জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য অংশীজনের সঙ্গে আজ বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সর্বদলীয় বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। এই বৈঠকে আলোচনা ও প্রস্তাবনার মধ্য দিয়ে কখন, কীভাবে ঘোষণাপত্রটি দেওয়া হবে, তা স্পষ্ট করা হবে। যদিও প্রাথমিকভাবে জুলাই অভ্যুত্থানের খসড়া ঘোষণাপত্র নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অনির্ধারিত আলোচনা হয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠন, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, গণতন্ত্র মঞ্চ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, গণঅধিকার পরিষদসহ রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে তিন-চার দিন আগে ঘোষণাপত্রের খসড়া পৌঁছানো হয়েছে। তারা খসড়া ঘোষণাপত্রের অধিকাংশ ধারা নিয়ে একমত। কয়েকটি ধারা নিয়ে দ্বিমত আছে। এই দ্বিমতগুলো নিয়ে তারা দলীয় ফোরামে এবং বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে নিজেরাও কিছু প্রস্তাব দিতে চায়। এখন বিষয়টি চূড়ান্ত করতেই সর্বদলীয় বৈঠকের আহ্বান করা হয়েছে। তবে গতকাল বুধবার রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কতটি দলকে আমন্ত্রণ করা হয়েছে কিংবা সর্বদলীয় বৈঠকের স্থান ও সময় নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে বিস্তারিত কিছুই জানানো হয়নি। গত রাতে কয়েকটি দলের নেতারা জানান, তারাও বৈঠকের বিষয়ে কিছুই জানেন না। ফলে বৈঠকের বিষয়টি নিয়ে রাজনীতিবিদদের মধ্যে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। অবশেষে রাত সোয়া ৮টার দিকে প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ মজুমদার জানান, আজ বিকেল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সর্বদলীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। বৈঠকে নেতৃত্ব দেবেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
এদিকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা জানিয়েছেন, তারা আমন্ত্রণ পেলে বৈঠকে অংশ নেবেন। তারা সুনির্দিষ্ট মতামত তুলে ধরবেন। বিশেষ করে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে গত ১৬ বছরে আন্দোলন-সংগ্রামসহ যেসব ত্যাগ করেছেন এবং হামলা-মামলা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রে সেসবের স্বীকৃতি চাইবেন। অবশ্য যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দল ও জোটের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করে আলাদাভাবে জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। এরই মধ্যে এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির দুজন সদস্যের নেতৃত্বে কাজও শুরু হয়েছে। তার আগে সমমনা দল এবং জোটের নেতারা জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র নিয়ে তাদের পরামর্শ বিএনপির কাছে দেবেন। যার শিরোনাম হতে পারে ‘ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে বিজয়গাথা’। সবকিছু বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করে দ্রুত সময়ের মধ্যে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বিএনপি চূড়ান্ত ঘোষণাপত্র দেবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
প্রসঙ্গত, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র প্রকাশ করতে চাইলে তা নিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা আলোচনা তৈরি হয়। হঠাৎ ঘোষণাপত্রের বিষয়টি কেন সামনে আনা হলো, এর প্রভাব কী হতে পারে, তা নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন ওঠে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেস উইং তখন এ উদ্যোগের সঙ্গে সরকার সম্পৃক্ত নয় বলে উল্লেখ করেছিল।
