রাজকুমার নন্দী
প্রকাশ : ৩০ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ৩০ জুন ২০২৫, ০৭:৪৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

‘পিআর’ ইস্যুতে মিত্রদের পাশে চায় বিএনপি

১২ দল ও সমমনা জোটের সঙ্গে বৈঠক
বিএনপি
ছবি : সংগৃহীত

পিআর বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে নয়, বিদ্যমান ব্যবস্থাতেই জাতীয় নির্বাচন চায় বিএনপি। তবে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ আরও বেশ কয়েকটি দল পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চাওয়ায় কোন পদ্ধতিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, তা নিয়ে এক ধরনের জটিলতা তৈরি হয়েছে। এমন অবস্থায় এই ইস্যুতে ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের মিত্রদের পাশে চায় বিএনপি। দলটির প্রত্যাশা, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে নির্বাচনের ‘পিআর পদ্ধতি’ নিয়ে আলোচনা হলে শরিকরা যেন তাদের সঙ্গে একই সুরে কথা বলে। গত শুক্রবার রাজধানীর গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে ১২ দলীয় জোট নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বিএনপির পক্ষ থেকে এমন প্রত্যাশা ও গাইডলাইন দেওয়া হয়েছে বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে।

বৈঠকে বিএনপির পক্ষে ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান ও সালাহউদ্দিন আহমেদ। অন্যদিকে ১২ দলীয় জোট প্রধান ও জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দারের নেতৃত্বে ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় দলের সৈয়দ এহসানুল হুদা, জমিয়তের গোলাম মহিউদ্দিন ইকরাম, ন্যাশনাল লেবার পার্টির লায়ন মো. ফারুক রহমান, জাগপার রাশেদ প্রধান, বাংলাদেশ এলডিপির তমিজ উদ্দিন টিটু প্রমুখ।

বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবনা নিয়ে ঐকমত্য তৈরিতে বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এমন অবস্থায় আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠক ঘিরে সংস্কার প্রশ্নে যুগপতের শরিকদের সঙ্গে কোনো ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হোক, সেটা বিএনপি চায় না। দলটির প্রত্যাশা, আওয়ামী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যেভাবে তারা ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথে যুগপৎ আন্দোলন করেছিল, সংস্কার ইস্যুতেও যেন তারা সেভাবে একই সুরে কথা বলেন।

জানা গেছে, বৈঠকে নির্বাচনের পিআর পদ্ধতি, সংসদে নারী আসন এবং জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) নিয়ে দলীয় অবস্থান তুলে ধরে বিএনপি। জোট নেতাদের দলটি বলেছে, তারা পিআর পদ্ধতির বিপক্ষে। বাংলাদেশে আনুপাতিক হারে নির্বাচনের কোনো ইতিহাস নেই। সংসদীয় রাজনীতি বা সংসদীয় নির্বাচনের ইতিহাস নেই। বাংলাদেশের রাজনৈতিক কালচারে সেটা একটা নতুন আইডিয়া। তবে সেটা আমাদের দেশের জন্য প্রযোজ্য ও উপযুক্ত নয়। যেখানে প্রযোজ্য আছে, সেখানেও অনেক জটিল অবস্থা। আনুপাতিক হারে নির্বাচনের ক্ষেত্রে কোনো সংসদীয় এলাকার ভোটাররা জানবেন না যে, কে তাদের এমপি হবেন। তা ছাড়া এমপির কাছে যে যাবেন, সেজন্য তারা নির্ধারিত কোনো ব্যক্তিকে খুঁজে পাবেন না। আনুপাতিক হারের নির্বাচনের কথা যারা বলছেন, তাদের একটি উদ্দেশ্য আছে। হয় নির্বাচন বিলম্বিত করা অথবা বাংলাদেশে নির্বাচন না হওয়া—এটা তাদের উদ্দেশ্য থাকতে পারে। আনুপাতিক হারে নির্বাচন বিএনপি অনেক আগেই প্রত্যাখ্যান করেছে।

