বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় দেশব্যাপী ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত করছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এরই মধ্যে কমিটির প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে, ইন্টারনেট বন্ধের পেছনে ছিল মৌখিক নির্দেশনা। কারিগরি ত্রুটি বা ডাটা সেন্টারে অগ্নিসংযোগের কোনো সম্পর্ক ছিল না। মূলত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মৌখিক নির্দেশনার মাধ্যমে বন্ধ রাখা হয় ইন্টারনেট। আর ইন্টারনেট বন্ধের মূল ভূমিকায় ছিল বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে অধিকতর তদন্ত করছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এজন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিঠি দিয়ে ইন্টারনেট বন্ধের কারণ এবং এর পেছনে কারা জড়িত, সে বিষয়ে জানতে চেয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।
ট্রাইব্যুনাল সূত্রে জানা গেছে, ইন্টারনেট বন্ধের কারণ জানতে বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানি (বিএসসিপিএলসি), বিটিআরসি, বিটিসিএল, সামিটসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। গত ৯ ডিসেম্বর ইস্যু করা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিঠিতে ইন্টারনেট শাটডাউনের কারণ এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ইন্টারনেট বন্ধের পেছনের কারণগুলোর একটি বিশদ ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে চিঠির জবাব দিতে এক সপ্তাহ সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। চিঠির পাশাপাশি অপারেটরদের কাছে সশরীরে গিয়েও বিভিন্ন তথ্য জানতে চেয়েছে তদন্ত কমিটি।
চিঠিতে বলা হয়েছে, ট্রাইব্যুনালের নজরে এসেছে, চলতি বছরের পহেলা জুলাই থেকে ৫ আগস্টের মধ্যে ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়েছিল। অভিযোগ রয়েছে, বেআইনি কার্যকলাপগুলোকে সহজ বা গোপন করার জন্য এটা করা হয়েছিল। তাই চিঠিতে ইন্টারনেট বন্ধ ইস্যুতে বেশ কয়েকটি বিষয়ে ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া হয়েছে। এর মধ্যে মোটাদাগে রয়েছে ইন্টারনেট শাটডাউনের কারণ, শাটডাউনের জন্য কোনো নির্দেশ বা আদেশ দেওয়া হয়েছিল কি না, শাটডাউন চলাকালীন নেটওয়ার্ক কার্যকলাপের সম্পূর্ণ তথ্য এবং শাটডাউনের সময় আইএসপি এবং সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আদান-প্রদান করা যে কোনো যোগাযোগ বা নির্দেশনার তথ্য।
একই সঙ্গে চিঠিতে বলা হয়েছে, যেহেতু সামিট দেশের ইন্টারনেট পরিকাঠামোতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তাই তাদের ভূমিকা জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইন্টারনেট বন্ধের সময় দেশের ইন্টারনেট অবকাঠামো খাতের গুরুত্বপূর্ণ সামিট কমিউনিকেশন্স লিমিটেডের ভূমিকা কী, সেটা জানতে চাওয়া হয়েছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ব্যান্ডউইথ সরবরাহকারীদের বিশদ বিবরণ এবং শাটডাউনের জন্য তাদের সম্পৃক্ততা বা প্রভাব জানতে চাওয়া হয়েছে।
এতে আরও বলা হয়, তথ্য চাওয়ার অনুরোধটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার এবং কর্তৃত্বের অধীনে করা হয়েছে, যা মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্তের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক তথ্য দিতে ব্যর্থ হলে বা কোনো অযৌক্তিক বিলম্ব হলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে চিঠিতে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ট্রাইব্যুনালের চিঠি পেয়ে লিখিত জবাব দিয়েছে। অনেকে আবার মৌখিকভাবে ইন্টারনেট বন্ধের কারণ জানিয়েছে। সেসব জবাব এবং নিজেদের অনুসন্ধানে ট্রাইব্যুনাল জানতে পেরেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়েছিল মৌখিক নির্দেশনার মাধ্যমে।
ইন্টারনেট অপারেটরদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী পলকের মৌখিক নির্দেশে অপারেটরদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করার নির্দেশনা দেয় বিটিআরসি। এ কাজটি করেছিল বিটিআরসির তৎকালীন কর্মকর্তারা। প্রতিমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী তারা ইন্টারনেট সরবরাহকারী বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে মৌখিকভাবে শাটডাউনের নির্দেশনা দেন। বিষয়টি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কাছে স্বীকারও করেছে প্রতিষ্ঠানগুলো। তাদের অভিযোগ, বিটিআরসি থেকে নির্দেশনা পেয়ে তারা ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবলস কোম্পানি লিমিটেডের (বিএসসিপিএলসি) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মির্জা কামাল আহম্মদ কালবেলাকে বলেন, বিটিআরসি থেকে ইন্টারনেট বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল, সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী নিজেও বন্ধ করার জন্য ফোন দিয়েছিলেন। ইন্টারনেট বন্ধের নির্দেশনাটি মূলত কো-অর্ডিনেট করেছিল বিটিআরসি।
ইন্টারনেট বন্ধের মূল ভূমিকায় ছিল বিটিআরসি—এমন অভিযোগের বিষয়ে মন্তব্য জানতে বিটিআরসির চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এমদাদ উল বারীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু বারবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভি করেননি। পরে বিটিআরসির প্রশাসন বিভাগের মহাপরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, উপরের নির্দেশে বিটিআরসি কাজ করেছে। সরকার বা মন্ত্রণালয় বললে তো বিটিআরসির সেই নির্দেশনা না মানার সুযোগ নেই, কারণ বিটিআরসি তো স্বাধীন নয়।
তদন্তের বিষয়ে জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ও ডিজিটাল ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা কালবেলাকে বলেন, তদন্তের স্বার্থে আন্দোলনের সময় ইন্টারনেট বন্ধের কারণ জানাতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। মৌখিক নির্দেশে বন্ধ করাটাও অন্যায় হয়েছে জানিয়ে জোহা বলেন, সরকারের কোনো লিখিত নির্দেশনা ছাড়াই বিটিআরসির কথায় অপারেটররা ইন্টারনেট বন্ধ করে দিতে পারেন না, এটা কোনো সিস্টেম না। বিটিআরসির নির্দেশনা শুনে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া তাদের লাইসেন্স থাকবে কি না, সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। এ ছাড়া এই কাজের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হবে। সব রিপোর্ট পাওয়ার পর উপদেষ্টার কাছে একটি তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হবে। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে যাতে কোনো সরকার এমন মৌখিক নির্দেশনা দিয়ে ইন্টারনেট বন্ধ করতে না পারে, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হবে বলেও জানান তিনি।