জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আত্মপ্রকাশ করেছে। নতুন দলের আহ্বায়ক করা হয়েছে সাবেক তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামকে। সদস্য সচিব করা হয়েছে আখতার হোসেনকে। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন রাজনৈতিক দল এবং আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবের নাম ঘোষণা করেন জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে নিহত শহীদ মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন রাব্বীর বোন মীম আক্তার। পরে নতুন দলের ঘোষণাপত্র পাঠ করেন আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। যেখানে উঠে আসে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের কথা, শপথ নেওয়া হয় ছাত্র-জনতার নতুন বাংলাদেশ গড়ার।
১৫১ সদস্যবিশিষ্ট আংশিক কমিটির অন্য সদস্যদের নাম ঘোষণা করেন সদস্য সচিব আখতার হোসেন। দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক পদে সামান্তা শারমিন ও আরিফুল ইসলাম আদীব, সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব পদে ডা. তাসনিম জারা ও নাহিদা সরোয়ার নিভা, প্রধান সমন্বয়কারী পদে নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, যুগ্ম সমন্বয়ক পদে আব্দুল হান্নান মাসউদ, মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) পদে হাসনাত আব্দুল্লাহ ও মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) পদে সারজিস আলমের নাম ঘোষণা করেন তিনি।
নতুন দলের আত্মপ্রকাশ উপলক্ষে বিশাল অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সকাল থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে নানা যানবাহনে করে এই অনুষ্ঠান দেখতে আসেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। আগতদের মধ্যে অধিকাংশই তরুণ ও শিক্ষার্থী। তারা বলেন, বাংলাদেশে আজ নতুন এক সূর্যোদয় হবে। দেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত করার জন্য তরুণরা নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের মধ্য দিয়ে শপথ গ্রহণ করবেন।
দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকেও লোকজন অনুষ্ঠানস্থলে আসেন। অনেকে আশপাশের বিভিন্ন ভবনের ওপর থেকে অনুষ্ঠান দেখেছিলেন। এমনকি অনুষ্ঠানস্থলের পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন গাছে উঠেও অনুষ্ঠান দেখেন সাধারণ মানুষ। অনেককেই অনুষ্ঠানের ভিডিও ও চিত্রধারণ করতে দেখা গেছে।
এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলা ও ঢাকার বিভিন্ন থানা থেকে জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা স্লোগান দিতে দিতে মিছিল নিয়ে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে জড়ো হন। দলের আত্মপ্রকাশ ঘিরে পতাকা হাতে মিছিল নিয়ে উচ্ছ্বাস করেন তারা। মঞ্চের সামনের সারিতে একপাশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের বসার আসন রাখা হয়। আরেক পাশে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদ পরিবারের সদস্যদের বসার ব্যবস্থা রাখা হয়।
এই জমায়েতে মেডিকেল টিম, ওয়াশরুম, পুলিশ বুথ, পানির ব্যবস্থা করা হয়। একই সঙ্গে মঞ্চের পেছনে নারীদের জন্য অন্য বুথের ব্যবস্থা করা হয়। পাশাপাশি ভিআইপিদের জন্য ছিল বিশেষ ব্যবস্থা। এদিকে জমায়েত ঘিরে নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল বলে জানান ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার জুয়েল রানা।
মূল আনুষ্ঠানিকতার আগে জুলাই অভ্যুত্থানের ওপর ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করা হয়। ডকুমেন্টারির প্রথমে শেখ হাসিনার একটি ভিডিও প্রচার করা হয়। তখন শেখ হাসিনাকে দেখেই ভুয়া ভুয়া স্লোগানে অনুষ্ঠানস্থলে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। অনুষ্ঠানে জুলাই অভ্যুত্থানের ওপর মোট দুটি ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করা হয়।
