আমেনা হীরা
প্রকাশ : ২৫ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৫ জুলাই ২০২৫, ০৭:৩৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

এআই কনটেন্ট ঝুঁকিতে দেশ

প্রযুক্তির অপব্যবহার
এআই কনটেন্ট ঝুঁকিতে দেশ

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে অপতথ্য দিয়ে তৈরি করা ছবি ও ভিডিও বাংলাদেশে বড় ঝুঁকি তৈরি করেছে। রাজনৈতিক নেতা, নারীনেত্রী, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন মহলের মানহানি ঘটাচ্ছে এসব কনটেন্ট। বিশেষ করে নারীরা এআই প্রযুক্তির অপব্যবহারের শিকার হচ্ছেন সবচেয়ে বেশি। আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও এআই প্রযুক্তির ব্যবহার করে তৈরি করা অপতথ্য সংবলিত নানা ভিডিও এবং ছবি বড় ধরনের বিভ্রান্তি ছড়াতে পারে। ওইসব বিভ্রান্তি থেকে ভয়ানক মব ভায়োলেন্সেরও আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাস্তবতা হচ্ছে, এআইর অপব্যবহার ঠেকাতে সরকার এখন পর্যন্ত পর্যাপ্ত কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। গ্রহণ করেনি প্রতিরোধমূলক পর্যাপ্ত ব্যবস্থাও। জবাবদিহির আওতায় আনা যাচ্ছে না কনটেন্ট তৈরি ও ছড়িয়ে দেওয়া ব্যক্তিদের।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার তথ্য ও প্রযুক্তি সংক্রান্ত বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব কালবেলাকে বলেন, ‘এআই প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধে সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টে নির্দেশনা দেওয়া আছে। বাংলাদেশের পুলিশসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো চাইলে ওই আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারে।’ সামগ্রিকভাবে সব জনগোষ্ঠীকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব নয় উল্লেখ করে ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, ‘এ বিষয়ে সরকারের করণীয় কিছু নেই। ইতোপূর্বে আমরা দেখেছি বিগত সরকারের সময়ে তারা মেটা ও ইউটিউবকে বিভিন্ন কনটেন্ট এবং আইডির বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেছে। মেটা ও ইউটিউব কোনোটা শুনেছে আবার কোনটা শোনেনি। ফেসবুক সরকারের সব কথা শোনে না। আমরা মেটা বা ইউটিউবকে সে রকম কোনো অনুরোধও করছি না। মেটার সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। আমরা সেখানে মেটাকে কমিউনিটি গাইডলাইন কঠোরভাবে অনুসরণ করতে বলেছি। আমরা বলেছি—যদি কোনো কনটেন্ট তাদের কমিউনিটি গাইডলাইন অনুযায়ী না হয়, সেটা যাতে অপসারণ করে। মেটা বা ফেসবুক এসব খাতে বিনিয়োগ করতে চায় না। তার পরও তাদের আমরা অনুরোধ করেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে ডিজিটাল লিটারেসি অনেক কম; তাই এআই সৃষ্ট কনটেন্টগুলো মানুষ সহজে বিশ্বাস করে। সাধারণ মানুষের ডিজিটাল লিটারেসি বাড়লে মানুষ সেগুলো বিশ্বাস করবে না।’

পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, গত ২১ জুলাই ঢাকার উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনা, শুধু একটি দুর্ঘটনা নয়, বরং তা হয়ে উঠেছে জাতীয় শোক। এই শোকের মধ্যেও প্রযুক্তিগত অপপ্রচারের মাধ্যমে নানান বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াতে থাকে স্যোশাল মিডিয়ায়। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি এফটি-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমান যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে স্কুল ভবনে বিধ্বস্ত হয়। দুর্ঘটনার সময় ক্লাস চলছিল, শিশুরা মাঠে খেলছিল, কেউ কেউ সন্তানদের নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল। যুদ্ধবিমানটি বিধ্বস্তের মুহূর্তেই দাউদাউ আগুন ছড়িয়ে পড়ে পুরো স্কুলে, কালো ধোঁয়ায় ঢেকে যায় আকাশ। কান্না, আতঙ্ক, ছোটাছুটি সব মিলিয়ে যেন এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি। এই হৃদয়বিদারক ঘটনার পরপরই সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু ভিডিও ভাইরাল হয়, যেখানে দাবি করা হয় ‘কীভাবে এয়ারক্রাফটি কলেজে বিধ্বস্ত হয়েছিল।’ ওইসব ভিডিও এতটাই স্পষ্ট, এতটাই নাটকীয় যে, অনেকেই তা বিশ্বাস করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থা রিউমার স্ক্যানার নিশ্চিত করে ভিডিওগুলো আসলে গুগলের ভিইও-এআই টুল দিয়ে তৈরি একটি কল্পিত দৃশ্য। ভিডিওতে ‘মাইলস্টোন’ বানান ভুল, ভবনের গঠন মূল ঘটনার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। এটি ছিল একটি এআই সৃষ্ট বিভ্রান্তি, যা একটি হৃদয়বিদারক বাস্তবতাকে বিকৃত করে জনমনে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দেয়। এই ঘটনার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, সংবেদনশীল মুহূর্তেও এআইভিত্তিক বিভ্রান্তিকর কনটেন্ট জনমনে ভুল বার্তা ছড়াচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে, যদি একটি জাতীয় শোকের মুহূর্তে এমন বিভ্রান্তি ছড়ানো যায়, তাহলে আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনে এর প্রভাব কতটা ভয়ংকর হতে পারে? আধুনিক এই প্রযুক্তি নিয়ে নিয়মিত যারা কাজ করেন তারা বলছেন, মেটা, ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামের প্রায় ৮০ শতাংশ পোস্টই এআই রিকমেন্ডশনে তৈরি। এ ছাড়া বিগত ৬ মাসে সোশ্যাল মিডিয়া দ্বারা ভুল তথ্য ছড়িয়েছে প্রায় ২০০ গুণ।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. আব্দুর রাজ্জাক কালবেলাকে বলেন, এআইর ইতিবাচক দিক সবচেয়ে বেশি বলেই আমরা এটিকে গ্রহণ করেছি। এআই যেহেতু সবার জন্য; এখন এই টেকনোলজির গতি অনুযায়ী আমাদের চলতে হবে। তবে নেতিবাচক দিকও রয়েছে এবং এর নেতিবাচক ব্যবহারও হচ্ছে। তবে এই প্রযুক্তি যাতে বিভ্রান্তি ছড়াতে না পারে, সেজন্য উন্নত বিশ্ব নানাবিধ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। সেটি আমাদেরও করতে হবে। ভিজিল্যান্স টিম থাকতে হবে, টেকনোলজি এক্সপার্ট লাগবে এবং পলিসি মেকারদের অ্যাক্টিভ রোল প্লে করতে হবে। পাশাপাশি জনসচেতনতাও বাড়াতে হবে। যারা অপতথ্য ছড়াচ্ছে তাদের পর্যবেক্ষণ করতে বিশেষ টিম লাগবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়, এ বিষয়ে যারা প্রযুক্তিগত জ্ঞান রাখেন এবং যাদের প্রযুক্তিগত অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাদের সংযুক্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।’

লন্ডনভিত্তিক একটি বহুমাত্রিক কোম্পানির প্রযুক্তি বিভাগের প্রধান হিসেবে কর্মরত প্রকৌশলী শামীম সরকার কালবেলাকে বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেভাবে এআইর অপব্যবহার হচ্ছে, এতে করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে অপপ্রচার আরও কয়েকশ গুণ বাড়বে। সবচেয়ে বেশি অপতথ্য ছড়ানো হতে পারে নারী প্রার্থীদের ঘিরে। তাই আইনি নীতিমালা, মিডিয়া লিটারেসি, ফ্যাক্ট-চেকিং প্ল্যাটফর্মের বিস্তৃতি, নারী সুরক্ষা এবং সোশ্যাল মিডিয়া সমন্বয়ের মাধ্যমে এআই প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধ করা জরুরি।

