বীর সাহাবী
প্রকাশ : ৩০ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ৩০ জুন ২০২৫, ০৩:৩৭ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

পুঁজিবাজারে সালমান সাম্রাজ্যে ধস

সব কোম্পানির শেয়ার তলানিতে
সালমান
ছবি : সংগৃহীত

গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পতন হওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ছিলেন পুঁজিবাজারের অঘোষিত ‘সম্রাট’। তিনি তার অদৃশ্য শক্তির মাধ্যমে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করতেন পুঁজিবাজারে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) মাধ্যমে তার অধীন বিভিন্ন কোম্পানিতে নিতেন পছন্দ অনুযায়ী বিশেষ সুবিধা। কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে অনিয়মকেই নিয়মে পরিণত করতেন সালমান এফ রহমান।

সালমানের স্বেচ্ছাচারিতা দেখে শুরুতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা বেক্সিমকোর ফুলেফেঁপে ওঠা শেয়ারে বিনিয়োগের বিষয়ে ইতস্তত করছিলেন। অতিউচ্চ মুনাফার সুকুক বন্ডের বিষয়েও তারা ছিলেন দ্বিধাগ্রস্ত। অভিযোগ রয়েছে, এসব বিনিয়োগকারীর অনেককেই সুকুক কিনতে চাপ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসির মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকেও চাপ দিয়ে সুকুক বন্ড কিনতে বাধ্য করেন সালমান।

গত বছরের ১৩ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালানের সময় গ্রেপ্তার হন সালমান এফ রহমান। শেখ হাসিনা সরকারের পতন ও সালমানের গ্রেপ্তার—এরপর ধসে পড়তে থাকে সালমান সাম্রাজ্য। শ্রমিক অসন্তোষ, কারখানা বন্ধ থেকে শুরু করে কর্মী ছাঁটাই—ভরাডুবির কোনোকিছুই আর বাদ যায়নি। তবে যে পুঁজিবাজারের মাধ্যমে তিনি তার কোম্পানিগুলোতে বিশেষ সুবিধা নিয়ে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বড় করে তুলেছিলেন, দিনশেষে সেই কোম্পানিগুলোই এখন অতল গহ্বরে ডুবে যাচ্ছে। বিশাল অঙ্কের ব্যাংক ঋণের পাশাপাশি লোকসান গুনছে কোম্পানিগুলো।

রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো গ্রুপ ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বিভিন্ন বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে বাজার থেকে প্রায় হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করে। জানা গেছে, ব্যাংকসহ একাধিক প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীকে বন্ডে বিনিয়োগ করতে চাপ দেওয়া হয়েছিল। ২০২৩ সালের জুলাই মাসে বিএসইসি শ্রীপুর টাউনশিপের ১ হাজার কোটি টাকার বন্ড ইস্যুর অনুমোদন দেয়। যেখানে আইএফআইসি ব্যাংক গ্যারান্টর হিসেবে কাজ করে। সালমানের পতনের পর শ্রীপুর টাউনশিপ প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়ে যায়।

এদিকে বেক্সিমকো গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন তিনটি কোম্পানির মধ্যে দুটির আর্থিক পরিস্থিতি বেশ নাজুক। অপর একটির অবস্থা ভালো হলেও কোম্পানিটির শেয়ারের ওপর থেকে আস্থা হারাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। বাকি দুটি কোম্পানিও ব্যাপক লোকসানের পাশাপাশি শেয়ারদর হারাচ্ছে।

কোম্পানি দুটি ঋণের ভারেও নুব্জ্য হয়ে পড়েছে।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বেক্সিমকো গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন কোম্পানি হচ্ছে বেক্সিমকো লিমিটেড, বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস এবং শাইনপুকুর সিরামিকস। এর মধ্যে বেক্সিমকো লিমিটেড দীর্ঘদিন ধরে ফ্লোর প্রাইসে আটকে থাকায় শেয়ার লেনদেন হচ্ছে না। এ কারণে কোম্পানিটির শেয়ারের অবমনন বোঝা যাচ্ছে না। বাকি দুটি কোম্পানির শেয়ারদর ধারাবাহিকভাবে কমছে। এমন পরিস্থিতিতে বিপাকে পড়েছেন বিনিয়োগকারীরা।

