

সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে অনলাইনে ভোটার রেজিস্ট্রেশন শুরু হয়েছে। রোববার (৩০ নভেম্বর) রাত থেকে পোস্টাল ভোট বিডি রেজিস্ট্রেশন শুরু হওয়ায় প্রবাসীদের ভোট প্রদানের পথ খুলে গেল। কিন্তু কারিগরি অসুবিধা, সময় স্বল্পতা ও প্রযুক্তি জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে প্রবাসীরা সমস্যার মুখে পড়েছেন।
জনসচেতনা সৃষ্টি করতে না পারলে বহু প্রান্তিক প্রবাসী ভোটাধিকার বঞ্চিত হবেন বলে মনে করছেন আমিরাত প্রবাসী কমিউনিটির নেতারা।
নির্বাচন কমিশনের সিডিউল অনুযায়ী, আগামী ১৪ ডিসেম্বর থেকে আরব আমিরাতে নিবন্ধন শুরু হওয়ার কথা থাকলেও পরে ২৯ নভেম্বর নিবন্ধন উন্মুক্ত হওয়ার ঘোষণা হয়। কিন্তু একদিন পর গত রাত থেকে আরব আমিরাতের প্রবাসীরা নিবন্ধনের সুযোগ পাচ্ছে। শিডিউল পরিবর্তন ও নিবন্ধন অ্যাপের অসুবিধার কারণে ভোট দিতে ইচ্ছুক আবেদনকারীরা বিভ্রান্তিতে পড়ে যায়। আমিরাতের অনেক প্রান্তিক প্রবাসী যারা শহর থেকে বহুদূরে জনবিচ্ছিন্ন এলাকায় কাজ করে, তাদের অনেকে ভোটাধিকার প্রক্রিয়ার বিষয়ে ওয়াকিবহাল নন।
বিশেষ করে প্রচার-প্রচারণা না করলে বহু প্রবাসী এই নাগরিক সুবিধা নিতে পারবেন না বলে ধারণা সাধারণ প্রবাসীদের। আবার অনেক প্রবাসী যারা স্মার্টফোন ব্যবহার করেন না, এমনকি ইন্টারনেট সেবার বাইরে যারা থাকেন তাদের বিষয়ে নির্দেশনা কী সে বিষয়ে অন্ধকারে আছেন প্রবাসীরা।
আল আইন শহরে বসবাসরত কমিউনিটি নেতা ইমদাদ হোসেন জানান, দীর্ঘদিনের দাবি ছিল অনলাইনে এ ভোটার রেজিস্ট্রেশন। তবে নিবন্ধনের সবচেয়ে বড় অসুবিধা হচ্ছে, ঠিকানা নির্বাচন। অ্যাপ্লিকেশনে যে ফরমেটে ঠিকানা চাওয়া হচ্ছে, আমিরাত প্রবাসীদের ঠিকানার প্যাটার্ন একই রকম নয়।
ফাস্ট আবুধাবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপক জাফর উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, পোস্টাল ভোটার বিডি অ্যাপ্লিকেশনটি ডিজাইন করা হয়েছে ইউরোপ বা আমেরিকার আদলে যেখানে প্রত্যেকের পোস্টবক্স নং রয়েছে, কিন্তু আরব আমিরাতে তেমনটি নেই। এখানে ডকুমেন্ট আদান-প্রদান অনলাইন ভিত্তিক। ফলে নিবন্ধনে সাধারণ মানুষ সমস্যায় পড়ছেন। সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন সঠিক ঠিকানা না পাওয়ার অভিযোগে নিবন্ধন কার্যক্রম সাময়িক বন্ধ রাখে।
সাধারণ প্রবাসীদের মাঝে এই বিষয়ে সচেতনতার অভাব রয়েছে। বাংলাদেশ দূতাবাস, কনসুলেট, রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন জনসচেতনতার কাজ করতে পারে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সিলর (শ্রম) মোহাম্মদ উল্লাহ খাঁন কালবেলাকে জানান, দূতাবাস এ বিষয়ে কাজ করছে এবং আগামী ৮ অথবা ৯ ডিসেম্বর দুবাই কনসুলেটে সভা হবে। সুপারিশের আলোকে আরও কীভাবে প্রবাসীদের সম্পৃক্ত করা যায় সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় দশ শতাংশ বাংলাদেশি যার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আমিরাত প্রবাসী, যারা প্রবাসে থেকে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখে। ভোটাধিকারের মতো মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার থেকে সব সময় তারা বঞ্চিত ছিল। দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আরব আমিরাতের প্রায় ১১ লাখ প্রবাসী অবশেষে ভোটাধিকার পাওয়ার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে।
প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিয়ে দেশের হাইকোর্টে মামলা হয়েছিল নব্বই দশকে। শুনানির পর হাইকোর্টের একজন বিচারপতি প্রবাসীদের ভোটাধিকারের পক্ষে রায় দিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর থেকে দেড় কোটি প্রবাসী বাংলাদেশিরা যেন ভোট দিতে পারেন, এটা তাদের দীর্ঘদিনের দাবি। কিন্তু অতীতের কোনো সরকারই এই দাবির প্রতি আন্তরিকতা দেখায়নি। অথচ বাংলাদেশের নাগরিক, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতির স্বীকৃত ‘লাইফ লাইন’।
