বীর সাহাবী
প্রকাশ : ০৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০৩:৪৩ এএম
আপডেট : ২৩ মে ২০২৫, ১১:৩০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

কোনো উদ্যোগই আর কাজে আসছে না পুঁজিবাজারে

নীতি সুদহার বৃদ্ধিকে দায়ী করছেন বিশ্লেষকরা
কোনো উদ্যোগই আর কাজে আসছে না পুঁজিবাজারে

দেশের পুঁজিবাজারে কোনোভাবেই আস্থা ফিরছে না। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। তবে সেসব উদ্যোগের কোনোটিতেই বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরছে না। দিন দিন এ আস্থা আরও তলানিতে ঠেকছে। এতে যেমন বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, অন্যদিকে ব্রোকারেজ হাউসগুলোও লেনদেন খরার ফলে বিপাকে পড়েছে। ফলে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট সব গোষ্ঠীর মনেই এখন এক চাপা আতঙ্ক বিরাজ করছে। কবে ফিরবে পুঁজিবাজারে সুদিন, সেই অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন তারা।

পুঁজিবাজারে লেনদেন খরা ও বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতায় বাজার মূলধনও কমছে সমানতালে। গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে সব খাতে সংস্কারের মতো বিএসইসিতেও সংস্কার করে। বিএসইসির চেয়ারম্যান ও কমিশনাররা পদত্যাগ করলে দায়িত্বে আসেন নতুন কমিশন। গত ১৮ আগস্ট বিএসইসির নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন খন্দকার রাশেদ মাকসুদ। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে গতকাল বুধবার পর্যন্ত সাড়ে চার মাসে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) বাজার মূলধন কমেছে ৪২ হাজার ৩০৪ কোটি টাকার বেশি। আর দৈনিক লেনদেনের পরিমাণ নেমেছে তলানিতে। সপ্তাহের বেশিরভাগ দিনই কাটছে লেনদেন খরা ও বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ারদর কমার মধ্য দিয়ে। ফলে দিন দিন সাধারণ বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে ব্রোকারেজ হাউসগুলোও লোকসান গুনছে।

শাহীন চৌধুরী নামে একজন বিনিয়োগকারী কালবেলাকে বলেন, আমরা বিনিয়োগকারীরা ভেবেছিলাম নতুন সরকার এলে সবকিছুর পাশাপাশি পুঁজিবাজারও ঠিক হয়ে যাবে। পুঁজিবাজারে আমাদের যে লোকসান হয়েছে, তা আমরা কাটিয়ে উঠতে পারব। কিন্তু নতুন সরকার ও নতুন কমিশন আসার পর থেকে পুঁজিবাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা আরও তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। বিনিয়োগকারীরা এই কমিশনের ওপর কোনো আস্থাই আনতে পারছেন না। এ ছাড়া কয়েকদিন পর পর যে বড় অঙ্কের জরিমানা করা হচ্ছে, এতে সবাই আতঙ্কে রয়েছে। তাই বড় বিনিয়োগকারী যারা তারা এখন সাইডলাইনে বসে আছেন। কমিশন অনিয়মের জন্য জরিমানা করবে; কিন্তু বিনিয়োগকারীদের মেরে ফেলে নয়।

জানা যায়, নতুন কমিশন দায়িত্বে এসে পুঁজিবাজারের উন্নয়নে একগুচ্ছ নীতি পদক্ষেপের উদ্যোগ নেন। এসবের মধ্যে রয়েছে—বাজারে তারল্য সরবরাহ বাড়াতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ; রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) বিনিয়োগ সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য তহবিল জোগানে সহায়তা; জরিমানার মাধ্যমে বিএসইসির আদায় করা অর্থ বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষায় কাজে লাগাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ; সরকারি-বেসরকারি ভালো ও লাভজনক কোম্পানিগুলোকে দ্রুত বাজারে আনতে আইপিও আইন সংস্কার ও কর প্রণোদনার ব্যবস্থা করা; শেয়ারবাজারে লেনদেন নিষ্পত্তির সময় কমিয়ে এক দিনে নামিয়ে আনা; ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যে পরিমাণ অনাদায়ি পুঞ্জীভূত ঋণাত্মক ঋণ (নেগেটিভ ইক্যুইটি) রয়েছে, চূড়ান্তভাবে সেগুলোর নিষ্পত্তি করা; উচ্চ সম্পদশালী ব্যক্তিদের বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে মূলধনি মুনাফার করহার কমানো; শেয়ার পুনঃক্রয়ব্যবস্থা চালুর বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ; বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে ভবিষ্যতে আর কখনো ফ্লোর প্রাইস আরোপ না করা এবং সুশাসন ও আইনের যথাযথ পরিপালন নিশ্চিত করা।

