ভঙ্গুর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে পুলিশের সহায়ক হিসেবে ‘অক্সিলারি ফোর্স’ নিয়োগের কথা জানিয়েছিলেন ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার। সে অনুযায়ী ৪২৬ সদস্যের অক্সিলারি ফোর্স গঠন করা হয়। গত রমজান মাসে এই ফোর্সের ‘কার্যক্রম’ শুরু হলেও এর সদস্যরাই জানেন না তাদের কাজ কী! কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই শুধু হাতে একটি পরিচয়পত্র ধরিয়ে দিয়ে থানা থেকে বলা হয়েছে, ‘আপনি অক্সিলারি ফোর্সের সদস্য।’ এই ধরনের পরিচয়পত্র পাওয়া অক্সিলারি ফোর্সের অন্তত ৫০ জন সদস্যের সঙ্গে কথা বলে এই তথ্য মিলেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডিএমপির ৫০ থানার মধ্যে ৪৮টি থানা থেকে বেসরকারি নিরাপত্তাকর্মীদের মধ্য থেকে ৪২৬ সদস্যের এই অক্সিলারি ফোর্স নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নিয়োগ পাওয়া প্রায় সবাই বেসরকারি নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানগুলোর হয়ে বিভিন্ন শপিংমল, হাসপাতাল, গুরুত্বপূর্ণ ভবন, আবাসিক এলাকা এবং আবাসিক হোটেলের সিকিউরিটি ইনচার্জ বা প্রধান নিরাপত্তাকর্মী। যারা সাধারণত মাঠপর্যায়ে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন না। তবে পুলিশের পক্ষ থেকে তাদের পরিচয়পত্র দেওয়া হলেও কোনো নিয়োগপত্র দেওয়া হয়নি। তাদের দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রমও চোখে পড়েনি।
ঢাকা মহানগর পুলিশ অধ্যাদেশে এই অক্সিলারি ফোর্স নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে পুলিশ কমিশনারকে। এর আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় অক্সিলারি ফোর্স নামে পুলিশে এমন সহযোগী নিয়োগ দেওয়ার নজির নেই। এতে এই নিয়োগ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও আগ্রহের সৃষ্টি হয়।
ঢাকা মহানগর পুলিশ অর্ডিন্যান্স-১৯৭৬-এর দ্বিতীয় অধ্যায়ে এই অক্সিলারি ফোর্স নিয়োগের বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘অন্য যে কোনো পুলিশ কর্মকর্তার মতো সহায়ক পুলিশ কর্মকর্তার একই ক্ষমতা এবং দায়মুক্তি থাকবে। পাশাপাশি একই দায়িত্ব পালনের জন্য দায়ী থাকবেন এবং একই শাস্তির জন্য দায়ী থাকবেন। তারা অন্য যে কোনো পুলিশ অফিসারের মতো একই কর্তৃপক্ষের অধীন হবেন।’
এই ফোর্স নিয়োগের কথা জানিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার শেখ সাজ্জাত আলী জানিয়েছিলেন, ‘এই ফোর্স পুলিশের মতোই গ্রেপ্তারি ক্ষমতা পাবেন এবং বিভিন্ন এলাকায় নিয়মিত টহল কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।’
রাজধানীর কাকরাইলে রাজমনি ঈশা খাঁ হোটেলের প্রধান নিরাপত্তাকর্মী মো. মহিউদ্দিনও এই অক্সিলারি ফোর্সের সদস্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। তিনি কালবেলাকে বলেন, রমনা থানা থেকে তাকে জানানো হয়েছে যে তিনি অক্সিলারি ফোর্সের সদস্য হয়েছেন। প্রাথমিকভাবে তাকে তার হোটেলের নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেখভাল এবং হোটেলের আশপাশে কোনো ঝামেলা হলে থানাকে অবহিত করতে বলা হয়েছে।
পশ্চিম ধানমন্ডি এলাকার নিরাপত্তাকর্মী এবং অক্সিলারি ফোর্স সদস্য আরিফুল ইসলাম জানান, হাজারীবাগ থানা থেকে একদিন ফোন দিয়ে বলার পর তিনি থানা থেকে গিয়ে কার্ড (পরিচয়পত্র) নিয়ে আসেন। তাকে বলা হয়েছে, এলাকায় কোনো ছিনতাই, চাঁদাবাজি বা মাদক কারবার হয় কি না, সেই বিষয়ে থানায় জানানোর জন্য।
তিনি বলেন, আমাকে শুধু তথ্য দিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া আমাদের বলা হয়েছিল সার্বিক দায়িত্ব নিয়ে ব্রিফ করা হবে। কিন্তু এর পর থেকে পুলিশের আর কেউ যোগাযোগ করেনি।
প্রায় অভিন্ন কথা বলেছেন সিদ্ধেশ্বরী এলাকার আনারকলি মার্কেটের নিরাপত্তা ইনচার্জ মো. শহিদুল ইসলাম, ধানমন্ডি সাত মসজিদ রোড এলাকার কে বি স্কয়ারের নিরাপত্তা ম্যানেজার মো. আক্তারুজ্জামান, সীমান্ত স্কয়ারের নিরাপত্তা সুপারভাইজার মো. খবিরুল ইসলাম, গ্রেটওয়াল শপিং সেন্টারের নিরাপত্তাকর্মী আবু সাঈদ এবং লেডিস পার্ক হকার্স মার্কেটের নিরাপত্তাকর্মী আবুল কালামসহ অক্সিলারি ফোর্সে দায়িত্ব পাওয়া অন্তত ৫০ জন সদস্য।
কাউকে আটক বা গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে কি না—জানতে চাইলে অক্সিলারি ফোর্সের কয়েক সদস্য জানান, তাদের কাছে তো কোনো অস্ত্র নেই কিংবা তাদের এ বিষয়ে কোনো প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়নি।
একজন সদস্য বলেন, ‘পুলিশই তো অনেক সময়ে আটক করতে পারে না। সেক্ষেত্রে ঢাল-তলোয়ার ছাড়া আমরা তা কীভাবে করব?’