প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ প্রশ্নে বিএনপির অবস্থান হচ্ছে, একজন ব্যক্তি তার জীবদ্দশায় সর্বোচ্চ ১০ বছর (দুই পূর্ণ মেয়াদ) প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন। তবে সাংবিধানিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেওয়ার জন্য জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের (এনসিসি) মতো প্রতিষ্ঠান গঠনের সঙ্গে তারা একমত নয়। এটিকে তারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে করে। এ ছাড়া সংসদে নারীদের জন্য ১০০ আসন বিষয়ে বিএনপি এরই মধ্যে একমত পোষণ করেছে। তবে তাদের নির্বাচিত হওয়ার পদ্ধতি কী হবে, সে বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি দলটি।

বৈঠক প্রসঙ্গে জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) সহসভাপতি ও দলীয় মুখপাত্র রাশেদ প্রধান কালবেলাকে বলেন, বৈঠকে বিএনপির পক্ষ থেকে আগামীর বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে অতীতের মতোই একসঙ্গে চলার আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। একই সঙ্গে ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের মতো ঐকমত্য কমিশনেও সংস্কারের বিভিন্ন ইস্যুতে যুগপতের শরিকরা যাতে বিএনপির সঙ্গে একসুরে কথা বলে, এ ব্যাপারে একটা গাইডলাইন দেওয়া হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বৈঠকে আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে আসন বণ্টনের বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। আশা করি, আগামীতে এ ব্যাপারে আলোচনা হবে।

মিত্রদের ‘যথোপযুক্ত’ মূল্যায়নের আশ্বাস : যুগপৎ আন্দোলনে থাকা শরিকদের ‘যথোপযুক্ত’ মূল্যায়নের আশ্বাস দিয়েছে বিএনপি। আগামী নির্বাচনে তাদের ‘যৌক্তিক’ সংখ্যক আসন ছেড়ে দেবে। তবে সার্বিক বিবেচনায় যাদের ‘ধানের শীষ’ দেওয়া সম্ভব হবে না, তাদের অন্যভাবে মূল্যায়ন করা হবে। এ ক্ষেত্রে ‘যোগ্যতা’ ও ‘গ্রহণযোগ্যতা’ অনুযায়ী তাদের কাউকে কাউকে সংসদের উচ্চকক্ষেও স্থান দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা রয়েছে দলটির। গত মঙ্গলবার গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বিএনপির পক্ষ থেকে দলের এমন অবস্থান ও চিন্তা-ভাবনার কথা জানানো হয়েছে বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে।

বিএনপি ঘোষিত ৩১ দফায় দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের কথা রয়েছে। ৬নং দফায় বলা হয়েছে, বিদ্যমান সংসদীয় ব্যবস্থার পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের সমন্বয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার লক্ষ্যে দেশের বিশিষ্ট নাগরিক, প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে সংসদে ‘উচ্চকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা’ প্রবর্তন করা হবে।

বৈঠকে বিএনপির পক্ষে ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, সালাহউদ্দিন আহমেদ এবং ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টু। অন্যদিকে জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের আহ্বায়ক ও এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদের নেতৃত্বে ছিলেন জাগপার খন্দকার লুৎফর রহমান, গণদলের গোলাম মাওলা চৌধুরী, এনডিপির কারী আবু তাহের, ডেমোক্রেটিক লীগের খোকন চন্দ্র দাস ও বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক পার্টির এস এম শাহাদাত।

জানা গেছে, বৈঠকে আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে আসন বণ্টনের বিষয়টিও আলোচনায় উঠে আসে। বিএনপি নেতারা বলেছেন, সংস্কার এবং বিচার কার্যক্রম আরও কিছুটা সামনে এগোলে অর্থাৎ ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণার পর এই বিষয়টি নিয়ে মিত্রদের সাথে আলাপ-আলোচনা শুরু হবে। আপাতত তারা বিচার এবং সংস্কার কার্যক্রম নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে।