বিকেল সোয়া ৪টায় জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াতের মধ্য দিয়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠান শুরু হয়। এরপর পবিত্র গীতা, ত্রিপিটক ও বাইবেল থেকে পাঠ করা হয়। ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠের পর জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়। প্রথমে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা তারেকুল ইসলাম (তারেক রেজা)। এরপর পবিত্র গীতা থেকে পাঠ করেন জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতা অর্পিতা শ্যামা দেব। পরে পবিত্র ত্রিপিটক থেকে আবির বড়ুয়া এবং পবিত্র বাইবেল থেকে পাঠ করেন অলিক। তারাও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতা। এরপর জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়। পরে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। পাশাপাশি সবাইকে নিজ নিজ ধর্মমত অনুযায়ী শহীদদের জন্য প্রার্থনা করতে বলা হয়।
জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে যোগ দেন দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা।
বিএনপির পক্ষ থেকে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ও যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের নায়েবে আমির আহমেদ আলী কাসেমী, বিকল্পধারার নেতা মেজর (অব.) আব্দুল মান্নান, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা জালালুদ্দীন আহমেদ, ইসলামী ঐক্য জোটের সহসভাপতি জসিম উদ্দিন, বিএলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমেদ আবদুল কাদের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া অনুষ্ঠানে কূটনীতিকদের মধ্যে পাকিস্তান হাইকমিশনারের পক্ষে একজন কাউন্সিলর অংশ নিয়েছেন বলে মঞ্চ থেকে জানানো হয়।
আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম জুলাই গণঅভ্যুত্থানকারী ছাত্র-জনতা, শহীদ পরিবারের সদস্য ও রাজনৈতিক দলের নেতাদের সংগ্রামী সালাম ও শুভেচ্ছা জানিয়ে বক্তব্য দেন এবং দলের ঘোষণাপত্র পাঠ করেন।
অনুষ্ঠানে জাতীয় নাগরিক পার্টির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, আগামীর বাংলাদেশ নতুন এক সংবিধানের মাধ্যমে পরিচালিত হবে বলে স্বপ্ন দেখেন তরুণরা। তাদের এ স্বপ্ন পূরণে গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি জানান তিনি। আখতার বলেন, দোয়া করবেন, বাংলাদেশের তরুণ সমাজ আজকে যে দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছে, মহান রাব্বুল আলামিন যেন আমাদের সেই দায়িত্ব পালনের তৌফিক দেন।
দলটির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে বাংলাদেশ থেকে পরিবারতন্ত্র কবরস্থ করার প্রত্যয় জানান হাসনাত আব্দুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘আমরা নিশ্চিত করতে চাই, এ দেশ থেকে পরিবারতন্ত্র কবরস্থ হয়েছে। এ দেশে কামারের ছেলে প্রধানমন্ত্রী হবে, এ দেশে কুমারের ছেলে প্রধানমন্ত্রী হবে। এ দেশে যোগ্যতার ভিত্তিতে নেতৃত্ব উঠে আসবে।’ তিনি বলেন, গণভবন ও সংসদ ভবনে কে যাবে, তা নির্ধারণ করবে দেশের খেটে খাওয়া জনগণ, ভারত থেকে সেটি নির্ধারিত হবে না। একটি সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করার প্রত্যয় জানিয়ে হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, ‘এ দেশে আমাদের মধ্যে ভেদাভেদ থাকবে না। রাজনৈতিক পরমতসহিষ্ণুতা থাকবে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে, দ্বিমত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে।’