তালিকায় দেখা যায়, ডেমরা এলাকার হাজী হোসেন প্লাজা স্টাফ কোয়ার্টারের নিরাপত্তাকর্মী কাজল মিয়া এবং কোনাপাড়া সিটি মিলের নিরাপত্তাকর্মী মো. বেলায়েত হোসেনও অক্সিলারি ফোর্সের সদস্য হিসেবে রয়েছেন। তবে তারা জানান, অক্সিলারি ফোর্সের সদস্য হিসেবে যে তারা তালিকায় আছেন, তা জানেনই না! বেলায়েত হোসেন কালবেলাকে বলেন, এ বিষয়ে আমাকে কেউ কিছুই জানায়নি।
এদিকে মাঠে নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্ব পালন করা ডিএমপির কয়েকটি থানার উপপরিদর্শকদের (এসআই) সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিজ নিজ দায়িত্ব এলাকায় এই অক্সিলারি ফোর্সের সদস্য কারা এবং তাদের দায়িত্ব কী, সেই বিষয়ে তারাও অবগত নন। অন্তত ১০ জন উপপরিদর্শক কালবেলাকে বলেছেন, অক্সিলারি ফোর্সের সদস্যদের তারা চেনেন না। বিভিন্ন অভিযানে গেলে বা অভিযান সংক্রান্ত কোনো কাজে এখন পর্যন্ত তাদের সহযোগিতা নেননি।
তবে ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ডিসি তালেবুর রহমান কালবেলাকে বলেন, অক্সিলারি ফোর্সের সদস্যরা এখনো সক্রিয় আছেন। তারা অবৈতনিকভাবে পুলিশ সদস্যদের তথ্য দিয়ে সহায়তা করছেন। প্রয়োজনে তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে।
অক্সিলারি ফোর্সের সদস্যদের আটক বা গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে কি না—জানতে চাইলে তিনি বলেন, আটক করার ক্ষমতা একজন সাধারণ নাগরিকেরও আছে। কারও সামনে কোনো অপরাধ হলে তিনি সেই অপরাধীকে আটক করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করতে পারবেন। সেই হিসেবে সবারই আটক করার ক্ষমতা আছে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে এই অক্সিলারি ফোর্সের মতো আইনশৃঙ্খলা ও ট্রাফিক কার্যক্রমে ‘কমিউনিটি পুলিশ’ নামে নানা পেশার বেসরকারি লোকদের নিয়োগ দেওয়া হয়। শুরুতে তাদের কার্যক্রম নিয়ে নগরবাসীর স্বস্তি থাকলেও পরে দেখা যায়, কমিউনিটি পুলিশে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন, স্থানীয় চাঁদাবাজ ও মাদক কারবারিদের অনেকেই জায়গা করে নিয়েছে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও সমাজ বিজ্ঞানী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তৌহিদুল হক কালবেলাকে বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অক্সিলারি ফোর্স নিয়ে বড় কিছু করার সুযোগ নেই। যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তারা যে ধরনের কাজ করে সেই হিসেবে তাদের কাছ থেকে বেশি কিছু প্রত্যাশা করা যায় না। পুলিশ বাহিনী যে স্বপ্ন আর প্রত্যাশা নিয়ে অক্সিলারি ফোর্স শুরু করেছে, সেটা পূরণ হওয়া বাস্তবিকভাবে অনেক কঠিন। এই পরিস্থিতিটা তারাও দ্রুতই বুঝতে পারবেন। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও বিষয়টি নিয়ে আরও স্পষ্ট হতে হবে যে, অক্সিলারি ফোর্স নিয়ে তারা আসলে কী চান।
মন্তব্য করুন