এরই মধ্যে বেক্সিমকো লিমিটেড তাদের সহযোগী কয়েকটি কোম্পানি বন্ধ ঘোষণা করে। এগুলো হচ্ছে বেক্সিমকো লিমিটেড ইয়ার্ন-২, টেক্সটাইল, ডেনিম ও নিটিং। এসব কোম্পানির কর্মী ছাঁটাই করা হয়। যা বেক্সিমকো গ্রুপ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জকে (ডিএসই) জানিয়ে দেয়। এ অবস্থায় বেক্সিমকোর ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা দেখা দেয়।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ কালবেলাকে বলেন, বেক্সিমকোর মূল কোম্পানিকে ফ্লোর প্রাইস উঠিয়ে দেওয়া উচিত। তাহলে হয়তো কিছুটা ক্ষতি কমে আসবে। ফ্লোরটা উঠিয়ে দিলে সুকুক থেকে কনভার্ট করে যারা বেরিয়ে যেতে চান তারা বেরিয়ে যাবেন। পুঁজিবাজারে একমাত্র কোম্পানি হচ্ছে বেক্সিমকো, যেটা এখনো ফ্লোর প্রাইসে আটকে আছে।

বছরের ব্যবধানে তলানিতে শেয়ারদর: বেক্সিমকো গ্রুপের তিনটি কোম্পানির শেয়ারদর এক বছরের ব্যবধানে ব্যাপক কমেছে। মূলত রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আরও দুর্বল হতে শুরু করে কোম্পানিগুলোর আর্থিক অবস্থা। এ অবস্থায় প্রভাব পড়ে কোম্পানিগুলোর শেয়ারদর এবং মুনাফার ওপর। শেয়ারদর কমার পাশাপাশি কোম্পানিগুলো ব্যাপক লোকসান গুনতে শুরু করে।

কোম্পানিগুলোর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২৩ সাল থেকে বেক্সিমকোর শেয়ার ফ্লোর প্রাইসে আটকে আছে। সে সময় কোম্পানিটির শেয়ার ১১৫ টাকা ৬০ পয়সা দরে শেষ লেনদেন হয়। এরপর গত বছরের নভেম্বর কোম্পানিটির শেয়ার লেনদেন হতে দেখা যায়। সে সময় এক লাফে ১১৫ টাকা থেকে কমে ১১০ টাকায় নেমে যায়। এরপর আর তার লেনদেন হয়নি। এ অবস্থায় দীর্ঘদিন ধরে চলছে।

গ্রুপটির আরেক কোম্পানি বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের শেয়ারদর গত বছরের জুলাইয়ে ছিল ১২৫ টাকা। সেই দর কমতে কমতে মঙ্গলবার নেমেছে ৮৩ টাকায়। এ ছাড়া মাঝে অক্টোবরে কোম্পানিটির শেয়ারদর সর্বনিম্ন নেমেছিল ৬৫ টাকায়।

শাইনপুকুর সিরামিকসের শেয়ারদরও গত বছরের জুলাইয়ের দিকে ছিল ৩৮ টাকার কিছুটা বেশি। অক্টোবরের দিকে তা সর্বনিম্ন ১০ টাকায় নেমে যায়। এরপর আবার কিছুটা বেড়ে সবশেষ ২০ টাকায় উঠেছে।

লোকসান ভারি হচ্ছে বেক্সিমকো-শাইনপুকুরে: চলতি হিসাব বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) বেক্সিমকো লিমিটেড শেয়ারপ্রতি লোকসান করে ২ টাকা ৫৮ পয়সা; নিট লোকসান ২৪৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। যেখানে আগের হিসাব বছরের একই সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি মুনাফা ছিল ৮২ পয়সা বা ৭৭ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। এই লোকসান ৬ মাসের হিসাবে আরও বেড়ে যায়। জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি লোকসান হয় ৩ টাকা ৭৮ পয়সা বা ৩৫৬ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। আগের হিসাব বছরের একই সময়ে যা ছিল ২ কোটি ৮৩ লাখ টাকা মুনাফা।

একই অবস্থা শাইনপুকুর সিরামিকসের। দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর ডিসেম্বর) শাইনপুকুরের শেয়ারপ্রতি লোকসান ১ টাকা ১ পয়সা। নিট লোকসান ১৪ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। যেখানে আগের হিসাব বছরের একই সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি মুনাফা ছিল ১ পয়সা বা ১৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা। ৬ মাসের হিসাবে শাইনপুকুরের শেয়ারপ্রতি লোকসান হয় ১ টাকা ৩৫ পয়সা। নিট লোকসান ১৯৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা।