জাতীয় নাগরিক পার্টির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম বলেন, বড় রাজনৈতিক দলগুলো যদি ছোট দলকে এগিয়ে যেতে না দেয়, তবে ধীরে ধীরে তারা স্বৈরাচারে পরিণত হবে। আমরা যদি বাংলাদেশকে সুসংগঠিত করতে চাই, তাহলে আমাদের সব রাজনৈতিক দলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আগামীর বাংলাদেশ হবে ঐক্যের বাংলাদেশ। ৫ আগস্ট হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশ নিয়ে যে স্বপ্নগুলো দেখেছিলাম, সেগুলো আমরা বাস্তবায়ন করতে চাই। আমাদের কোনো একটি বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে কথা থাকবে, তর্ক-বিতর্ক থাকবে; কিন্তু দিনশেষে যেটা দেশের জন্য এবং দেশের মানুষের জন্য মঙ্গলকর, সেটাতে আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারি। আমরা বিশ্বাস করি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এই মিউচুয়াল রেসপেক্ট থাকলে আগামীর বাংলাদেশ হবে অপ্রতিরোধ্য বাংলাদেশ।
জুলাই অভ্যুত্থান থেকে শুরু করে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন পর্যন্ত যারা সহযোগিতা করেছেন, তাদের সবার ত্যাগের মূল্যায়ন করা হবে বলে জানান নতুন রাজনৈতিক দলের মুখ্য সমন্বয়কের দায়িত্ব নিতে যাওয়া নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। তিনি বলেন, আমরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে একটি নতুন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি এই চব্বিশে। সেই ঐতিহাসিক বিজয়ের আরেকটি সন্ধিক্ষণে আমরা এখানে উপস্থিত হয়েছি। গত ১৫ বছরে আমরা যখন গণতন্ত্রের কথা বলেছি, তখনই আমাদের গুম-খুন করা হয়েছে।
সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন বলেন, আমরা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের চেষ্টা করে যাচ্ছি। সে আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে যাচ্ছি। আর এই আকাঙ্ক্ষার মূলে আছে এ দেশের মানুষের প্রতি আমাদের ওয়াদা। তিনি বলেন, চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আমরা বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটানোর একটি স্বপ্ন দেখতে পাচ্ছি। এই স্বপ্নের মধ্য দিয়ে আমরা বাংলাদেশে রাষ্ট্র পুনর্গঠনের কথা বলছি। কারণ, বাংলাদেশকে কেউ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। আমাদের এই উদ্যোগ নিতে হবে।
সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব ডা. তাসনিম জারা বলেন, আমরা ক্ষমতা দখলের জন্য রাজনীতি করতে আসিনি, জনগণের ক্ষমতা জনগণকে ফিরিয়ে দিতে এসেছি। তিনি বলেন, বিগত সময়ের রাজনীতি ছিল ক্ষমতার খেলা, জনগণের সঙ্গে প্রতারণা ও স্বার্থের লেনদেন। আমরা এর অবসান চাই। আমরা এমন রাজনীতি করতে চাই, যেখানে কোনো ব্যক্তি বা পরিবারের স্বার্থ সংরক্ষিত হবে না; রাজনীতি হবে মানুষের পাশে দাঁড়ানো, জনগণের কথা বলা। এমন বাংলাদেশ চাই, যেখানে যে কেউ তার যোগ্যতা ও সততার ভিত্তিতে জনগণকে নেতৃত্ব দিতে পারবে। এতে তার পারিবারিক পরিচয় মুখ্য হয়ে উঠবে না।
জুলাই অভ্যুত্থানে উদ্দীপ্ত তরুণদের নেতৃত্বে সব রাজনৈতিক দলকে সঙ্গে নিয়ে আগামীর বাংলাদেশ পুনর্গঠন করার প্রতিশ্রুতি দেশবাসীর কাছে রেখেছেন দলটির সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ। তিনি বলেন, আর কোনো নির্বাচনের আগে দলে দলে সংঘাত হয়ে প্রাণহানির ঘটনা ঘটতে তরুণরা দেবে না। আগামীর বাংলাদেশে সবাই দল-মত নির্বিশেষে বসবাস করবে। তরুণদের নেতৃত্বে সব রাজনৈতিক দলকে সঙ্গে নিয়ে আগামীর বাংলাদেশ পুনর্গঠন করা হবে, এটা দেশবাসীর কাছে আমাদের প্রতিশ্রুতি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য সচিব আরিফ সোহেল বলেন, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জনগণ আর কারও দাসত্ব মেনে নিতে চায় না। কোনো এলিট গোষ্ঠীর দাসত্ব আর বাংলার জনগণ মানবে না। এটাই আমাদের নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত।
মন্তব্য করুন