শেখ হারুন
প্রকাশ : ১৯ আগস্ট ২০২৩, ০১:৪০ এএম
আপডেট : ১১ আগস্ট ২০২৫, ০১:১৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

‘অন্যের’ বাঁওড়ে শতকোটি টাকা খরচের চিন্তা

মৎস্য অধিদপ্তরের প্রকল্পে পরিকল্পনা কমিশনের আপত্তি
‘অন্যের’ বাঁওড়ে শতকোটি টাকা খরচের চিন্তা

আধুনিক মৎস্য চাষ প্রযুক্তি সম্প্রসারণের আওতায় ইজারা দেওয়া সরকারি ৬টি বাঁওড় খননের মাধ্যমে উন্নয়ন করতে চায় মৎস্য অধিদপ্তর। এজন্য ১২৭ কোটি ৩৭ লাখ টাকা ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে। খননের মাধ্যমে ইজারার বাঁওড়ে উন্নয়ন প্রস্তাব নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এর আগেও মৎস্য অধিদপ্তরের প্রকল্পে এই ৬টি বাঁওড় উন্নয়নের জন্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। ভূমি মন্ত্রণালয়ের মতামতের ভিত্তিতে নিমগাছি ও বাঁওড় এলাকায় সমাজভিত্তিক মৎস্যসম্পদ ব্যবস্থাপনা শীর্ষক সেই প্রকল্প থেকে বাদ দেওয়া হয়।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ভূমি মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি জানিয়েছেন, ওই ৬টি সরকারি বাঁওড় ইতোমধ্যে ইজারা দেওয়া হয়েছে। এসব বাঁওড় কোনো প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত হলে মামলা-মোকদ্দমার উদ্ভব হতে পারে।

প্রকল্প প্রস্তাবনা সূত্রে জানা গেছে, মৎস্য অধিদপ্তরের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও মৎস্য খামার যান্ত্রিকীকরণের জন্য বিদ্যমান সরকারি মৎস্য ও বাঁওড়গুলোর সক্ষমতা এবং মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে অবকাঠামো উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে মৎস্য অধিদপ্তর। সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে খরচ হবে ১ হাজার ৪০৮ কোটি টাকা। আলোচ্য প্রকল্পে শুধু ইজারার বাঁওড় নয়, মৎস্য অধিদপ্তরের প্রস্তাবিত প্রকল্পে বিদেশ ভ্রমণ, প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত ভবন নির্মাণ, নির্মাণকাজে বিধিবহির্ভূত কেনাকাটার প্রস্তাব, পরামর্শক খাতে অত্যধিক ব্যয়সহ বিভিন্ন খাতে অত্যধিক এবং অপ্রয়োজনীয় ব্যয় প্রস্তাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন।

মৎস্য অধিদপ্তরের আলোচ্য প্রকল্পের ওপর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় সভাপতিত্ব করেন কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) এ কে এম ফজলুল হক। সভায় আলোচ্য প্রকল্প প্রস্তাবের বিভিন্ন খাতের অতিরিক্ত ব্য়য় প্রস্তাব এবং অসংগতি নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। যেসব খাতে অতিরিক্ত ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে, সেগুলো যৌক্তিক পর্যায়ে কমিয়ে আনার পাশাপাশি বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে ডিপিপি সংশোধনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

সভায় উপস্থিত সংশ্লিষ্ট পরিকল্পনা কমিশনের এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, বেশকিছু খাতে ব্যয় প্রস্তাব অত্যধিক বলে প্রতীয়মান হয়েছে। সেগুলো যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া ইজারা দেওয়ায় বাঁওড়গুলো প্রস্তাবিত প্রকল্প থেকে বাদ দিতে বলা হয়েছে। বিদেশ প্রশিক্ষণের বিষয়ে তিনি বলেন, মৎস্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণের জন্য ৭ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে এ খাতে ব্যয় কমাতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া যেসব খাতে ব্যয় বেশি মনে হয়েছে তা কমিয়ে ডিপিপি সংশোধন করতে বলা হয়েছে।

মৎস্য অধিদপ্তরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (পরিকল্পনা ও জরিপ) সৈয়দ মো. আলমগীর কালবেলাকে বলেন, বাঁওড়গুলো ভূমি মন্ত্রণালয় ইজারা দেওয়ায় আন্তঃমন্ত্রণালয়ে আলোচনায় সিদ্ধান্ত হবে।