এসব উদ্যোগের পরও বাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানোই এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত সাড়ে চার মাসের বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ১৮ আগস্টে ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল ৭ লাখ ১০ হাজার ৭৮ কোটি টাকা। এরপর সাড়ে চার মাসে বাজার মূলধন কমে গতকাল দাঁড়ায় ৬ লাখ ৫৮ হাজার ৭৭৪ কোটি টাকা। এ হিসাবে চার মাসের ব্যবধানে ডিএসইর বাজার মূলধন কমেছে ৪২ হাজার ৩০৪ কোটি টাকা। নতুন কমিশনের আমলে এক দিনের সর্বোচ্চ লেনদেন হয়েছে গত ২ সেপ্টেম্বর ১ হাজার ৬৫ কোটি টাকা। এরপর লেনদেন আর হাজার কোটির ঘর স্পর্শ করতে পারেনি। নতুন কমিশনের সময়ে ডিএসইতে সর্বনিম্ন লেনদেন হয়েছে গত ২৪ ডিসেম্বর ২৭৭ কোটি টাকা।

ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) প্রেসিডেন্ট সাইফুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, পুঁজিবাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের কোনো আস্থা নেই। আস্থা না থাকার অনেক কারণ রয়েছে। সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে কার্যকরী ও দৃশ্যমান কোনো উন্নতি পুঁজিবাজারে দেখা যায়নি। পুঁজিবাজারে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে যেসব উদ্যোগ নেওয়া দরকার, তা নেওয়া হচ্ছে না। গত ১৫ বছরে পুঁজিবাজারে যেসব অরাজকতা হয়েছে সেসবের বিরুদ্ধে কার্যকর উদ্যোগ এখনো নেওয়া হয়নি।

পুঁজিবাজার টাস্কফোর্সের সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল আমিন কালবেলাকে বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাজ তো আর বাজার ওপরে ওঠানো না। নিয়ন্ত্রক সংস্থা পুঁজিবাজারে সুশাসন নিশ্চিতে কাজ করবে। ভালো কোম্পানি বাজারে আনার চেষ্টা করবে। কিন্তু অনেকেই মনে করেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাজ বাজারকে ওপরে ওঠানো। বিগত সময়ে পুঁজিবাজার যেভাবে চলেছে, সেখানে সুশাসনের অভাব ছিল। সুশাসন নিশ্চিত করার দায়িত্ব যাদের ওপর ন্যস্ত ছিল তারা তা সঠিকভাবে পালন করেনি। যেসব অডিট ফার্ম, সিএ ফার্ম কোম্পানিগুলো অডিটের দায়িত্বে ছিল তারা সেভাবে অডিট করেনি বলেই অনেক দুর্বল কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে পেরেছে।

তিনি বলেন, আগে বিনিয়োগকারীরা বলতেন কমিশন কেন কারসাজিকারকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় না, এটি তাদের অভিযোগ। কিন্তু যখনই নতুন কমিশন এসে আগের কারসাজিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করল, তখনই একটি পক্ষ কমিশনের বিরুদ্ধে বলা শুরু করেছে । কমিশন তো শুধু আগের অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে, যদি কমিশন নতুন কোনো পদক্ষেপ নিজ থেকে নিত, তখন দোষ দেওয়া যেত। কমিশন এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করছে যেখানে সব শ্রেণির বিনিয়োগকারীদের সমান সুযোগ থাকবেন। এখন শুধু শুধুই একটি গোষ্ঠী কমিশনকে দোষারোপ করছেন আর পুঁজিবাজারের ওপর থেকে আস্থা হারাচ্ছেন।

আইসিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদ কালবেলাকে বলেন, পুঁজিবাজারে বর্তমানে বিনিয়োগকারীদের আস্থা না থাকার মূল কারণ হচ্ছে সুদের হার বৃদ্ধি। বিনিয়োগকারীরা যখন দেখছে পুঁজিবাজারে রিস্ক এবং মুনাফার হার কম, তখন তারা নিশ্চিতভাবেই ট্রেজারি বিল ও বন্ডের দিকে তাদের বিনিয়োগ নিয়ে যাচ্ছেন। ফলে পুঁজিবাজার থেকে যে বিনিয়োগটা চলে যাচ্ছে তা আর যুক্ত হচ্ছে না।

