আগামী মাসে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট চালুর কথা থাকলেও তা হচ্ছে না। একাধিকবার সময় বাড়িয়েও সঞ্চালন লাইনের নির্মাণকাজ শেষ করতে না পারার কারণেই পিছিয়ে গেছে দেশের একমাত্র এই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালুর উদ্যোগ। আগামী জুনে সঞ্চালন লাইনের কাজ শেষ হলে সেপ্টেম্বর বা অক্টোবর নাগাদ রূপপুরের একটি ইউনিটে উৎপাদন শুরু হতে পারে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ তথ্য জানিয়েছেন।
এদিকে, সঞ্চালন লাইন নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির কর্মকর্তারা বলছেন, ফিজিক্যাল স্টার্টআপের জন্য যতটুকু সঞ্চালন লাইনের প্রয়োজন সেটা প্রস্তুত আছে। ইভাক্যুয়েশনের জন্য রূপপুর-গোপালগঞ্জ লাইনের ৪০০ কেভি পদ্মা রিভার ক্রসিং সঞ্চালন লাইনটি প্রয়োজন হবে। রিভার ক্রসিংয়ের কাজ আর্থিক সংকটের কারণে হচ্ছে না। এই কাজ যে কোম্পানিকে দিয়ে করানো হচ্ছে, তাদের বিল বকেয়া পড়েছে। সরকারের কাছে বকেয়া বিলের ২৬ মিলিয়ন ডলার চাওয়া হয়েছে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক ড. মো. জাহেদুল হাছান কালবেলাকে বলেন, ‘গ্রিড কানেকশন পাওয়ার চার মাসের মধ্যে প্রথম ইউনিট উৎপাদনে যেতে পারবে। চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে আমরা বিদ্যুৎ সরবরাহ করার আশা করছি।’ তিনি বলেন, ‘দু-তিন মাস লাগবে ফিজিক্যাল স্টার্টআপ (ফুয়েল লোড) এবং পাওয়ার স্টার্টআপ (শক্তি উৎপাদন) করতে এক মাস লাগবে।’
ডলার সংকটে পিছিয়ে পড়ছে সঞ্চালন লাইনে কাজ পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশের (পিজিসিবি) সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্পের গ্রিডলাইন প্রকল্প ভারতীয় ঋণে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ঋণ ছাড় করতে বেশ সময় নেয়। বাংলাদেশ থেকে বারবার তাগাদা দেওয়া হলেও দ্রুত ঋণ ছাড় হচ্ছিল না। পরে বাংলাদেশ সরকার গ্রিডলাইন নির্মাণ প্রকল্পে ভারতীয় ঋণ থেকে বেরিয়ে আসে। পাশাপাশি করোনা মহামারির কারণে পিছিয়ে পড়ে সঞ্চালন লাইনের কাজ। বর্তমানে পিজিসিবি ও সরকারের অর্থায়নে গ্রিড লাইনের কাজ করা হচ্ছে।
জানা গেছে, সঞ্চালন লাইনের কাজের বিপরীতে এখন প্রায় ৫০ মিলিয়ন ডলার বকেয়া পড়েছে। এর মধ্যে সঞ্চালন লাইনের ঠিকাদারের বিল বকেয়া ২৫ মিলিয়ন ডলার। গতকাল রোববার পিজিসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিদ্যুৎ উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে সঞ্চালন লাইনের কাজ দ্রুত শেষ করতে আপাতত এই ২৫ মিলিয়ন ডলার ছাড়ের অনুরোধ জানান। একসঙ্গে এই পরিমাণ অর্থছাড় করা না গেলে প্রতি সপ্তাহে ৫ মিলিয়ন ডলার ছাড় করার অনুরোধ জানানো হয়।
পিজিসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) আবদুর রশিদ খান কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা এখন আর্থিক সংকটে আছি। ডলার না পাওয়ার কারণে বিল পরিশোধ করতে পারছি না। এখন বকেয়ার পরিমাণ প্রায় ৫০ মিলিয়ন ডলার। সঞ্চালন লাইনের ঠিকাদারের বিল পরিশোধ করতে এখন ২৫ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। এটা দিতে পারলে এপ্রিলের মধ্যে সঞ্চালন লাইনের সকল কাজ শেষ করতে পারব। ঠিকাদার কোম্পানিকে আমরা দ্রুত কাজ শেস করার জন্য চাপে রেখেছি, কিন্তু তাদের বিল তো প্রদান করতে হবে।’
এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ফিজিক্যাল স্টার্টআপের জন্য দুটি সঞ্চালন লাইন প্রস্তুত রয়েছে। আর ফিজিক্যাল স্টার্টআপের তিন মাস পর ইভাক্যুয়েশন করতে হয়।
সংশ্লিস্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের প্রথম ও একমাত্র পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ ইভাক্যুয়েশনের জন্য তিনটি সঞ্চালন লাইনের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এর মধ্যে প্যাকেজ-১ প্রকল্পে রয়েছে রূপপুর বাঘাবাড়ি ২৩০ কেভি ডাবল সার্কিট লাইন নির্মাণ। ২০২২ সালের ২৯ জুন লাইনটি কমিশনিং করা হয়। এ ছাড়া প্যাকেজ-৫-এর আওতায় রূপপুর-বগুড়া ৪০০ কেভি সিঙ্গেল সার্কিট সঞ্চালন লাইন নির্মাণকাজ সম্পন্ন করে গত বছরের ৩০ এপ্রিল কমিশনিং করা হয়েছে। প্যাকেজ-৩-এর আওতায় রূপপুর-গোপালগঞ্জ ৪০০ কেভি সিঙ্গেল সার্কিট সঞ্চালন লাইনের রুট পরিবর্তনের কারণে প্রায় সাড়ে ৬ কিলোমিটার লাইন বৃদ্ধি হয়। এতে আরও ১৫টি টাওয়ার স্থাপন করতে হচ্ছে। এ ছাড়া রূপপুর-গোপালগঞ্জ ৪০০ কেভি লাইন নির্মাণের সমন্বয় করে ৪০০ কেভি পদ্মা রিভার ক্রসিং সঞ্চালন লাইনের কাজটি চলতি বছরের মার্চের মধ্যে সম্পন্ন হওয়ার কথা থাকলেও নির্দিষ্ট সময়ে এটি শেষ হচ্ছে না। গত বছরের জুলাই-আগস্টে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বিদেশি জনবল তাদের নিজের দেশে ফিরে যায়। ফলে পদ্মা রিভার ক্রসিং সঞ্চালন লাইনের নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে যায়। এ প্রকল্পের কাজ গত জানুয়ারি থেকে পুনরায় শুরু হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রিডলাইন নির্মাণে কিছু প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক দফা বাড়ানোর প্রয়োজন হতে পারে।
প্রস্তুত রাখতে হবে ১৯০৭ মেগাওয়াট ক্ষমতার গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্র:
গ্রিডলাইন ছাড়াও পারমাণবিক কেন্দ্রটি চালাতে হলে বিকল্প হিসেবে অন্তত ১ হাজার ৯০৭ মেগাওয়াট সক্ষমতার গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রস্তুত রাখতে হবে। সম্প্রতি রাশিয়ান পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এই সুপারিশ করা হয়েছে। কোনো কারণে রূপপুরে বিঘ্ন ঘটলে বিকল্প কেন্দ্র থেকে যেন সরবরাহ নিশ্চিত করা যায় সেজন্যই এ পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এটিকে স্পিনিং রিজার্ভ বলা হয়। স্পিনিং রিজার্ভ হলো বিদ্যুতের এমন স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা যাতে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বিদ্যুৎ উৎপাদন হঠাৎ কমে গেলেও গ্রিড ব্যবস্থার কোনো ক্ষতি না হয়।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. রেজাউর করিম কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলছি। গ্যাসের অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছি না। তারপরও বিষয়টি নিয়ে আমরা পেট্রোবাংলাসহ অন্যান্য পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করব।’
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশের পাওয়ার সিস্টেমে সংযুক্তিকরণের অন্যতম পূর্বশর্ত হলো সিস্টেম ফ্রিকোয়েন্সি স্থিতিশীলতা ও জাতীয় গ্রিডের নির্ভরযোগ্যতা নিশ্চিত করা। এ দুটো নিশ্চিত না করে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করা যাবে না।
