চার ধরনের অপরাধে যুক্ত থাকলে বিভাগীয় মামলা ছাড়াই চাকরি হারাবেন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সরকার চাইলে তদন্ত ছাড়াই মাত্র ৭ দিনের নোটিশে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরি থেকে অব্যাহতি দিতে পারবে। তবে অভিযুক্ত ব্যক্তি আপিল করলে আরও ৭ কার্যদিবসের মধ্যে এর নিষ্পত্তি করবে সরকার। অর্থাৎ সর্বমোট ১৪ কার্যদিবসেই চাকরি হারাবেন অপরাধী কর্মচারী-কর্মকর্তারা। এমন বিধান যুক্ত করে সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। গতকাল বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের ২৯তম বৈঠকে এ অধ্যাদেশের খসড়ায় অনুমোদন দেওয়া হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
অন্যদিকে একটি সূত্র বলছে, বর্তমান সরকারি চাকরি আইন ২০১৮ অনুযায়ী যে কোনো কর্মচারী-কর্মকর্তার চাকরির বয়স ২৫ বছর পূর্ণ হলে তাকে সরকার চাইলে জনস্বার্থে বাধ্যতামূলক অবসর দিতে পারে, সেই ধারাটি সংশোধিত অধ্যাদেশে বাতিল করা হচ্ছে। কর্মকর্তারা বলছেন, গুরুতর অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়ানো কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দ্রুত শাস্তির আওতায় এনে প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরাতেই এ কঠোর বিধান আনা হচ্ছে। তবে সংশোধনটি ঘিরে উঠেছে নানা প্রশ্ন ও মতবিরোধ। কেউ বলছেন, এটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ, আবার কেউ এটিকে কর্মীদের বিরুদ্ধে চাপে রাখার হাতিয়ার হিসেবে দেখছেন।
উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন মিললেও সরকারি চাকরি আইনে আসলে কী সংশোধন আনা হয়েছে, তা স্পষ্টভাবে জানতে পারেনি কালবেলা। তবে একাধিক সূত্র জানিয়েছে, যদি কোনো কর্মচারী এমন কোনো কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হন, যার কারণে অন্য যে কোনো সরকারি কর্মচারীর মধ্যে অনানুগত্য সৃষ্টি করে বা শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করে বা কর্তব্য সম্পাদনে বাধার সৃষ্টি করে, তাহলে তিনি চাকরি হারাবেন।
অন্য কর্মচারীদের সঙ্গে সমবেতভাবে বা এককভাবে ছুটি ছাড়া বা কোনো যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া নিজ কর্ম থেকে অনুপস্থিত থাকেন বা বিরত থাকেন বা কর্তব্য সম্পাদনে ব্যর্থ হন, তাহলে তিনি শাস্তির আওতায় আসবেন। অন্য যে কোনো কর্মচারীকে তার কর্ম থেকে অনুপস্থিত থাকতে বা বিরত থাকতে বা তার কর্তব্য পালন না করার নিমিত্তে উসকানি দেন বা প্ররোচিত করেন, তাহলেও তিনি চাকরি হারাবেন। এ ছাড়া যে কোনো সরকারি কর্মচারীকে তার কর্মে উপস্থিত হতে বা কর্তব্য সম্পাদনে বাধাগ্রস্ত করেন, তাহলে তিনি অসদাচরণের দায়ে দণ্ডিত হবেন।
সূত্র জানায়, দোষী কর্মচারীকে নিম্নপদ বা নিম্ন বেতন গ্রেডে অবনমিতকরণ কিংবা চাকরি থেকে অপসারণ অথবা চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে পারবে সরকার।
গতকাল উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের পর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের ভেটিং সাপেক্ষে ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন করা হয়েছে।
এদিকে, সংশোধিত চাকরি আইন নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন কর্মচারীরা। সংশোধিত আইনকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হিসেবে উল্লেখ করেছেন আন্তঃমন্ত্রণালয় কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা। তারা বলেছেন, এ আইন জারি হলে দেশ ও জাতির সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে কর্মচারীদের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা সংকুচিত হবে। কিছু স্বার্থবাদী কর্মকর্তার কাছে কর্মচারীরা ব্যক্তিগত দাসত্বে পরিণত হবে। ক্ষমতার অপব্যবহার বেশি হবে। বিভিন্ন কারণে অপছন্দের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কর্মক্ষেত্রে নাজেহাল হবে। চাকরি হারানোর সুযোগ তৈরি হবে। ভয়ভীতির কারণে সরকারি কাজের পরিবেশ বিঘ্নিত হবে। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা ব্যক্তিতন্ত্রে পরিণত হবে।
আন্তঃমন্ত্রণালয় কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশনের সমন্বয়ক মো. নজরুল ইসলাম বলেন, সরকারের সহায়তাকারী জনশক্তিকে পেশাগত উৎকর্ষ ও বিকশিত করার স্বার্থে সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর খসড়া অবিলম্বে বাতিল করা প্রয়োজন।
তিনি আরও বলেন, অনুমোদিত খসড়া আইনটি সংবিধানের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক ও পরস্পর বিপরীতমুখী। কেননা, সংবিধানের অনুচ্ছেদ-১৯-এর সুযোগের সমতা বিনষ্ট হবে; অনুচ্ছেদের ২১-এর নাগরিক ও সরকারি কর্মচারীদের কর্তব্য পালনে বিঘ্ন সৃষ্টি হবে; অনুচ্ছেদের ২৭-এর আইনের দৃষ্টিতে সমতার ভারসাম্য বিনষ্ট হবে; অনুচ্ছেদের ৩১-এর আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার ক্ষুণ্ন হবে; অনুচ্ছেদের ৩৭-এর সমাবেশের স্বাধীনতা থাকবে না, অনুচ্ছেদে ৩৯-এর প্রজাতন্ত্রে নিয়োজিত কর্মচারীদের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হবে।
গতকাল উপদেষ্টা পরিষদের সভায় ‘দ্য প্রটেকশন অ্যান্ড কনজারভেশন অব ফিশ (অ্যামেন্ডমেন্ট) অর্ডিন্যান্স, ২০২৫’-এর খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার এবং আহত ছাত্র-জনতার কল্যাণ ও পুনর্বাসন অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর খসড়া নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদনও দেওয়া হয়েছে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে। উপদেষ্টা পরিষদের সভায় সংস্কার কমিশনের সুপারিশের মধ্যে আশু বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশগুলোর বিষয়ে দিকনির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।
মন্তব্য করুন