মাহমুদুল হাসান
প্রকাশ : ২৮ আগস্ট ২০২৩, ০৩:০৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ডেঙ্গুর প্রকোপ

ঢাকার বাইরে মশক নিধনে উদ্যোগ কম

ঢাকার বাইরে মশক নিধনে উদ্যোগ কম

ডেঙ্গু রোগ এখন সারা দেশে। রাজধানীর বাইরে রোগীর হার বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্যমতে, গতকাল হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ২৩২৭ জনের মধ্যে ১৪০৭ জন ঢাকার বাইরের। চলতি মৌসুমে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ১ লাখ ১৪ হাজার ৫১১ জনের মধ্যে ৬০ হাজার ১০২ জনই ঢাকার বাইরের। গ্রামে রোগীর সংখ্যা বিগত বছরের তুলনায় বাড়লেও মশক নিধন, সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতাসহ অন্যান্য কর্মযজ্ঞ রাজধানীকেন্দ্রিক। মশা নিয়ে জরিপও হয় শুধু ঢাকার দুই সিটিতে। এত উদ্যোগের পরও কেন রাজধানীতে মশার প্রকোপ কমছে না!

সর্বশেষ মশক জরিপের তথ্যমতে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের চেয়ে উত্তরে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১৮ দশমিক ২১ শতাংশ বাসাবাড়িতে ডেঙ্গুর লার্ভার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। আর দক্ষিণের ১৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ বাসাবাড়িতে। দুই সিটি করপোরেশনের ৪৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ বহুতল ভবনে এডিসের রয়েছে উপস্থিতি। এ ছাড়া একক বাসাবাড়িতে ২১ দশমিক ৩১ শতাংশ এবং নির্মাণাধীন ভবনে ১৮ দশমিক ২১ শতাংশ লার্ভা পাওয়া গেছে। ঢাকার ১৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ ভেজা মেঝেতে এডিসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।

গতকাল রোববার বিকেলে রাজধানীর শেরাটন হোটেলে ডেঙ্গু মোকাবিলায় করণীয় শীর্ষক রাউন্ড টেবিল বৈঠকেও উপেক্ষিত ছিল ঢাকার বাইরের ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের আলোচনা। আলোচনায় ডেঙ্গু প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরের প্রতিনিধি উপস্থিত থাকলেও ছিলেন না স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি। এমনকি স্থানীয় সরকারের সর্বশেষ স্তর ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত কোনো স্তর থেকেই প্রতিনিধিত্ব করা হয়নি।

কীটতত্ত্ববিদদের ভাষ্যমতে, ডেঙ্গুর জন্য দায়ী মূলত এডিস ইজিপ্টাই ও এডিস অ্যালবোপিকটাস। এ বছর জরিপে দেখা গেছে, গ্রামে মূলত এডিস অ্যালবোপিকটাস বেশি বিস্তার ছড়িয়েছে। এডিসের এ ধরনটি কলাগাছ কিংবা কচুপাতায় জমে থাকা সামান্য পানিতেও লার্ভা তৈরি করতে পারে। আমাদের আলোচনা সবচেয়ে বেশি হচ্ছে শহুরে এডিস ইজিপ্টাইকে নিয়েই। কিন্তু গ্রামে সংক্রমণ বেশি হলেও সে বিষয়ে তেমন কোনো আলোচনা নেই। এ বিষয়ে আমাদের এখনই জোর দিতে হবে। নয়তো আগামী বছরগুলোতে গ্রামে বা ঢাকার বাইরে চিকিৎসায় বড় সংকট দেখা দিতে পারে।

ঢাকার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনায় অংশ নিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির বলেন, মশক নিধনে সিটি করপোরেশনের কোনো গাফিলতি নেই। মশক নিধন একটি ব্যাপক কর্মযজ্ঞ। মানুষের সহযোগিতা ছাড়া মশক নিধন সম্ভব নয়।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ.কে.এম শফিকুর রহমান বলেন, বাসাবাড়িতে ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে মানুষ সহযোগিতা না করলে রাজধানীতে শুধু সিটি করপোরেশন এককভাবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। আমরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ডেঙ্গুর উৎস ধ্বংসের চেষ্টা করছি; কিন্তু মানুষকে সচেতন হতে হবে সবার আগে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, মানুষের আচরণগত পরিবর্তন অনেক কঠিন কাজ। পাশাপাশি লজিস্টিক সাপোর্ট। সরকারি প্রতিষ্ঠানে সবসময়ই কিছু ঘাটতি থাকে, সেটা মোকাবিলা করার চেষ্টা চলছে। সময়মতো মশা নিধন, জনসম্পৃক্ততা বাড়ানো না গেলে সংক্রমণ ও মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব নয়।

