বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সব ঘটনা তদন্ত করে সরকারের নিরপেক্ষ ও কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের চলমান নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা উচিত হবে না বলে মনে করেন মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের টম ল্যানটস হিউম্যান রাইটস কমিশনের প্যানেল বক্তারা। এসব বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আরও জোরালো ভূমিকা প্রত্যাশা করেন তারা।
গত মঙ্গলবার ‘হিউম্যান রাইটস ইন বাংলাদেশ: অ্যান আপডেট’ শীর্ষক ভার্চুয়াল ব্রিফিংয়ে এমনটাই জানান আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের প্রচার, সুরক্ষা ও সমর্থনে কাজ করা সংস্থার প্রতিনিধিরা। ব্রিফিংয়ের আয়োজন করেন কমিশনের দুই কো-চেয়ারম্যান কংগ্রেসের ডেমোক্র্যাট সদস্য জেমস পি ম্যাকগভর্নর ও রিপাবলিকান সদস্য ক্রিস্টোফার এইচ স্মিথ। সঞ্চালনায় ছিলেন লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের বিদেশি আইনবিশেষজ্ঞ তারিক আহমেদ। আলোচক ছিলেন এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন অ্যান্ড এশিয়ান লিগ্যাল রিসোর্স সেন্টারের লিয়াজোঁ কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান, রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটসের ফেলো ক্রিস্টি উয়েদা, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ গবেষক জুলিয়া ব্ল্যাকনার ও যুক্তরাষ্ট্রের ইনস্টিটিউট অব পিসের সাউথ এশিয়া প্রোগ্রামসের ভিজিটিং এক্সপার্ট জেফ্রি ম্যাকডোনাল্ড।
ব্রিফিংয়ে তারিক আহমেদ বলেন, বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের অনুপ্রেরণাদায়ক গল্প হিসেবে বর্ণনা করেছে। অর্থনৈতিক সাফল্য সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে ক্ষমতার ক্রমবর্ধমান কেন্দ্রীভূতকরণ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। শেখ হাসিনা ১৪ বছর ধরে ক্ষমতায় আছেন। বিশেষজ্ঞসহ আন্তর্জাতিক-দেশীয় মানবাধিকার সংস্থাগুলো এক দশকে দেশটির মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি এবং গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসারণের কথা সামনে এনেছে। তারা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব, সাংবাদিক-ব্লগারদের নিপীড়নসহ বাকস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর বিধিনিষেধ, ইন্টারনেট-স্বাধীনতা সীমিত করার ঘটনা নথিভুক্ত করেছেন। দেশটিতে সাংবাদিক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী, ব্লগারদের গ্রেপ্তার-বিচারে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যবহার বিশেষভাবে উদ্বেগ তৈরি করেছে।
ব্রিফিংয়ে লিখিত বক্তব্যে আশরাফুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি আগের মতোই অত্যন্ত উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়েছে। যদিও র্যাব ও এর শীর্ষ কর্মকর্তাদের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় একটা তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব দেখা গেছে। র্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর বিচারবহির্ভূত হত্যা কমেছে। পরিসংখ্যান বলছে, এই নিষেধাজ্ঞা অনেক জীবন বাঁচাতে সাহায্য করেছে।
ক্রিস্টি উয়েদা বলেন, ২০১৮ সালের মতো ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় নির্বাচন সামনে রেখে বাংলাদেশ সরকার নাগরিক অধিকার সংকুচিত করছে। তারা সুশীল সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন, মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক ও সরকারের সমালোচকদের টার্গেট করছে। তারা ও তাদের পরিবার প্রতিহিংসামূলক গ্রেপ্তার, হয়রানি ও ভীতির শিকার হচ্ছেন। মতপ্রকাশ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ক্রমাগত সংকুচিত হচ্ছে।
ক্রিস্টি উয়েদা বলেন, বাংলাদেশ সরকার সংগঠন ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে খর্ব করেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো তদন্তে বাংলাদেশ সরকার নিরপেক্ষ ও কার্যকর জবাবদিহিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ না করা পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের চলমান নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা উচিত হবে না। বরং একই ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত অন্যান্য বাহিনীর বিরুদ্ধে নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি বিবেচনায় আনা উচিত।
জুলিয়া ব্ল্যাকনার বলেন, বাংলাদেশে মানবাধিকার রক্ষা ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ নিশ্চিতে যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপের একটি তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব তৈরি হয়েছে। নিষেধাজ্ঞার ফলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুম তাৎক্ষণিকভাবে কমে এসেছে। কিন্তু এখনো লোকজনকে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, বেআইনিভাবে আটকে রাখা হচ্ছে। পরে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে বা আদালতে হাজির করা হচ্ছে। কারা হেফাজতে নির্যাতনের কথাও শোনা যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, নিষেধাজ্ঞার পর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং গুম কমে যাওয়া এই বার্তা দিচ্ছে যে, বাংলাদেশ সরকার চাইলে মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ করতে পারে। দেশটিতে জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় সহিংসতা বাড়তে দেখা যাচ্ছে। বাড়ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্যাতন। কর্তৃপক্ষ অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ বলে যে দাবি করছে, তা বিশ্বাস না করতে কংগ্রেসের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
জেফ্রি ম্যাকডোনাল্ড বলেন, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশে যে জাতীয় নির্বাচন হতে যাচ্ছে, তা হবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক বাংলাদেশি এবং আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক দেশটির সর্বশেষ দুটি জাতীয় নির্বাচন (২০১৪ ও ২০১৮) খুবই ত্রুটিপূর্ণ, সহিংসতাপূর্ণ ও অনিয়মে ভরা ছিল বলে মনে করেন। যে দলই জয়লাভ করুক না কেন, রাজনৈতিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা, জনপ্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি বাংলাদেশের মানুষের বিশ্বাস পুনরুদ্ধারে দেশটিতে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন প্রয়োজন।
মন্তব্য করুন
আর্কাইভ 
| ২৭ আগস্ট ২০২৫ 