অবশ্য পরে ৩০ ডিসেম্বর রাতে জরুরি সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের একটি ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ওই রাতেই বৈঠক করে ৩১ ডিসেম্বর শহীদ মিনারে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ (ঐক্যের জন্য যাত্রা) কর্মসূচি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। ওই কর্মসূচি থেকে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়। এ লক্ষ্যে জনমত তৈরিতে ৬ থেকে ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে লিফলেট বিতরণ, সমাবেশ ও জনসংযোগ করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি।
শিক্ষার্থীদের আলটিমেটামের মধ্যেই গত মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের খসড়া ঘোষণাপত্র নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অনির্ধারিত আলোচনা হয়েছে। বিএনপি, জামায়াত, গণতন্ত্র মঞ্চসহ রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে অনির্ধারিত আলোচনা হয়েছে। এর আগে গত ৯ জানুয়ারি সন্ধ্যায় রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে মাহফুজ আলম বলেছিলেন, ঘোষণাপত্র সরকার দেবে না। সরকার ঘোষণাপত্রের প্রক্রিয়াকে সহায়তা করছে। ঘোষণাপত্র আসবে সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে।
রাজনৈতিক দলগুলো মনে করছে, গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের পক্ষ থেকে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ নিয়ে হঠাৎ রাজনৈতিক অঙ্গনে যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল, তা থেমেছে এবং এ নিয়ে বড় ধরনের রাজনৈতিক বিতর্ক-বিভেদও এড়ানো গেছে। এখন প্রশ্ন উঠেছে যে, গণঅভ্যুত্থানের ‘ঘোষণাপত্র’ কীভাবে তৈরি হবে, এই ‘ঘোষণাপত্রে’ কী কী থাকবে? এরই মধ্যে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সম্মুখ সারির ছাত্রনেতারা ঘোষণাপত্রে বাহাত্তরের সংবিধানকে বাতিল করা, আওয়ামী লীগকে অপ্রাসঙ্গিক করার ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন। পাশাপাশি সরকারকে উদ্যোগ নেওয়ায় সাধুবাদ জানিয়ে ১৫ জানুয়ারির মধ্যে ঘোষণাপত্র দেওয়ার আলটিমেটাম দেন।
জানা যায়, রাজনৈতিক দলগুলোর সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ‘ঘোষণাপত্র’ জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে তৈরির দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। গত ৯ জানুয়ারি সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম জানান, এ সময় কিছুটা বাড়ানো হতে পারে। সবার সঙ্গে আলোচনা করে ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করা হবে। সরকার কোনো ঘোষণাপত্র দেবে না। এটি আসবে শিক্ষার্থীদের প্রস্তাবনা এবং সব রাজনৈতিক দল, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে। তবে এ উদ্যোগের সফলতা বা কার্যকর করা নিয়ে অনেকের মধ্যে সংশয় তৈরি হয়। প্রায় সব রাজনৈতিক দল সরকারের এমন উদ্যোগকে সমর্থন দিলেও দলগুলোর নিজস্ব ভাবনা ও প্রস্তাবনা রয়েছে। ঘোষণাপত্র নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বিমত না থাকলেও দৃষ্টিভঙ্গিতে কিছু পার্থক্য রয়েছে।
বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা আলাপকালে জানান, তারা সরকারের উদ্যোগকে সঠিক বলে মনে করছেন। শুধু জুলাই-আগস্টের ৩৬ দিনের গণঅভ্যুত্থানের সময় নয়, বিগত ১৬ বছরের আন্দোলনের, ত্যাগের স্বীকৃতি চান। এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে একমত হয়ে তা করতে হবে। সেইসঙ্গে এ ঘোষণায় বিগত ১৬ বছরের আন্দোলন-সংগ্রাম, গুম-খুন, নির্যাতন-নিপীড়ন, জেল-জুলুমসহ রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা—সব থাকতে হবে।
