উচ্চ আদালত থেকে অধস্তন আদালত সবখানেই সরকারি আইনজীবী নিয়োগ হয় দলীয় বিবেচনায়। রাজনৈতিক যোগ্যতা ও তদবির ছাড়া নিয়োগ হয় না জিপি, পিপি থেকে শুরু করে অ্যাটর্নি জেনারেল পর্যন্ত। ফলে মামলার বিচারে এর প্রভাব পড়ে। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ও দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠনের কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন আইন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, জাতিসংঘ দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশনে স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠনের বিধান রয়েছে। সততা, দক্ষতা, যোগ্যতা ও নৈতিকতাসম্পন্ন আইনজীবীকে আইন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করতেই স্বাধীন প্রসিকিউশন সার্ভিস গঠন করা দরকার।
সংবিধান সংস্কার কমিশন তার চূড়ান্ত প্রতিবেদন গত ১৫ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেয়। ওই প্রতিবেদনে স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন গত ডিসেম্বর মাসে একটি প্রাথমিক প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। সেখানেও স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠনের প্রয়োজনীয়তা ও কীভাবে গঠন করা যায়, তার বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে।
পরে ২১ জানুয়ারি আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠনের ঘোষণা দিয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘সরকারি কৌঁসুলিরা যেহেতু দলীয়ভাবে নিয়োগ পান, সেজন্য তারা অনেক সময় নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে পারেন না। রাষ্ট্রের পক্ষে ভূমিকা পালন না করে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে ভূমিকা পালন করেন। এর সমাধান হচ্ছে স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠা করা। সেই লক্ষ্যে আইন তৈরির কাজ শুরু করা হয়েছে।’
এর আগে ২০০৮ সালে ১/১১’র তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এই স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠন করে অধ্যাদেশ জারি করা হয়। কিন্তু রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এসে জাতীয় সংসদে ওই অধ্যাদেশের অনুমোদন দেয়নি। ফলে আলোর মুখ দেখেনি ‘স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস’। আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে রাষ্ট্র সংস্কার চলাকালে স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস গড়ে তোলার দাবি ওঠে। সে অনুয়ায়ী এরই মধ্যে সংবিধান সংস্কার কমিশন তার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এবং বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন তার প্রাথমিক প্রতিবেদনে ‘স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস’ গঠনের সুপারিশ করেছে। এবার স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠনের সুপারিশের বাস্তবায়ন চান আইন বিশেষজ্ঞসহ বিচার সংশ্লিষ্টরা।
আইন বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, ‘স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস বাস্তবায়নে প্রধান বাধা হচ্ছে দলীয় আইনজীবীরা। দল ক্ষমতায় এলেই তারা জিপি-পিপি হবেন, সেই আশা থেকেই তারা স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিসের বিরোধিতা করেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে একটি বড় কোম্পানির ১০ থেকে ১৫ জন আইন কর্মকর্তা থাকেন। কিন্তু মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে সেভাবে আইন কর্মকর্তা নেই। বিসিএসে ২৬টি ক্যাডার থাকলেও আইন কর্মকর্তা নিয়োগের কোনো ক্যাডারও নেই। এটা একটা অদ্ভুত দেশ। ফৌজদারি মামলায় ৮০ ভাগ আসামি খালাস পেয়ে যান। এর কারণ স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস না থাকা।
শাহদীন মালিক বলেন, বর্তমানে যেভাবে চলছে, তাতে দক্ষ আইন কর্মকর্তা থাকে না। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সরকারি আইন কর্মকর্তা পরিবর্তনের কারণে দক্ষ আইন কর্মকর্তা গড়ে ওঠে না। অভিজ্ঞতা অর্জন করতে করতে একজন দক্ষ আইন কর্মকর্তা গড়ে তোলার জন্য স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠন দরকার।
আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০০২ সালে অ্যাটর্নি সার্ভিস আইনপ্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের চূড়ান্ত অনুমোদনের পর অ্যাটর্নি সার্ভিস অধ্যাদেশ প্রেসিডেন্ট সংবিধানের ৯৩ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী একই বছরের ১৫ মে অনুমোদন দেন। এর তিন দিন পর ১৮ মে গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। ওই অধ্যাদেশের ক্ষমতাবলে একই বছর ২ জুন সরকারি অ্যাটর্নি অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করা হয়। জাতীয় প্রেস ক্লাবের দক্ষিণ পাশে সচিবালয় লিংক রোডের পরিবহন পুলের ১১ তলায় অফিসও নেওয়া হয়। ওই অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হিসেবে লেজিসলেটিভ বিভাগের তৎকালীন যুগ্ম সচিব মো. ইসরাইল হোসেনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। অধিদপ্তরে কয়েকটি সভাও অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে ওই অধ্যাদেশ জাতীয় সংসদে পাস না হওয়ায় তা হিমাগারে চলে যায়।
সাবেক জেলা ও দায়রা জজ শাহজাহান সাজু কালবেলাকে বলেন, ‘বর্তমানে যে পদ্ধতিতে সরকারি আইন কর্মকর্তা নিয়োগ হয়, তাতে তাদের কোনো জবাবদিহিতা থাকে না। তারা সবাই রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তির কারণে নিয়োগ পান। যার কারণে জিপি, পিপিরা তাদের অধীনস্থদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি থাকায় এবং চাকরি স্থায়ী না হওয়ায় তারা বিভিন্ন অনিয়মের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়েন। কোন মামলার বিচারে যতটুকু ভূমিকা রাখার দরকার, অনেক সময় ততটুকু রাখেন না। ফলে বিচারপ্রার্থীরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন। স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস হলে জনগণ কিছুটা হলেও ন্যায়বিচার পাবেন বলে আমি মনে করি।
তিনি আরও বলেন, অতীতেও আমরা অ্যাটর্নি সার্ভিস স্থাপনের উদ্যোগ নিতে দেখেছি। কিন্তু স্বার্থান্বেষী মহলের কারণে সেটা চালু করা সম্ভব হয়নি। আশা করি, এবার দেশের স্বার্থে ও জনগণের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে সরকার স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস করবে এবং আগামীতৈ যারা ক্ষমতায় আসবেন, তারাও এটাকে স্বাগত জানাবেন।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মুহাম্মদ শিশির মনির কালবেলাকে বলেন, ‘পৃথিবীর সব সভ্য দেশে স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস চালু রয়েছে। স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস ছাড়া বর্তমানে যেভাবে চলছে, তাতে রাষ্ট্রকে যে সার্ভিস দেবে সেটা ব্যাহত হচ্ছে। এটা না থাকলে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা সরকারপক্ষের আইনজীবীদের মতো ভূমিকা পালন করেন। তাদের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয় না। স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস হলে জিপি, পিপি থেকে শুরু করে অ্যাটর্নি জেনারেল পর্যন্ত সবারই আত্মমর্যাদা বাড়বে। এটা না হলে বিচার প্রক্রিয়ায় নিরপেক্ষতা ব্যাহত হবে।’