বাংলাদেশে বিনিয়োগের নানা সম্ভাবনা, আগ্রহ এবং প্রতিশ্রুতির মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে চার দিনের বিনিয়োগ সম্মেলন। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিনিয়োগ সম্মেলন আপাতত সফল হয়েছে দাবি করে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) জানিয়েছে, এবারের বিনিয়োগ সম্মেলনের মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগের পাইপলাইন তৈরি হয়েছে। সামনের দিনগুলোয় বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার মাধ্যমে বিনিয়োগ ত্বরান্বিত করার প্রচেষ্টা চালানো হবে।
গতকাল বৃহস্পতিবার ‘বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট ২০২৫’-এর শেষ দিনের কর্মসূচি নিয়ে রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে বিজনেস ডেভেলপমেন্ট বিভাগের প্রধান নাহিয়ান রহমান রোচি। এ সময় বিডার মার্কেটিং অ্যান্ড কমিউনিকেশন অনুবিভাগের নির্বাহী সদস্য শাহ মোহাম্মদ মাহবুব এবং প্রধান উপদেষ্টার উপপ্রেস সচিব মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ মজুমদার উপস্থিত ছিলেন।
বিডার ব্যবসা উন্নয়ন বিভাগের প্রধান বলেন, এবারের বিনিয়োগ সম্মেলনের মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগের পাইপলাইন তৈরি হয়েছে। এরই মধ্যে যেসব প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগের প্রস্তাব কিংবা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তাদের সঙ্গে ধারাবাহিক যোগাযোগ করা হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারী যারা বাংলাদেশে এসেছেন, তারাও যেন সত্যিকারের বিনিয়োগ করেন, সেজন্য তাদের ধারাবাহিকভাবে মনিটরিংও করা হবে।
সামিটকে কেন্দ্র করে ১৮ থেকে ২৪ মাসের রোডম্যাপ করবে বিডা—এমন তথ্য জানিয়ে তিনি বলেন, বিনিয়োগকারীরা সাধারণত ১৮ থেকে ২৪ মাস সময় নেন বিনিয়োগ করতে, প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ধরে ধরে যোগাযোগ করা হবে। এজন্য সামিটকে কেন্দ্র করে তৈরি করা হবে ১৮ থেকে ২৪ মাসের রোডম্যাপ।
বিনিয়োগকারীরা বেশকিছু সমস্যার কথা জানিয়েছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, সম্পদের প্রাপ্তি, নীতির ধারাবাহিকতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দুর্নীতিসহ মোটা দাগে চার থেকে পাঁচটি সমস্যার কথা তারা জানিয়েছেন। আমরা রাজস্ব বিভাগসহ বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কাজ করছি। আমাদের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা রয়েছে, তা দূর করার চেষ্টা চলছে।
আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসনে বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগ নিয়ে সরকারের পদক্ষেপ আছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে নাহিয়ান রহমান বলেন, আগে ৭০ জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর কারণে বিনিয়োগকারীদের প্রক্রিয়ায় এক ধরনের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা তৈরি হতো। এখন ২৪ থেকে ২৫ জন উপদেষ্টার কারণে বিষয়গুলো আরও কেন্দ্রীকরণ করা হয়েছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার বিষয়ে অনেক উন্নতি হয়েছে। তিনি বলেন, শুধু এনবিআর নয়, সরকারি সেবায় ধীরগতি আছে। আমরা আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়ের জন্য পদক্ষেপ নিচ্ছি। এনবিআরের গ্রিন চ্যানেল তৈরি করা হচ্ছে।
সামিটে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ কত ছিল—সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের এখানে সাড়ে ৫০০ রেজিস্ট্রেশন ছিল, এর মধ্যে ৪০০ থেকে ৪৫০ বিদেশি প্রতিনিধি এসেছেন। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের দুজন প্রতিনিধিও এসেছেন। সম্মেলন উপলক্ষে চীনা আরএমজি প্রতিষ্ঠান হান্ডার সঙ্গে ১৫০ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি হয়েছে। এ ছাড়া শপআপ ১১০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ পেয়েছে। পূর্ণাঙ্গ বিনিয়োগ ও বিনিয়োগকারীর তথ্য পরে জানানো হবে।
বিডার বিজনেস ডেভেলপমেন্ট বিভাগের প্রধান বলেন, আমাদের উদ্দেশ্য কত বিনিয়োগ এলো সেটা নয়, আমরা চেয়েছি এই সম্মেলনের মাধ্যমে আমাদের বিনিয়োগের পরিবেশ সম্পর্কে একটা ধারণা দেওয়া। একই সঙ্গে আমাদের বিভিন্ন সেক্টরের বিনিয়োগের কী ধরনের সুযোগ রয়েছে, সেগুলো জানানো এবং তাদের সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের একটি ম্যাচমেকিংয়ের ব্যবস্থা করিয়ে দেওয়া, সেটি করতে আমরা সফল হয়েছি।
এদিন বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিটে ‘টেক্সটাইল ও অ্যাপারেল’ শীর্ষক একটি সেশনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে কোরিয়ান ইপিজেডের প্রতিষ্ঠাতা কিহাক সুং বলেছেন, সঠিক কৌশল ও সংস্কার বাস্তবায়ন করতে পারলে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় পোশাক রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশ একক দেশ হিসেবে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশের অবস্থানে রয়েছে। শীর্ষস্থানে পৌঁছাতে হলে বাংলাদেশকে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নত করতে হবে।
‘নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টিতে ডিজিটাল অর্থনীতি’ শীর্ষক আরেক সেমিনারে উদ্যোক্তারা বলেন, ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার ভালো স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। যেখানে তরুণ মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। ফলে ডিজিটাল ইকোনমিতে দেশটিতে ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। তার জন্য ডিজিটাল ইকোনমি বিস্তার ও সুরক্ষায় সরকারকে সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট দ্রুত করার আহ্বান জানান তারা। সেমিনারে অর্থনীতিতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই), ব্যাংকিং সেক্টর এবং সেমিকন্ডাক্টর সেক্টরের সমস্যা সম্ভাবনা নিয়ে একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়।