সরকারের জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (নিপসম) একমাত্র মেডিকেল অ্যান্টোমলজিস্ট হিসেবে কাজ করছেন অধ্যাপক ড. মো. গোলাম ছারোয়ার। তিনি বলেন, কীটতাত্ত্বিক সার্ভে নয়, ডেঙ্গু মোকাবিলায় এখন কীটতাত্ত্বিক সার্ভিলেন্স প্রয়োজন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির দুই সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধিদের বলেন, ডেঙ্গু মৌসুমে শুধু ফগার মেশিন নিয়ে ঘুরলে চলবে না। সারা বছর মশা মারার উদ্যোগ নিতে হবে।

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ড. মু আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, ডেঙ্গু আমাদের জন্য একটি থ্রেট। ডেঙ্গু নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বেশ তৎপর।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, মশা নিধনে যেভাবে ডোবা-নালায় স্প্রে হওয়া দরকার, সেভাবে হচ্ছে না। স্কুলেও অনেক বাচ্চা আক্রান্ত হচ্ছে। সেখানে ঠিকমতো মশা নিধনের স্প্রে হচ্ছে না বলে মনে হচ্ছে। পাশাপাশি কলকারখানায় যাতে নিয়মিত স্প্রে হয়, সেটি তদারকি করতে হবে। যেসব মশা জন্মাচ্ছে, সেগুলো নিয়েও গবেষণা হওয়া দরকার।

ডেঙ্গু চিকিৎসায় সরকারের ব্যয় ৪০০ কোটি টাকা:

ডেঙ্গু মহামারিতে লক্ষাধিক মানুষ অসুস্থ হন। এসব রোগীর ৭০ শতাংশ সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের চিকিৎসায় জনপ্রতি গড়ে ৫০ হাজার টাকা ব্যয় হয়। সেই হিসাবে সরকারের ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় প্রায় ৪০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।

ডেঙ্গুতে পুরুষের প্রায় দ্বিগুণ নারীর মৃত্যু:

ডেঙ্গুতে নারীর মৃত্যু পুরুষের প্রায় দ্বিগুণ। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা অবহেলাকে দায়ী করছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ডেঙ্গুতে পুরুষরা বেশি আক্রান্ত হলেও নারীদের বেশি মৃত্যু হচ্ছে। মোট মৃত্যুর ৬৫ শতাংশই নারী।

মশক নিধনে তৎপরতার কথা বলছে এফবিসিসিআই-রিহ্যাব:

ডেঙ্গু মোকাবিলায় তৎপরতার কথা বলছে দেশের ভবন নির্মাতাদের সংগঠন রিয়েল স্টেটেড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) তারা বলছে, তাদের সদস্যদের নির্মাণাধীন ভবনে লার্ভা যাতে না জন্মায় সেজন্য তারা বেশ তৎপর। রিহ্যাব পরিচালক ড. ইঞ্জি. মাসুদা সিদ্দীক রোজী বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও মোকাবিলায় রিহ্যাব সবসময় তৎপর। আমাদের সদস্যদের একটি বার্তা দেওয়া আছে যে, এক থেকে দুদিনের মধ্যে যেন কোনো জমানো পানি না রাখা হয়। প্রতিদিন নির্মাণাধীন ভবনে ব্লিচিং পাউডার ছিটানো হয়। এর পরও যদি কোনো ভবনে লার্ভা পাওয়া যায়, তাহলে আমরা তাদের জরিমানা করে থাকি। অথচ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ জরিপ তথ্য বলছে, রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনে ১৮ দশমিক ২১ শতাংশ নির্মাণাধীন ভবনে এডিসের লার্ভা পওয়া গেছে। কলকারখানার স্বচ্ছ পানি থেকেও ডেঙ্গুর বিস্তারের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। অথচ এফবিসিসিআই পরিচালক প্রীতি চক্রবর্তী বলেন, সংগঠনের পক্ষ থেকে গত ২৫ জুলাই সদস্যের কাছে বার্তা পাঠানো হয়েছে যে, তারা যেন তাদের কারখানা, বাসাবাড়ি ও অফিসের পরিবেশন পরিচ্ছন্ন রাখেন। কোনোভাবেই এডিসের লার্ভা যেন জন্মাতে না পারে। সেইসঙ্গে নিজ উদ্যোগে তারা যেন এডিসের লার্ভা ধ্বংসে ভূমিকা রাখেন।