পিইসি সভার কার্যপত্র পর্যালোচনা করে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে সব প্রকল্পে বৈদেশিক ভ্রমণ, ওয়ার্কশপ, সেমিনারে অংশগ্রহণ বন্ধ রাখার নির্দেশনা থাকলেও মৎস্য অধিদপ্তরের ডিপিপিতে ১০০ জনের বৈদেশিক প্রশিক্ষণ বা শিক্ষা সফরের জন্য ৭ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবিত বৈদেশিক প্রশিক্ষণের বিষয়ে অর্থ বিভাগের মতামত গ্রহণের পাশাপাশি ব্যয় কমাতে বলেছে পরিকল্পনা কমিশন।

এদিকে, দুজন কর্মকর্তার জন্য তিনতলা অফিস ভবন নির্মাণ প্রস্তাব নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। জানা গেছে, ডিপিপিতে ৫৩টি খামারে ৭ হাজার ১৬০ বর্গফুটের তিনতলা অফিস বিল্ডিং এবং ১২০টি খামারে ৪০০ বর্গফুটের লেবার শেড নির্মাণের জন্য ২৫১ কোটি ৬৬ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। যদিও ডিপিপি অনুযায়ী এসব খামারে নবম গ্রেডের একজন ফার্ম ম্যানেজার এবং ১৩তম গ্রেডের একজন ক্লার্ক কাম টাইপিস্ট নিয়োজিত থাকবেন। দুজন জনবলের ওপর ভিত্তি করে ৭ হাজার ১৬০ বর্গফুটের তিনতলা অফিস ভবন নির্মাণ কতখানি যৌক্তিক, তা জানতে চেয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।

এ ছাড়া আলোচ্য প্রকল্পের আওতায় টেন্ডার পদ্ধতিও পিপিআর অনুযায়ী করা হয়নি। মোট ব্যয়ের মধ্যে ১ হাজার ১৮৭ কোটি ৩৫ লাখ টাকার নির্মাণকাজের ক্রয় পদ্ধতি হিসেবে উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতির (ওটিএম) পরিবর্তে সরাসরি কেনাকাটা পদ্ধতি (ডিপিএম) উল্লেখ করা হয়েছে। যেটাকে পিপিআর-২০০৮-এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেছে পরিকল্পনা কমিশন।

নির্মাণকাজের ডিজাইন এবং পরামর্শক খাতে মোট ব্যয়ের ৯ দশমিক ০৯ শতাংশ ব্যয় প্রস্তাবকে অত্যধিক মনে করেছে পরিকল্পনা কমিশন। অন্য পরামর্শক ছাড়া ভবন নির্মাণকাজে সরকারি বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান গণপূর্ত অধিদপ্তরের মাধ্যমে ডেলিগেট ওয়ার্ক হিসেবে কাজ করা হলে ওই ব্যয় সাশ্রয় করা সম্ভব হবে।

ডিপিপিতে প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট উৎপাদিত রেণুর মাত্র ১ থেকে দেড় শতাংশ এবং মোট উৎপাদিত পোনার মাত্র শূন্য দশমিক ২৭ থেকে শূন্য দশমিক ৪৫ শতাংশ সরকারী হ্যাচারি বা খামারে উৎপাদিত হয়। বাকি ৯৯ শতাংশ রেণু বা পোনা বেসরকারি খামার বা হ্যাচারি উৎপাদিত হয়। এমতাবস্থায় মাত্র ১ শতাংশ রেণু বা পোনার জন্য সরকারি খামার বা হ্যাচারিগুলোতে প্রস্তাবিত ১ হাজার ৪০৮ কোটি ১২ লাখ টাকার বিনিয়োগ প্রকল্প নেওয়ার বিষয়েও প্রশ্ন তুলে কতখানি লাভজনক হবে, তা জানতে চাওয়া হয়েছে।

পরিকল্পনা কমিশন বলছে, সব সরকারি হ্যাচারি বা খামারগুলোতে একবারে যান্ত্রিকীকরণ না করে প্রথমে ৫-৭টিতে পাইলটিং পদ্ধতিতে প্রকল্প নেওয়া উচিত। পরে ফলাফলের ভিত্তিতে পর্যায়ক্রমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।

সার্বিক বিষয়ে মৎস্য অধিদপ্তরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (পরিকল্পনা ও জরিপ) সৈয়দ মো. আলমগীর কালবেলাকে বলেন, দেশের মানুষকে গুণগত মানের রেণু ও পোনা উৎপাদনের পাশাপাশি সরকারি মৎস্যবীজ দেওয়াটাই আমাদের কাজ। সরকারি খামার হলো সেটার নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান। সুতরাং শতাংশের হিসাবে মেলানো যাবে না। প্রশিক্ষণসহ বেসরকারি খামারগুলোর সাপোর্টও আমাদের এখান থেকে দেওয়া হয়। সুতরাং এই প্রকল্পের যৌক্তিকতা আছে।