পিজিসিবি বলেছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রাইমারি, সেকেন্ডারি, ও টারশিয়ারি ফ্রিকোয়েন্সি কন্ট্রোলের জন্য কী পরিমাণ স্পিনিং রিজার্ভ প্রয়োজন হবে এ বিষয়ে রুশ পরামর্শক জেএসসি এসটিসি ইউপিএস স্টাডি করছে। পরামর্শক সংস্থা কর্তৃক ‘ফ্রিকোয়েন্সি কন্ট্রোল ইন দ্য বাংলাদেশ পাওয়ার সিস্টেম’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিবেশগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি ফ্রিকোয়েন্সি কন্ট্রোলের জন্য স্পিনিং রিজার্ভ ১২শ মেগাওয়াট করে ২৪শ মেগাওয়াট স্পিনিং রিজার্ভের সুপারিশ করেছে। এ ছাড়া জাতীয় গ্রিডের সুরক্ষায় দেশের অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্রকেও সঞ্চালন লাইনে ফ্রি গভর্নিং মুড অব অপারেশনের (এফজিএমও) আওতায় আনার পরামর্শ দিয়েছে রাশিয়ান পরামর্শক প্রতিষ্ঠান।
দেশের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে এফজিএমওভুক্ত করতে সরকারের নির্দেশনা অনেক পুরোনো হলেও বাস্তবায়ন হয়েছে অল্পসংখ্যক বিদ্যুৎকেন্দ্রে। এই পদ্ধতিতে প্রতি ১৫ মিনিট অন্তর বিদ্যুতের চাহিদা ও উৎপাদনের একটি স্বয়ংক্রিয় পর্যালোচনা করা হয়। এতে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা রোধ করা যায় এবং সারা দেশে একবারে বিদ্যুৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটে না। বর্তমানে এফজিএমওভুক্ত ২৯টি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র (নেট সক্ষমতা ৭৩১৪ মেগাওয়াট) থেকে স্পিনিং রিজার্ভ পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ৭০ থেকে ১৫০ মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ বিভাগকে পিডিবি জানিয়েছে, বাংলাদেশ পাওয়ার সিস্টেম রিলায়বিলিটি অ্যান্ড ইফিসিয়েন্সি ইম্প্রুভমেন্ট প্রকল্পের আওতায় আরও ৩০টি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে এফজিএমওভুক্ত করা হচ্ছে। এরই মধ্যে ২৫টি বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে, যেগুলো থেকে ১০ শতাংশ হারে স্পিনিং রিজার্ভ পাওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি প্রাইমারি ফ্রিকোয়েন্সি বা এফজিএমও পদ্ধতিতে গ্যাস টারবাইনের রেসপন্স খুব দ্রুত পাওয়া যায়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে স্পিনিং রিজার্ভের অধিকাংশ পরিমাণ (৭০০-৮০০ মেগাওয়াট) যেন গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পাওয়া যায় সে লক্ষ্যে সিস্টেম সংযুক্ত গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় প্রয়োজনীয় গ্যাস (১৪৫০ থেকে ১৫৫০ মিলিয়ন ঘনফুট) সরবরাহের সংস্থান রাখার জন্য পেট্রোবাংলাকে অনুরোধ করার কথা বলা হয়েছে। যদিও বাস্তবতা হচ্ছে দেশে গ্যাসের প্রচণ্ড সংকট চলছে।
পাবনার রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৫ সালে মস্কোর সঙ্গে ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সাধারণ চুক্তি (জিসি) সই করে। এরপর ২০১৬ সালের জুলাইয়ে এই প্রকল্পের জন্য ১১ দশমিক ৩৮৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ পেতে রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের একটি আর্থিক চুক্তি হয়, যা প্রকল্প ব্যয়ের ৯০ শতাংশ। আর্থিক অঙ্কে এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এই প্রকল্পে নানারকম দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এরই মধ্যে এসব অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।