বৈষম্য ও ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে প্রবাসী বাংলাদেশিরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। বিভিন্ন দেশে প্রবাসীরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে দূতাবাস ও হাইকমিশন ঘেরাও করেছেন, সভা-সমাবেশ করেছেন। মধ্যপ্রাচ্যে বিক্ষোভ করতে গিয়ে শত শত প্রবাসী জেল খেটেছে, অবশেষে ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি ছেড়ে একেবারে নিঃস্ব হয়ে দেশে ফিরতে হয়েছে। অথচ সেই প্রবাসীদের মত প্রকাশের অধিকার ভোট থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে সব সময়। প্রবাসীরা মনে করে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে কাজ না করলে এ মৌলিক দাবি আর কখনো আলোর মুখ দেখত না।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ডক্টর মোহাম্মদ ইউনুসের আরব আমিরাত সফরকালে কমিউনিটি নেতাদের সঙ্গে একটি মতবিনিময় অনুষ্ঠিত হয়। কমিউনিটি নেতারা প্রবাসীদের ভোটাধিকারের ব্যাপারে প্রশ্ন করলে তখন তিনি জানান, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে।
সেই প্রতিশ্রুতির প্রেক্ষিতে প্রবাসীদের ভোটাধিকারের স্বপ্ন আজ বাস্তবের পথে।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো ভোট দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। সেখানে নিবন্ধন চূড়ান্ত করলেই ব্যালট পেপার চলে যাবে ভোটারদের কাছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে ব্যালট পৌঁছানোর পর, ভোট প্রদান শেষে সেটি রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছ পর্যন্ত পৌঁছাতে সর্বনিম্ন ১৫ দিন থেকে সর্বোচ্চ ৩০ দিন পর্যন্ত সময় লাগতে পারে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন বা ইসি।
এ কারণে বিদেশে যে ব্যালট পাঠানো হবে সেখানে থাকবে নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দল ও জাতীয় নির্বাচনের জন্য ইসির নির্ধারিত প্রতীক।
একই সাথে ‘না’ ভোট যুক্ত থাকবে ওই ব্যালটে। যদি কোনো আসনে একজন মাত্র প্রার্থী থাকেন, শুধু সেসব আসনের ভোটাররাই এই না ভোট দিতে পারবেন।
ইসির অতিরিক্ত সচিব কেএম আলী নেওয়াজ জানিয়েছেন, শুধু ইসির অ্যাপে নিবন্ধিত প্রবাসী ভোটারদের ঠিকানায় ব্যালট পাঠানো হবে। প্রার্থীর প্রতীক চূড়ান্ত হওয়ার পরই অ্যাপ থেকে ভোটার তার আসনের প্রার্থী দেখে ভোট দিয়ে ব্যালট ফেরত পাঠাবেন বাংলাদেশে।
প্রবাসীদের কাছে ব্যালট পাঠানো থেকে শুরু ভোট প্রদান শেষে সেগুলো রিটার্নিং অফিসে পাঠানো পর্যন্ত পুরো দায়িত্ব থাকবে বাংলাদেশ ডাক বিভাগের হাতে। নির্বাচন কমিশন বলছে, এক্ষেত্রে ভোটার প্রতি খরচ পড়বে মাত্র ৭০০ টাকা করে।
বিদেশে বসে ভোট দিতে অ্যাপে নিবন্ধনের জন্য প্রত্যেক ভোটারেরই লাগবে একটি করে আন্তর্জাতিক সিমকার্ড।
একইসঙ্গে অ্যাপে জিও লোকেশন চালু থাকার কারণে বাংলাদেশে বসে কোনোভাবেই অ্যাপটি ব্যবহার করা যাবে না বলে জানিয়েছে ইসির প্রবাসী ভোটার প্রকল্পের টিম লিডার অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সালীম আহমদ খান।
আসন্ন সংসদ নির্বাচনে প্রবাসী বাংলাদেশি এবং নির্বাচনী দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে পোস্টাল ব্যালটের ব্যবস্থা রাখছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এই প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে হলে ভোটারদের নিবন্ধন করতে হবে ‘পোস্টাল ভোট বিডি’ অ্যাপের মাধ্যমে।
গত ১৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিন অ্যাপটি উদ্বোধন করেন।
নিবন্ধন প্রক্রিয়া আগামীকাল বুধবার (১৯ নভেম্বর) থেকে শুরু হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে নির্দিষ্ট সময়সীমা মেনে ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে।