তিনি বলেন, প্রস্তাবনাটা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। অনেক কিছু কাটাছাঁট হবে। পরিকল্পনা কমিশন যেসব পর্যবক্ষণ দিয়েছে সেগুলো আমলে নিয়ে ডিপিপি সংশোধন করা হবে। দুজনের জন্য তিনতলা অফিস বিল্ডিংয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, খামারের কর্মকর্তার সঙ্গে অবকাঠামোসহ অনেক বিষয় জড়িত থাকে। এটা যৌক্তিকভাবেই প্রস্তাব করা হয়েছে।

সরকারি নির্দেশনা থাকলেও বিদেশ প্রশিক্ষণের বিষয়ে সৈয়দ মো. আলমগীর বলেন, সরকারি নয়, বিদেশ যায় ডোনার এজেন্সির টাকায়। সরকারি টাকায় হবে না বললেও ডিপিপিতে সরকারি টাকায় বিদেশ ভ্রমণের ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে।

জানা গেছে, প্রকল্পটি অনুমোদন হলে চলতি বছরে শুরু হয়ে ২০২৭ সালের জুনে শেষ হবে। দেশের ৫৬টি জেলার ১০৮টি উপজেলায় অবস্থিত মৎস্য খামার বা হ্যাচারিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে। প্রকল্পের উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে, সরকারি মৎস্য খামার আধুনিকীকরণ ও সরকারি বাঁওড় উন্নয়ন, প্রযুক্তি সম্প্রসারণের লক্ষ্যে খামারে উন্নত মৎস্য প্রযুক্তি স্থাপন, উন্নত কৌলিতাত্ত্বিক গুণসম্পন্ন প্রজননক্ষম মাছ সংরক্ষণ এবং মৎস্য খাতে নিয়োজিত জনবলের কারিগরি সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য দক্ষতা উন্নয়ন করা হবে।

প্রকল্পের প্রধান প্রধান কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে ৫৬টি খামারে বটমলাইনার মাছচাষ প্রযুক্তির প্রদর্শনী স্থাপন, লট ডিভাইস স্থাপনের মাধ্যমে খামারগুলো অটোমেশন, খামার ও বাঁওড়ের পুকুরগুলোর রিমডেলিংয়ের মাধ্যমে আধুনিকায়ন, ৬টি বাঁওড় উন্নয়ন, খামারে ও বাঁওড়ে সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল স্থাপন, খামারে ক্রায়োপ্রিজারভেশন, খামারে প্রশিক্ষণের সুবিধাদিসহ অফিস ভবন নির্মাণ এবং প্রশিক্ষণ।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মনোনয়নপত্র বিতরণ ও জমার সময় বাড়াল ডাকসু নির্বাচন কমিশন

এনবিআরের আরও ৫ কর্মকর্তা বরখাস্ত

টকশোতে বসে এনসিপি নেতা জানলেন তিনি বহিষ্কার

ট্রাম্পের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকের তথ্য জানালেন জেলেনস্কি

এশিয়া কাপের আগে ভারত দলে দুঃসংবাদ

দুই দাবিতে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা মুক্তিযোদ্ধা পরিবার ও বস্তিবাসীদের

আ.লীগ নেতা এফএম শরীফুল গ্রেপ্তার

ছাত্রদলকে সুবিধা দিতেই মনোনয়নপত্র গ্রহণের সময় বৃদ্ধি : বাগছাস

এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতা মাহিন সরকারকে বহিষ্কার

ডাকসু নির্বাচন / ‘দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পর আকাঙ্ক্ষা পূরণ হতে যাচ্ছে’

১০

এক ফ্যান এক বাতিতে বিদ্যুৎ বিল এক লাখ ৬৭ হাজার টাকা!

১১

চমক রেখেই বাছাইপর্বের শেষ দুই ম্যাচের প্রাথমিক দল ঘোষণা আর্জেন্টিনার

১২

মাকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ গেল শিশু সন্তানেরও

১৩

মব সৃষ্টি করে বাধা, ছাত্রদলের অভিযোগের তদন্তে কমিটি গঠন 

১৪

গুলশানে সাংবাদিক মুনজুরুল করিমের কফিশপ ভাঙচুর

১৫

মাভাবিপ্রবিতে বাংলাদেশ-চীন অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব বিষয়ে সেমিনার

১৬

ছিনতাইয়ের ২ ঘণ্টার মধ্যে অটোরিকশা উদ্ধার

১৭

মিরসরাইয়ে পানিতে ডুবে ২ শিশুর মৃত্যু

১৮

মনোয়ারুল কাদির বিটুর নেতৃত্বে ড্যাবের কেন্দ্রীয় কমিটিকে ফুলেল শুভেচ্ছা 

১৯

৩২ নম্বরে ফুল দিতে এসে গ্রেপ্তার সেই রিকশাচালক কারামুক্ত

২০
X