বিএনপি নেতারা মনে করেন, জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান হয়েছে। সে অভ্যুত্থানের পর জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তী সরকার হয়েছে। এই সরকার সংবিধান অনুযায়ী শপথ নিয়েছে। সরকার গঠনের প্রায় পাঁচ মাসের মাথায় এসে ‘বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ দেওয়ার সুযোগ নেই। তবে বিষয়টি নিয়ে সতর্ক এবং কৌশলী জামায়াতে ইসলামী। ছাত্রদের এ উদ্যোগকে ‘স্বাধীন মতপ্রকাশের’ জায়গা থেকে স্বাগত জানায় দলটি। এখন সরকারের পক্ষে ঘোষণাপত্র প্রকাশে উদ্যোগের বিষয়ে দলটির নীতিনির্ধারকরা বলছেন, তাদের আলোচনার জন্য বলা হলে তাদের সুনির্দিষ্ট বিষয়ে দলীয় প্রস্তাবনা তুলে ধরবেন। দায়িত্বশীল দল হিসেবে এ বিষয়ে তারা আগাম কোনো প্রকাশ্য মন্তব্য করতে চান না। জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার গতকাল কালবেলাকে বলেন, তারা এখনো সর্বদলীয় বৈঠকের আমন্ত্রণ পাননি। ঘোষণাপত্র নিয়ে আগাম কিছু বলা ঠিক হবে না।
আলাদাভাবে ঘোষণাপত্র দেওয়ার উদ্যোগ বিএনপির: এদিকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বিষয়ে আলাদাভাবে ঘোষণাপত্র দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। শেখ হাসিনার পতনের দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দল ও জোটের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করে দ্রুত সময়ের মধ্যে তা চূড়ান্ত করা হবে। এরই মধ্যে এ বিষয়ে কাজও শুরু হয়েছে। সমমনা দল এবং জোটের নেতারা জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র নিয়ে তাদের পরামর্শ বিএনপির কাছে দেবেন। সবকিছু বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করে বিএনপি চূড়ান্ত ঘোষণাপত্র দেবে। বিএনপি ও যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলগুলোর একাধিক নেতা কালবেলাকে জানান, ৩৬ জুলাই কিংবা ৫ আগস্ট বিজয়ের গল্পটা এক দিনের কিংবা ৩৫ দিনের নয়। গল্পটা শুরু হয়েছিল ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি (ওয়ান ইলেভেন)। সেজন্যই তারা ‘ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে বিজয়গাথা’ শীর্ষক ঘোষণাপত্র তুলে ধরতে চান। যেখানে ওয়ান ইলেভেনের ঘটনার নেপথ্য কাহিনি এবং ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়বস্তু তুলে ধরা হবে। এরপর আওয়ামী লীগের শাসনামল (২০০৯-২০১৩), ২০১৪ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচন, আওয়ামী লীগ শাসনামল (২০১৪-২০১৮), ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর প্রহসন ও ভোট ডাকাতির নির্বাচন, আওয়ামী লীগের দুঃসহ শাসনামল (২০১৮-২০২৩), ২০২৪ সালের ডামি তথা একতরফা নির্বাচন এবং নির্বাচন-পরবর্তী সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলন থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বিএনপি ও বিরোধী দলের ভূমিকা, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে বিএনপি ও বিরোধী দলের ভূমিকা (২০০৮-২০২৪) এবং আগামীর প্রত্যাশা অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
জুলাই ঘোষণাপত্র প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একজন উপদেষ্টা মাহফুজ আলম সাহেবের কাছ থেকে ঘোষণার খসড়াপত্র পেয়েছি এবং উনি অনুরোধ করেছেন যে, এই বিষয়ে আমাদের মতামত জানানোর জন্য। বিষয়টা এত বেশি সংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ যে, এটা এক দিনের নোটিশে করা সম্ভব নয়। আমরা এই বিষয়ে আলোচনা করেছি এবং করছি। অন্য দলগুলোর সঙ্গেও আলোচনা করতে হবে। শুধু তাই নয়, সংবিধান বিশেষজ্ঞদের সঙ্গেও কথা বলতে হবে। কারণ, এই ঘোষণাপত্রের মধ্যে সংবিধানের ব্যাপারেও বহু কথা আছে, যেটি আমাদের দেখতে হয়। সুতরাং আমাদের ওই সময়টুকু লাগবে আর কী, আমরা চেষ্টা করছি, আলোচনা করছি এটার ওপরে।’