এই দুটি কোম্পানি লোকসান করলেও গ্রুপটির আরেক কোম্পানি বেক্সিমকো ফার্মার মুনাফা হয়েছে। কোম্পানিটির চলতি হিসাব বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) শেয়ারপ্রতি মুনাফা হয়েছে ৪ টাকা ১০ পয়সা। নিট মুনাফা ১৮২ কোটি ৯১ লাখ টাকা। আগের হিসাব বছরের একই সময়ে শেয়ারপ্রতি মুনাফা ছিল ৩ টাকা ২১ পয়সা বা ১৪৩ কোটি ২০ লাখ টাকা।

ঋণের ভারে ন্যুব্জ: কোম্পানিগুলো একদিকে আর্থিক লোকসান করছে এবং অন্যদিকে ঋণের ভারে ন্যুব্জ হয়ে আছে। ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে বেক্সিমকো লিমিটেড। কোম্পানিটি বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে স্বল্পমেয়াদি ঋণ নিয়েছে ৩ হাজার ১০৯ কোটি টাকা এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নিয়েছে ৩ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা। এর পরের অবস্থানে রয়েছে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস। কোম্পানিটি বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে স্বল্পমেয়াদি ঋণ নিয়েছে ৪২৭ কোটি টাকা এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নিয়েছে ১৭৬ কোটি টাকা। বেক্সিমকোর আরেক কোম্পানি শাইনপুকুর সিরামিকস স্বল্পমেয়াদি ঋণ নিয়েছে ৯৮ কোটি টাকা এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নিয়েছে ৯৬ লাখ টাকা। শিল্প গ্রুপটির তালিকাভুক্ত তিন সহযোগী কোম্পানির স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি মিলিয়ে মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ১৫০ কোটি ৭৭ লাখ টাকা।

কোম্পানির সার্বিক বিষয়ে জানতে বেক্সিমকো, বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস এবং শাইনপুকুর সিরামিকসের কোম্পানি সচিব মোহাম্মদ আসাদউল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি কোনো সাড়া দেননি। ফলে তার বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল আমিন কালবেলাকে বলেন, সুকুক বা অন্যান্য বন্ড ইস্যু—সবই করেছে কারসাজি (ম্যানুপুলেট) করে। বেক্সিমকোর ব্যাংকের যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ সেটা আরও অনেক বেশি। আমরা জেনেছি, শুধু জনতা ব্যাংকেই বেক্সিমকোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি। সবকিছুই তারা করেছে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সবার সহযোগিতা চাইলেন নাহিদ

রাজস্ব আদায়ে হোঁচট, এ অর্থবছরে রাজস্ব এলো যত

চটেছেন মিষ্টি জান্নাত

বরিশালে দুই ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষ, নিহত ২

আবারো পরমাণু কেন্দ্রে নির্মাণকাজ শুরু করেছে ইরান

সমকামিতার দায়ে চাকরি গেল ইবি শিক্ষকের

সোনার খনিতে ভয়াবহ ধস, ১১ শ্রমিক নিহত

জবিতে ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ-পরবর্তী প্রভাব বিষয়ে আলোচনা সভা

হেরা ফেরি থ্রি’তে ফিরছেন পরেশ রাওয়াল

উত্তরায় ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের নতুন ক্যাম্পাস উদ্বোধন

১০

ভাইকে ভর্তি নেয়নি হাসপাতাল, মৃত্যুর পর মাহির ক্ষোভ

১১

ঢাকাস্থ ইরান দূতাবাসে শোক বইয়ে জামায়াতের স্বাক্ষর

১২

শুরু হলো এআইইউবি ইন্টার কলেজ ক্রিকেট চ্যাম্পিয়নশিপ

১৩

রূপগঞ্জে সেনাবাহিনীর ভুয়া মেজর গ্রেপ্তার

১৪

‘গণতান্ত্রিক পদযাত্রায় শিশু’ অনুষ্ঠান বাস্তবায়নে কমিটি গঠন

১৫

জুলাই স্মরণে ২০২৪ শিক্ষার্থীর জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনন্য উদ্যোগ

১৬

ছেলের বন্ধুকে বিয়ে করলেন ৫০ বছরের নারী, দিলেন সুসংবাদ

১৭

নেতৃত্বের অভিযাত্রা : ম্যানেজার থেকে নির্বাহী হিসেবে রূপান্তর

১৮

মেন্টরস স্টাডি এব্রোডের আয়োজনে স্টাডি ইন অস্ট্রেলিয়া এক্সপো

১৯

ঝর্ণায় পিছলে খাদে ৬ নারী, অতঃপর...

২০
X