এআই যেভাবে অভিশাপ: বাংলাদেশে প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) একদিকে যেমন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে, অন্যদিকে তা হয়ে উঠেছে অপপ্রচারের এক নতুন অস্ত্র। রাজনৈতিক বিভাজন, নির্বাচনকেন্দ্রিক উত্তেজনা কিংবা সামাজিক অস্থিরতার সময়ে এআই সৃষ্ট ভুয়া ছবি, ভিডিও এবং মনগড়া বিশ্লেষণ ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে, আর সত্যের জায়গা নিচ্ছে অসত্য তথ্যনির্ভর মিথ্যাচার। এআইর মতো প্রযুক্তি, যা হতে পারত তথ্য যাচাইয়ের সহায়ক, তা-ই এখন হয়ে উঠেছে বিভ্রান্তি তৈরির হাতিয়ার। বাংলাদেশে তথ্যের নিরাপত্তা ও গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য এআইর অপব্যবহার মারাত্মক হুমকি। সংবেদনশীল বিষয়ে যেভাবে এআই ব্যবহারে অপতথ্য ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, তা সামনে আরও ভয়াবহ হতে পারে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

প্রযুক্তিবিদদের মতে, আমরা যখন কোনো কনটেন্ট মার্কেটিং করি, তখন তার নেগেটিভ কনটেন্ট বেশি অর্গানিক রিচ হয়। একটা নেগেটিভ তথ্য যদি তার প্রকৃত সংবাদের তুলনায় বেশি রিচ হয়, তাহলে মানুষ সেটিকেই গ্রহণ করবে। বাংলাদেশের মতো একটি দেশে কোটি কোটি ফেক কনটেন্ট তৈরি হয়েছে, যা আসলেই উদ্বেগের। মাইলস্টোন ট্র্যাজেডিতে এআই দ্বারা তৈরি হয়েছে প্রায় ৫০টির অধিক ভিডিও। যেখানে শ্রেণিকক্ষে এয়ারক্রাফটি বিধ্বস্ত হওয়া থেকে পাইলটকে স্ট্রেচারে করে হাসপাতালে নেওয়াসহ নানা দৃশ্য দেখানো হয়। দেশের এত বড় দুর্যোগেও অপপ্রচারের ক্ষেত্রটি সংকুচিত হয়নি। এ ছাড়া এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনাকে পরিকল্পিত বলে যে গুজব উঠছে, তার কারণও এআই। এআই টুলস ব্যবহার করে ফটোশপ ও জেনারেটিভ ফিল দিয়ে স্ক্রিনশটের তারিখ পরিবর্তন করে সহজেই বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়। এ ছাড়া এআই দিয়ে পুরো ফেসবুক পোস্টেও ভুয়া ইন্টারফেস বানানো যায়। যার মাধ্যমে পোস্টটি যে কোনো দিনের বা তারিখের বানানো সম্ভব।

নির্বাচন ঘিরে দুশ্চিন্তা: বাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে এআই-চালিত বিভ্রান্তিকর কনটেন্টের বিস্তার এরই মধ্যে উদ্বেগজনক মাত্রায় পৌঁছেছে। ফ্যাক্ট চেকার সংস্থা ডিসমিসল্যাবের এক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ‘এ বছরের জুন-জুলাইয়ে প্রায় ৭০টির বেশি এআই দিয়ে তৈরি রাজনৈতিক ভিডিও প্রকাশিত হয়েছে। যার মোট দর্শক ২৩ মিলিয়নের বেশি। এসব ভিডিওতে নারী, রিকশাচালক, ফল বিক্রেতা সবাইকে কল্পিত চরিত্রে দেখিয়ে জামায়াত, বিএনপি বা আওয়ামী লীগের সমর্থক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। এমনকি সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের নিয়েও আজগুবি ভিডিও ছড়ানো হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, উদ্বেগজনক বিষয় হলো- আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নারী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ডিপফেক ভিডিওর মাধ্যমে ডিজিটাল সহিংসতা ছড়ানো এখনই শুরু হয়ে গেছে। তা আগামীতে আরও তীব্র হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’