স্বাগত বক্তব্যে সিটি ব্যাংক এন এ-এর কান্ট্রি অফিসার মো. মইনুল হক বলেন, কভিড-১৯ মহামারির সময় ডিজিটাল অর্থনীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এ সময়ে এটি ব্যবসা চালু রেখেছে, দূর থেকে কাজের সুযোগ দিয়েছে, ই-কমার্সকে শক্তিশালী করেছে এবং মানুষকে যুক্ত রেখেছে যখন প্রচলিত কাঠামোগুলো ব্যাহত হয়েছিল।
যা ছিল চার দিনের ইনভেস্টমেন্ট সামিটে:
বিনিয়োগকারীদের চাহিদা অনুযায়ী ভিন্নধর্মী আয়োজন ছিল এবারের সম্মেলনে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, ইউএইসহ রেকর্ডসংখ্যক ৪০টি দেশের খ্যাতনামা বিনিয়োগকারীরা এতে অংশ নেন। পাশাপাশি দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়িক নির্বাহী ও নীতিনির্ধারকরা এতে অংশ নেন।
সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে বিশ্বখ্যাত নামিদামি ব্র্যান্ড ইন্ডিটেক্স গ্রুপ, ডিপি ওয়ার্ল্ড, জিওডারনো, এক্সিলারের এনার্জিসহ কোম্পানির অনেক বিনিয়োগকারী রয়েছেন। এরই মধ্যে বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত বিনিয়োগকারী কোম্পানির শীর্ষ নীতিনির্ধারকরা বাংলাদেশে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ একধাপ এগিয়ে বিনিয়োগ চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই করেছেন। মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার সঙ্গে চুক্তির বিষয়টিও বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
এবারের সম্মেলনের বিষয়ে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেছেন, বিনিয়োগ সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠে ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করা। বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে। বিনিয়োগকারী অনেকেই মনে করেন বাংলাদেশে বিনিয়োগের মোটেও পরিবেশ নেই। তাদের এই মনে করার পেছনে যৌক্তিক কারণও রয়েছে। অতীতের সরকারের আমলে অনেক বিনিয়োগকারী এ দেশে বিনিয়োগের ইচ্ছা নিয়ে এলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং নানা হয়রানি ও অসহযোগিতার কারণে ফিরে গেছেন।
বিনিয়োগ সম্মেলনে আপাতত প্রাপ্তি:
বাংলাদেশে বড় বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সফররত দক্ষিণ কোরিয়ার ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদল। বাংলাদেশে ব্যবসা সম্প্রসারণের কথা জানিয়েছে স্পেনের খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ইন্ডিটেক্স, সিমেন্ট খাতের কোম্পানি লাফার্জহোলসিম ও চীনের অ্যাপারেল কোম্পানি হান্ডা ইন্ডাস্ট্রিজ। বাংলাদেশ সফররত যুক্তরাজ্যের বাণিজ্য দূত ব্যারোনেস রোজি উইন্টারটন দেশের স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা খাতে প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি বিনিময় ও দীর্ঘমেয়াদি অংশীদারত্বের বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
চীনের খ্যাতনামা পোশাক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হান্ডা ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড বাংলাদেশে ১৫ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে। তার মধ্যে ১০ কোটি ডলার অর্থনৈতিক অঞ্চলের আওতায় টেক্সটাইল ও ডাইং খাতে এবং পাঁচ কোটি ডলার রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে গার্মেন্টস শিল্পে বিনিয়োগ করা হবে। এ-সংক্রান্ত একটি সমঝোতা স্মারক সইও হয়েছে। এর মাধ্যমে ১৫ হাজার কর্মসংস্থান হবে।
দেশের নতুন উদ্যোক্তাদের অর্থায়নের জন্য ১২০০ কোটি টাকার একটি বিশেষ তহবিল গঠনের ঘোষণা বাংলাদেশ ব্যাংকের, স্টার্টআপ খাতে গতি সঞ্চারে ১০ লাখ ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে দেশীয় শিল্পগোষ্ঠী ইনসেপ্টা গ্রুপ, বিএসইজেডে ১৩ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে সুইডিশ কোম্পানি নির্লন, চলতি বছর ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করতে চেয়েছে বাংলাদেশে ব্রিকস গঠিত নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এনডিবি)।
মাতারবাড়ীতে মুক্তবাণিজ্য জোন তৈরিতে আগ্রহী ডিপি ওয়ার্ল্ড গ্রুপ, মহাকাশ অনুসন্ধানে নাসার সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি, স্টারলিংকের পরীক্ষামূলক সেবা চালু, এ ছাড়া টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির জন্য বাণিজ্য ও বিনিয়োগ উন্নয়নের লক্ষ্যে বিডা, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এবং জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) একটি অভিপত্র সই, ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে এইচঅ্যান্ডএম, প্রাণ-আরএফএল ও আইএফসির মধ্যে একটি সমঝোতা চুক্তিসহ বিভিন্ন চুক্তি হয়েছে।
সম্মেলনে বিনিয়োগে অবদানের জন্য চার ক্যাটাগরিতে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সম্মাননা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। পুরস্কারপ্রাপ্তরা হলো ওয়ালটন, বিকাশ, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস ও ফেব্রিক্স। এ ছাড়া বিশেষ ক্যাটাগরিতে কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোনের চেয়ারম্যান কিহাক সাং-কে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেওয়া হয়।
মন্তব্য করুন