জুয়াড়িদের সুযোগ না দেওয়ায় পুঁজিবাজারের এমন অবস্থা এটির বিপক্ষে মত দিয়ে আবু আহমেদ বলেন, বিশ্বের বড় বড় সব দেশের পুঁজিবাজারেই জুয়াড়ি থাকেন। আমেরিকা, ভারত সব দেশেই আছে। তবে এই সংখ্যাটা খুবই সামান্য। কিন্তু বাংলাদেশে দেখা যায়, বন্ধ কোম্পানি নিয়ে অনেক জুয়াড়ি তাদের মতো খেলছে। এতে বিপদে পড়েন সাধারণ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা। বাংলাদেশেও সব সময় জুয়াড়ি ছিল। তবে সংখ্যাটা ৭০ ভাগের কাছাকাছি চলে গেলে এটি আর পুঁজিবাজার থাকে না, জুয়াড়িদের বাজার হয়ে যায়। তাই এ সংখ্যাটা সর্বোচ্চ ১০ ভাগ থাকতে পারে।

বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম কালবেলাকে বলেন, মাত্রই নতুন বছর শুরু হয়েছে। অনেক বিনিয়োগকারী এখন সাইডলাইনে বসে আছেন। কিছুদিন গেলেই সবাই সক্রিয় হবেন। যারা সক্রিয়, শক্তিশালী বিনিয়োগকারী ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী তারা মূল্যস্ফীতি ও সুদের হার কমার অপেক্ষায় আছেন। তখন বিদেশি বিনিয়োগও যোগ হবে বাজারে। এ ছাড়া সামনে বাজেট রয়েছে, সেখানে পুঁজিবাজার নিয়ে কোনো ধরনের নীতি সহায়তা থাকবে কি না—এ বিষয়টিও অনেকে পর্যবেক্ষণ করছেন। কমিশনের দিক থেকে বিনিয়োগকারীদের যে আস্থার ঘাটতি রয়েছে তা পূরণে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ভালো ও সরকারি কোম্পানিগুলো কীভাবে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করা যায় সে বিষয়ে দেখা হচ্ছে। ২০০ কোটি টাকার যে বিশেষ তহবিল রয়েছে এটার মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। এটার মেয়াদ বাড়াতেও কমিশন উদ্যোগ নিয়েছে। অংশীজনদের যে পরামর্শ ছিল সেগুলোও নিয়ে কাজ করা হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে শুরু করে অংশীজন সবার পারফরম্যান্সই নির্ভর করে মার্কেট কতটা ভালো ও কতটা রিটার্ন দিয়েছে, তার ওপর। মার্কেট ভালো রিটার্ন দিলে কমিশনের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা এমনিতেই চলে আসবে। আমরা আশা করি, দ্রুতই পুঁজিবাজার আবার ভালো অবস্থানে ফিরে যাবে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

এইচএসসি পাসেই এনজিওতে চাকরির সুযোগ

সালমানকে নিয়ে অভিমান প্রকাশ করলেন ঐশ্বরিয়া

ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির প্রথম ভর্তি পরীক্ষা আজ

এশিয়া কাপে কোন বোলারকে মিস করবে ভারত, জানালেন হরভজন

গণমাধ্যমের নামে ভুয়া ফেসবুক পেজে বিভ্রান্তি

ধূমপান না করেও ফুসফুসের ক্যানসার হতে পারে, যে লক্ষণ দেখে বুঝবেন

ডাকসুর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কারা এগিয়ে 

ডাকসুর ভিপি-জিএস প্রার্থীদের পরিচয়

কলম্বিয়ায় হেলিকপ্টার ও বিমানঘাঁটিতে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত ১৮

১১ দল নিয়ে চট্টগ্রামে শুরু হচ্ছে রিজিওনাল ক্রিকেট টুর্নামেন্ট

১০

হঠাৎ কেন মোবাইলের ডায়াল প্যাডে পরিবর্তন

১১

বাংলাদেশি পোশাক খাতে দুই মাসে ক্রয়াদেশ বেড়েছে ৩২ শতাংশ

১২

গরম পানি পান করলে কি সত্যিই ওজন কমে

১৩

অবশেষে বিচ্ছেদ নিয়ে মুখ খুললেন সোহেল খান

১৪

কীভাবে যৌবন ধরে রেখেছেন রোনালদো, বিস্ময়কর তথ্য প্রকাশ

১৫

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে জাতিসংঘের বিশেষ দূতের সাক্ষাৎ

১৬

ওয়ানডেতেও অধিনায়ক হচ্ছেন গিল!

১৭

যুক্তরাষ্ট্রে ‘বেস্ট হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাওয়ার্ড’ পেলেন মিলন

১৮

ড্রাগন ফল কারা খেতে পারবেন না, জানালেন পুষ্টিবিদ

১৯

সুনামগঞ্জে ভুয়া এনএসআই সদস্য গ্রেপ্তার

২০
X