ে প্রয়োজনীয় কৌশল ও রোডম্যাপ প্রণয়নের সুযোগ নেওয়া হয়নি, যা এখনো অনুপস্থিত।
গবেষণায় আরও দেখা যায়, আন্দোলনে সংঘটিত সহিংসতার বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হলেও এই প্রক্রিয়া ধীরগতিতে চলছে। সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে অ্যাডহক প্রবণতা, উপদেষ্টা পরিষদ গঠন ও দায়িত্ব বণ্টনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বিতর্কিত হয়েছে।
এতে বলা হয়, কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা বা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া বিতর্কিত হয়েছে। আটটি জাতীয় দিবস পালন না করার সিদ্ধান্ত সমালোচিত হয়েছে। প্রশাসন ও প্রতিষ্ঠানে কোথাও কোথাও পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। কীসের ভিত্তিতে চুক্তিতে নিয়োগ, তা পরিষ্কার নয়। নিয়োগের প্রক্রিয়ায় ক্ষেত্রবিশেষে সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড ও স্বচ্ছতার অনুপস্থিতি দেখা গেছে। রাজনৈতিক পরিচয় যাচাই-বাছাইয়ের ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া বা না-দেওয়ার চর্চা অব্যাহত রয়েছে।
প্রতিবেদনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে বলা হয়, কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতনের পর সারা দেশে ছয় শতাধিক নিহত ও ১০ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাই বেড়েছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘু, আদিবাসী, প্রান্তিক ও ভিন্নমতের জনগোষ্ঠীর আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে ঘটনা যাচাই করা, দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা, তদন্ত করা ও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে কার্যকর উদ্যোগের ঘাটতি দেখা গেছে।
বিএনপির বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, দলটির ভেতর গণতান্ত্রিক চর্চা ও প্রয়োজনীয় সংস্কারমূলক উদ্যোগের অনুপস্থিতি রয়েছে। দলের মধ্যে দখলবাজি, চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তারের সংস্কৃতি বিদ্যমান। আওয়ামী লীগের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় দুর্নীতি, অনিয়ম, অর্থ পাচার, মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন, বাকস্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার বা কোনো অনুশোচনা প্রকাশ করেনি দলটি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রভাব বেড়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সরকারের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার ও বিতর্কিত ভূমিকা রয়েছে। সংস্কার কমিশনগুলো প্রতিনিধিত্বশীল না হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। জনগুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষা খাতের সংস্কারে কোনো কমিশন গঠন করা হয়নি।
এ গবেষণার বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি প্রতিরোধে সহায়ক পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে আমরা বিভিন্ন গবেষণা কার্যক্রম গ্রহণ করে থাকি। ইতিবাচক পরিবর্তনে ভূমিকা পালন করি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে সম্ভাব্য অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির কিছু ক্ষেত্রে (ভারতের পক্ষ থেকে) ভারতের গণমাধ্যম অনুঘটকের ভূমিকা পালনের জন্য এটি বিশাল ঝুঁকি তৈরি করেছে। ভারতীয় গণমাধ্যম বাংলাদেশকে যেভাবে তুলে ধরছে, তা অন্তত ঝুঁকিপূর্ণ এবং অবশ্যই বাংলাদেশের জন্য ‘বিরক্তির কারণ’। এটা আমাদের (বাংলাদেশ) জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে। তবে আমরা এটাও মনে করি যে, এটি ভারতের জন্য অত্যন্ত বিব্রতকর এবং লজ্জাজনক। তাই ভারতকে এ পথ থেকে সরে আসতে হবে।
ইফতেখারুজ্জামান ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভূমিকার প্রশংসা করে বলেন, তারা সবসময় দরজা উন্মুক্ত রাখার পক্ষে। আমরা সবসময় দরজা উন্মুক্ত রাখার কথা বলি। ভারত আমাদের সবচেয়ে বড় প্রতিবেশী। আমরা ভারতের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক বজায় রাখতে চাই। এক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের ক্রান্তিকালে ঝুঁকি রয়েছে উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ভারতের ভূমিকা ইতিবাচক এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে খুবই নেতিবাচক হতে পারে। তিনি বলেন, এই ঝুঁকির কথা মাথায় রাখতে হবে। তিনি বলেন, রাষ্ট্র সংস্কার ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত অর্জনের লক্ষ্যে সরকারের একটি রোডম্যাপ (রূপরেখা) ঘোষণা করা অনিবার্য। তবে সময় পেরিয়ে যায়নি।