আউট অব কান্ট্রি ভোটিং সিস্টেম অ্যান্ড ইমপ্লিমেন্টেশন (ওসিভি-এসডিআই) প্রকল্পের টিম লিডার অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সালীম আহমদ খান জানান, ১৯ থেকে ২৩ নভেম্বর পর্যন্ত পূর্ব এশিয়া, উত্তর আমেরিকা ও আফ্রিকা অঞ্চলের ৫০ দেশের প্রবাসী বাংলাদেশিরা নিবন্ধনের সুযোগ পাবেন।
এরপর ২৪ থেকে ২৮ নভেম্বরের মধ্যে উত্তর আমেরিকার ১৪টি দেশ ও ওশেনিয়া অঞ্চলের দুটি দেশে এবং ২৯ থেকে ৩ ডিসেম্বরের মধ্যে ইউরোপের ৪২টি দেশে নিবন্ধনের সুযোগ রাখা হয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরবের প্রবাসীদের জন্য ৪ থেকে ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১১টি দেশের প্রবাসী বাংলাদেশি ভোটাররা ৯ থেকে ১৩ ডিসেম্বরের মধ্যে নিবন্ধন করতে পারবেন।
মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব বাদে বাকি ১৪টি দেশের প্রবাসীরা ১৪ থেকে ১৮ ডিসেম্বরের মধ্যে নিবন্ধন করতে পারবেন।
প্রকল্পের টিম লিডার আরও জানান, বাংলাদেশের ভেতরে যারা পোস্টাল ভোটিংয়ে অংশ নেবেন— যেমন ভোটের কাজে নিয়োজিত ব্যক্তি, নিজ এলাকার বাইরে কর্মরত সরকারি চাকরিজীবী ও আইনী হেফাজতে থাকা ভোটার— তাদের ১৯ থেকে ২৩ ডিসেম্বরের মধ্যে নিবন্ধন সম্পন্ন করতে হবে। এই সময়ের মধ্যে প্রবাসে কেউ বাকি থাকলে তাদেরও সুযোগ দেওয়া হতে পারে।
নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে এবং নির্বাচনটি ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত হওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
অঞ্চলভিত্তিক নিবন্ধিত ভোটারদের কাছে প্রবাসে ব্যালট পেপার পাঠানোর পর তা যেন ১৬ থেকে ২৮ দিনের মধ্যে রিটার্নিং অফিসারের কাছে পৌঁছায়, সেই পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে ইসি।
যেভাবে নিবন্ধন করবেন
ইসির নির্দেশনা অনুযায়ী, নিবন্ধনের জন্য প্রবাসীদের গুগল প্লে স্টোর বা আইফোনের অ্যাপ স্টোর থেকে ‘Postal Vote BD’ অ্যাপ ডাউনলোড করতে হবে। এরপর লগইন করে অ্যাকাউন্ট তৈরির সময় মোবাইল নম্বর দিতে হবে। মোবাইল নম্বরে আসা ওটিপি (ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড) দিয়ে নম্বর নিশ্চিত করতে হবে। এরপর জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) হাতে নিয়ে সেলফি তোলা এবং আলাদাভাবে এনআইডির ছবি জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক। পাসপোর্ট থাকলে তার ছবিও দিতে হবে। সবশেষে বিদেশে বর্তমান ঠিকানার তথ্য দিলে নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। সিস্টেম থেকে তথ্য যাচাই শেষে অ্যাপে ‘আপনি এখন নিবন্ধিত’ বার্তা দেখা যাবে। এরপর অপেক্ষা থাকবে কেবল ব্যালট পেপারের জন্য।
ইসির নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, নিবন্ধন শেষে তথ্য সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে যাবে। তাদের মাধ্যমে পৃথক ভোটার তালিকা প্রস্তুত করা হবে। এরপর নির্ধারিত সময়ে ভোটারের ঠিকানায় তিন খামের ভেতর ব্যালট পাঠানো হবে। একটি খামের ভেতরে থাকবে ব্যালট পেপার, আরেকটিতে আসন নম্বর ও রিটার্নিং কর্মকর্তার ঠিকানা উল্লেখ থাকবে। ভোটার ব্যালট পেপারে ভোট দিয়ে দ্বিতীয় খামে ভরে নিকটস্থ পোস্ট বক্সে জমা দিলেই ভোটের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।
আরেক ধাপে বলা হয়েছে, খাম পাওয়ার পর ভোটারকে অ্যাপে লগইন করে মোবাইল নম্বর নিশ্চিত করতে হবে, নিজের ছবি তুলতে হবে এবং খামের ওপর থাকা কিউআর কোড স্ক্যান করতে হবে। এতে প্রার্থিতা চূড়ান্ত হওয়ার পর আসনের সব প্রার্থীর নাম দেখা যাবে। পরে খাম খুলে ব্যালটে ভোট দিয়ে একটি ঘোষণাপত্রে সই করতে হবে। ব্যালট খামে ভরে তা নিকটস্থ পোস্ট অফিসে জমা দিলেই ভোট সম্পন্ন হবে।
বাংলাদেশ দূতাবাস দুবাই কনসুলেট সূত্রে জানা যায়, ১ জুলাই ২০২৩ থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত প্রায় ২২ হাজার প্রবাসীকে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে তাদের হাতে জাতীয় পরিচয়পত্র তুলে দেওয়া হয়েছে।
মন্তব্য করুন