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গত বছরের ২২ অক্টোবর যুগপতের শরিক জোটের ছয় নেতাকে নিজ নিজ এলাকায় জনসংযোগসহ সাংগঠনিক কার্যক্রমে সহযোগিতা করার জন্য ছয়টি জেলায় দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে ‘অতীব জরুরি’ নির্দেশনাসংবলিত চিঠি দেয় বিএনপি। ওই ছয় নেতা হলেন জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর ও সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান এবং বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা। এই চিঠিকে তখন কেউ কেউ ‘ধানের শীষের প্রাথমিক মনোনয়ন’ হিসেবে দেখতে থাকেন। এ নিয়ে জোটের অন্য শরিকদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে পরে ৬৪ জেলাতেই একই চিঠি দেয় বিএনপি। এ ছাড়া বিএনপির পক্ষ থেকে তখন বলা হয়, এই চিঠি বিএনপির প্রাথমিক মনোনয়ন নয় কিংবা মনোনয়নের কোনো নিশ্চয়তাও নয়।

সমমনা জোটের বৈঠকের আলোচনার একপর্যায়ে গত বছর তৃণমূলে দেয়া বিএনপির এই চিঠি বিশেষ করে প্রথমে দেয়া জোটের ছয় নেতার চিঠির বিষয়টি উঠে আসে। বিএনপির পক্ষ থেকে তখন বলা হয় শুধু ছয়জন নয়, ৬৪ জেলাতেই তো তখন এই কমন চিঠি দেয়া হয়েছিল। এই চিঠি মনোনয়নের কোনো নিশ্চয়তা নয়। সুতরাং এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। আগামীতে যুগপতের মিত্রদের ‘যথোপযুক্ত’ মূল্যায়ন করা হবে। এ সময় দলটির পক্ষ থেকে পুনরায় প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় যে, ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে থাকা মিত্রদের নিয়েই বিএনপি আগামীতে নির্বাচন করবে এবং মিত্ররা সরকারেও থাকবে।

বিএনপি ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে মিত্রদের ৫৯টি আসন ছেড়ে দিয়েছিল। তবে সবকিছু মিলিয়ে এবার যুগপৎ আন্দোলনে থাকা শরিকদের সর্বোচ্চ অর্ধশত আসনে ছাড় দিতে পারে দলটি। মূলত ‘বিজয়ী হতে সক্ষম’ এবং ‘গ্রহণযোগ্যতা’ রয়েছে, শরিকদের মধ্যে এমন প্রার্থীদের গুরুত্ব দেবে বিএনপি। অবশ্য প্রার্থী দুর্বল হলেও জোটের ঐক্যের স্বার্থেও মিত্রদের কিছু আসন ছেড়ে দেবে বিএনপি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সাতক্ষীরা প্রেস ক্লাবে সাংবাদিকদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা, আহত ৩০

এনসিপির নেতৃত্বে মুরাদনগরে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করা হচ্ছে : কায়কোবাদ 

চালের বস্তায় এখনো শেখ হাসিনার নামসহ স্লোগান

ভয়ে আসেননি বর, পালিয়ে গেলেন কনেপক্ষ

সপ্তাহজুড়ে সারা দেশে বজ্রবৃষ্টির আভাস 

খুঁটিতে বেঁধে শিক্ষককে মারধর, ভিডিও ভাইরাল

নিয়োগ দেবে ইউএস-বাংলা

বাবাকে হত্যার দায়ে ছেলে গ্রেপ্তার

বন্ধুত্ব আরও গভীর করার প্রতিশ্রুতি উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়ার

ড্রাফটের আগেই ৬ বিদেশি তারকাকে দলে নিয়েছে ফরচুন বরিশাল!

১০

বিশ্বমঞ্চে নিজের শেষ ম্যাচ কি খেলে ফেললেন মেসি?

১১

এনটিআরসিএ কার্যালয়ের সামনে চাকরিপ্রত্যাশীদের ফের অবস্থান

১২

চাঁদে আঘাত করতে আসছে বিরল এক গ্রহাণু

১৩

মঙ্গলবার ব্যাংকের লেনদেন বন্ধ

১৪

প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কের নতুন অধ্যায় শুরু করতে প্রস্তুত ইরান

১৫

বিদায়ী বার্তায় পিএসজিকে প্রশংসায় ভাসালেন মেসি

১৬

‘আমাদের বাংলাদেশের আলিয়া ভাট’

১৭

ফেব্রুয়ারিতেই হবে জাতীয় নির্বাচন : আমিনুল হক

১৮

গাজীপুরে কারখানায় ডাকাতির ঘটনায় গ্রেপ্তার ৩

১৯

ভুয়া দুদকে বিব্রত দুদক

২০
X