দেশের ২১ জেলায় নতুন করে জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ দেবে সরকার। এসব জেলার ডিসিরা এরই মধ্যে পদোন্নতি পেয়ে যুগ্ম সচিব হয়েছেন। তাদের গত ঈদুল ফিতরের পরপরই তুলে আনার কথা ছিল। কিন্তু জনপ্রশাসনবিষয়ক কমিটির সিদ্ধান্তের বিলম্বের কারণে এখন পর্যন্ত ডিসি নিয়োগ দিতে পারেনি সরকার। ডিসি নিয়োগপ্রত্যাশী কর্মকর্তাদের আরও কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এপিডি (নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগ) অতিরিক্ত সচিব মো. এরফানুল হক কালবেলাকে বলেন, ডিসি নিয়োগের বিষয়টি জনপ্রশাসনবিষয়ক কমিটির ওপর নির্ভর করছে। তারাই বলতে পারবে কবে নাগাদ নিয়োগ হবে। তবে বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন বলে জানি।
দায়িত্বশীল আরেকজন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, সরকার জনপ্রশাসনে বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসকসহ যুগ্ম সচিব ও তদূর্ধ্ব পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের নিয়োগ, বদলি ও শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিষয়ে পরামর্শ প্রদানের জন্য চারজন উপদেষ্টা, মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং জনপ্রশাসন সচিবকে নিয়ে ‘জনপ্রশাসনবিষয়ক কমিটি’ করেছে। এ কমিটি গঠনের পর নিয়োগে একটু জটিলতা দেখা দিয়েছে।
কমিটির সদস্য মন্ত্রিপরিষদ সচিব দীর্ঘদিন বিদেশে ছিলেন। এরপর ২ মে থেকে ইতালি সফরে রয়েছেন কমিটির সভাপতি অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। ফলে তাদের অনুপস্থিতির কারণে নিয়োগ সংক্রান্ত কমিটির পরামর্শ সভা অনুষ্ঠিত হয়নি। এজন্য ডিসি নিয়োগে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। এর বাইরে বর্তমানে এসএসসি পরীক্ষা চলছে। পরীক্ষাকেন্দ্রিক ডিসিদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সামলাতে হচ্ছে। পরীক্ষা চলাকালীন নিয়োগ দেওয়া হলে নতুন ডিসিরা অনেক কিছু বুঝে উঠতে পারবেন না। এজন্য নতুন নিয়োগ হচ্ছে না।
অন্য একটি সূত্রের ভাষ্য, সামনে ঈদকেন্দ্রিক জেলা প্রশাসনকে অনেক কাজ করতে হবে। নতুন করে ডিসি নিয়োগ হলে তারা হঠাৎ করে মাঠে গিয়ে কাজ সামলাতে পারবেন না। এজন্য হয়তো সরকার একটু সময় নিচ্ছে। তবে নতুন ডিসি নিয়োগ হলে তারা খুব উৎসাহ নিয়েই ঈদকেন্দ্রিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখতে কাজ করতে পারবেন বলে মনে করছেন কেউ কেউ। তারা পরীক্ষা নিয়েও কাজ করতে পারবেন। এ মুহূর্তে নতুন ডিসি নিয়োগ দিলে কোনো সমস্যাই হবে না। তবুও সরকার কালক্ষেপণ করছে।
মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, নতুন করে ডিসি নিয়োগ দিতে বিসিএস প্রশাসন ২৫ ও ২৭তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে ফিটলিস্ট প্রস্তুত করেছে জনপ্রশাসন। গত ফেব্রুয়ারিতেই এই ফিটলিস্ট করা হয়। এ ফিটলিস্ট থেকে জনপ্রশাসনবিষয়ক কমিটির সুপারিশে ডিসি হবেন সৌভাগ্যবান কর্মকর্তারা, যারা প্রশাসন ক্যাডারের উপসচিব।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন সূত্র জানায়, ৫ আগস্টের পর ডিসি নিয়োগ নিয়ে নানা ঝামেলায় পড়েছিল সরকার। অনেকে নিজেদের ‘বঞ্চিত’ দাবি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে নজিরবিহীন কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন। তারা মারামারি ও হাতাহাতি পর্যন্ত করেছেন। এতে সরকারের ভাবমূর্তি ভীষণভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। আবার অনেকে বিগত আওয়ামী লীগের শাসনামলে ভালো ভালো দপ্তর-সংস্থায় চাকরি করেও ৫ আগস্টের পর ডিসি পদ বাগিয়ে নেন। অনেকেই পতিত আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী ছিলেন। তবুও তারা নতুন সরকার ও প্রশাসনে ডিসির মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে বসেছেন। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে এবং হচ্ছে। তাই এবার ডিসি নিয়োগে সরকার খুবই সতর্ক রয়েছে। ব্যাপক যাছাই-বাছাই চলছে। অর্থাৎ আওয়ামী সুবিধাভোগী কোনো কর্মকর্তাকে ডিসি করবে না সরকার। কেউ ছলচাতুরি বা তথ্য গোপন করে ডিসি হলে এবং পরে তা প্রমাণিত হলে তাদের ভবিষ্যৎ কর্মজীবন ‘ভালো’ হবে না।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর ১০৮ জনের ফিটলিস্ট তৈরি করা হয়। ওই লিস্ট থেকে ৬১ জেলায় ডিসি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ওই নিয়োগ ব্যাপক বিতর্ক তৈরি করেছিল। এরপর চলতি বছরের ১১ জানুয়ারি থেকে নতুন ফিটলিস্ট তৈরির কাজ শুরু করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তারা ছয় ধাপে বিসিএস প্রশাসন ২৫ ও ২৭তম ব্যাচের ২৬৯ জন উপসচিবের সাক্ষাৎকার নেয়। কতজনকে ফিটলিস্টে রাখা হয়েছে, তা জানা যায়নি। তবে কেউ কেউ বলেছেন, সর্বশেষ সাক্ষাৎকারগুলো থেকে অর্ধশতকের কিছু বেশি কর্মকর্তাকে ফিটলিস্টে রাখা হয়েছে।
বর্তমানে ২৪তম ব্যাচের ২৬ জন, ২৫তম ব্যাচের ২৫ জন এবং ২৭তম ব্যাচের ১৩ কর্মকর্তা ডিসির দায়িত্বে আছেন। এর মধ্যে ২৪তম ব্যাচের ২৬ জনের মধ্যে ২১ জন গত ২০ মার্চ পদোন্নতি পেয়ে যুগ্ম সচিব হন। ডিসি পদে উপসচিবরাই দায়িত্ব পালন করেন। পদোন্নতির পর যুগ্ম সচিবদের ডিসি পদে রাখা হয় না। তাদের মাঠ প্রশাসন থেকে তুলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়-বিভাগ ও অন্যান্য দপ্তর বা সংস্থায় পদায়ন করা হয়। তাই ২৪তম ব্যাচের ২১ যুগ্ম সচিবকে মাঠ থেকে তুলে আনবে সরকার। এরপর নতুন করে সেখানে ২৫ ও ২৭তম ব্যাচ থেকে ডিসি নিয়োগ দেওয়া হবে। এজন্য জনপ্রশাসনবিষয়ক কমিটির পরামর্শ সভা হতে হবে।
জনপ্রশাসন সূত্র জানায়, জনপ্রশাসনবিষয়ক কমিটির সভাপতি ও অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন গতকাল শুক্রবার ইতালি সফর শেষে দেশে ফিরছেন। হয়তো শিগগির ডিসি নিয়োগ নিয়ে সভা অনুষ্ঠিত হবে। তার পর নিয়োগ প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হবে।
মন্তব্য করুন