শিগগির জানা যাবে ডেথ রিভিউ; আগামী বছর বাড়তে পারে মৃত্যু:

ডেঙ্গুতে যাদের মৃত্যু হচ্ছে তাদের অনেকের দ্বিতীয়বার ডেঙ্গু। যারা দ্বিতীয়বার ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়, অন্যদের তুলনায় তাদের মৃত্যুঝুঁকি বেশি বলে মত বিশেষজ্ঞদের। তবে এখনো ডেথ রিভিউ প্রকাশ না পাওয়ায় এ বিষয়ে জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির বলেন, দেশে যে হারে ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে আগামী বছর আরও বেশি রোগী শক সিনড্রোমে যাবে। দ্বিতীয়বার ইনফেক্টেড রোগীরা দ্রুত শকে যাচ্ছে। এসব রোগী দুই থেকে তিন দিনের জ্বরে শকে যাচ্ছে। আগামী বছরে মৃত্যু আরও বাড়তে পারে। ডেথ রিভিউ নিয়ে বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ডেথ রিভিউ শুরু হয়েছে। আইইডিসিআর ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখায় ডেথ রিভিউ হচ্ছে। ইন্টারনালভাবে হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের জানানো হয়, যাতে করে তারা রোগীর চিকিৎসায় এসব অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারে। আগামী সপ্তাহ থেকে গণমাধ্যমেও ডেথ রিভিউর তথ্য জানানো হবে।

সচেতনতার প্রচার চালাচ্ছে আইসিটি ও তথ্য মন্ত্রণালয়:

তথ্য মন্ত্রণালয় দেশের ৬৮টি তথ্য অফিস থেকে ডেঙ্গুবিষয়ক প্রচারণা চালানোর দাবি করেছে। অন্যদিকে আইসিটি বিভাগ বলছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় তারা ডেঙ্গুবিষয়ক সচেতনতামূলক বিভিন্ন প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন অনু বিভাগ) মোহাম্মদ নাভিদ শফিউল্লাহ বলেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় আমরা ডেঙ্গু প্রতিরোধে করণীয় বিষয়ে বিভিন্ন উপায়ে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পলিসি এবং অপারেশন) মনীষ চাকমা বলেন, সারা দেশের প্রাথমিক স্কুলে আমরা কয়েক দফা নির্দেশনা দিয়েছি যাতে ডেঙ্গু বিষয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সচেতন করা হয়।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কালো তালিকাভুক্ত হলেন ৭১ শিক্ষক

দায়িত্ব নিয়েই হুঁশিয়ারি দিলেন সারোয়ার আলম

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আইআরআই’র প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বিএনপির বৈঠক

পাকিস্তানের সঙ্গে ভিসা অব্যাহতি চুক্তি অনুমোদন

জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ইসির রোডম্যাপ এ সপ্তাহে আর ঘোষণা হচ্ছে না

ভরা মৌসুমেও ইলিশ নেই, হতাশ জেলেরা

গাজীপুরে শ্রমিকদের বিক্ষোভ, মহাসড়ক অবরোধ

জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু করলেন তামিম

পেছনের পকেটে মানিব্যাগ রাখেন? অজান্তেই ডেকে আনছেন যে অসুখ

দিনাজপুরে পরিবেশবান্ধব উদ্ভাবন নিয়ে কর্মশালা

১০

মাকে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে ধরা পড়লেন চীনা গুপ্তচর

১১

নদীসংলগ্ন নিম্নাঞ্চল প্লাবিত ও ৬ বিভাগে ভারী বৃষ্টির শঙ্কা

১২

সাদাপাথর লুট, এবার তদন্তে মন্ত্রীপরিষদ বিভাগ

১৩

মালয়েশিয়া যাচ্ছেন নাহিদ ইসলাম

১৪

ছাত্র হত্যা মামলার আসামি ইউএনও রাহুল চন্দ ওএসডি 

১৫

ইবনে সিনায় চাকরি, বেতন ছাড়া পাবেন আরও বিভিন্ন সুবিধা

১৬

চট্টগ্রামের চকবাজারে ট্রান্সকম ডিজিটালের নতুন শোরুম উদ্বোধন

১৭

পুরুষদের নয়, পিতৃতন্ত্রকে অপছন্দ করি : বাঁধন

১৮

অনুভূতিহীন তথাকথিত কবি-শিল্পীরা ১৫ আগস্ট শোক জানিয়েছে : রিজভী

১৯

সুখবর পেলেন নারীঘটিত কেলেঙ্কারিতে ফেঁসে যাওয়া ক্রিকেটার

২০
X