অন্য সংস্থা সাইবার অ্যান্ড জেন্ডার-বেসড ভায়োলেন্স ইন বাংলাদেশ জানায়, এ বছরের প্রথমার্ধে এআই-চালিত ডিজিটাল সহিংসতার শিকারদের মধ্যে ৭৬ শতাংশ নারী, যাদের অনেকেই রাজনীতিতে সক্রিয়। একশনএইড বাংলাদেশের জরিপে দেখা গেছে, ৬৪ শতাংশ নারী অনলাইনে এ প্রযুক্তির মাধ্যমে হয়রানির শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে ৭০ শতাংশই হচ্ছে—শ্লীলতাহানিমূলক কনটেন্ট। এ প্রবণতা শুধু ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নয়, রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণেও বাঁধা সৃষ্টি করছে এবং মানসিক ট্রমা তৈরি করছে। যদিও এআই সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা বলেছেন, যে ধারাবাহিতকায় এআইর মাধ্যমে অপতথ্য ছড়ানো হচ্ছে, তা পর্যবেক্ষণ করে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়। এবারের সংসদ নির্বাচনের আগে ডিজিটাল সংহিংসতার মাত্রা মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়বে। আর নারী প্রার্থীদের প্রায় ৫০-৬০ শতাংশই এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, এসব বিভ্রান্তিকর কনটেন্ট তৈরির ক্ষেত্রে এআই টুলগুলো হচ্ছে— হেযেন, ডিপফেইসল্যাব, সিনথেটিকসহ আরও কয়েকটি। এগুলো খুবই সহজলভ্য। যা মাত্র ২৪ ডলারে কিনতে পাওয়া যায়। সাধারণ মানুষও এখন এসব টুল ব্যবহার করে বাস্তবের মতো মুখভঙ্গি, কণ্ঠস্বর ও আচরণ নকল করতে পারছে। ফলে রাজনৈতিক বার্তা হয়ে উঠছে কল্পনার খেলা এবং সত্যকেও ‘এআই- জেনারেটেড’ বলে অস্বীকার করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।

নির্বাচনের আগে এআই দ্বারা অপতথ্য বৃদ্ধির আশঙ্কার কথা জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের একজন অধ্যাপক বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে এআই দ্বারা তৈরি অনেক আপত্তিকর ভিডিও আমার চোখে এসেছে, যা রীতিমতো বিব্রতকর। নির্বাচনের আগে অপতথ্য ছড়ানোর মাত্রা অনেকগুণ বাড়বে। এখনই উদ্যোগ না নিলে এটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। তা ছাড়া অপতথ্য নিয়ন্ত্রণের এত টুলস পাওয়া যাবে না। তাই বিষয়টি নিয়ে এখনই আমাদের চিন্তা করতে হবে এবং জনবল নিয়োগ রাখতে হবে—যেন শক্তিশালী একটি পর্যবেক্ষণ টিম করা যায়।’

প্রযুক্তি সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ‘বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এআই সৃষ্ট কনটেন্ট প্রতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণের জন্য নির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। সরকারের তথ্য প্রযুক্তি বিভাগ বা নির্বাচন কমিশনও এ বিষয়ে কোনো গাইডলাইন তৈরি করেনি। দেশের নাগরিকদের প্রযুক্তিগত শিক্ষার হার মাত্র ১০ শতাংশ বা তারও কম হওয়ায় এআই সৃষ্ট ভুয়া ভিডিও লোকজন সহজেই বিশ্বাস করছে। এআই বট টুলসের সঙ্গে ডিপফেইক ভিডিও এবং ভয়েজ সিনথেটিক যোগ করে ভুয়া ভিডিও ও অডিও কলও করা যাচ্ছে।

এ বিষয়ে ইঞ্জিনিয়ার শামীম সরকার বলেন, এআই সোশ্যাল বট ব্যবহার করে যে কোনো ফেসবুক পেইজ কিংবা ওয়েবসাইটকে সাময়িক অথবা পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব। এক এলাকার ভিডিও এআই দিয়ে পরিবর্তন করে সহজেই অন্য স্থানের বলে চালানো যাচ্ছে, আর এতে বড় ধরনের প্রযুক্তিগত জ্ঞানের দরকার হচ্ছে না; ভয়েজ কমান্ডে কিংবা লিখে নির্দেশনা দিয়ে সম্পূর্ণ ঘটনাকে উল্টে দেওয়া সাধারণ বিষয়। সম্প্রতি তাসনিম জারাসহ অনেক নারী নেত্রীদের নিয়ে নানা ধরনের ক্ষতিকর ভিডিও ছড়ানো হচ্ছে। যা রীতিমতো উদ্বেগের।

প্রযুক্তিবিদরা বলেন, আসন্ন নির্বাচনে যে কোনো কনটেন্ট যদি এআই দ্বারা তৈরি হয়; তা নীতিমালার কারণে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মুছে হয়ে যাবে—এমন ব্যবস্থা তৈরির সুযোগ রয়েছে। যেমনটা কপিরাইট কিংবা ভায়োলেন্স যুক্ত কনটেন্ট শনাক্ত করে ঠিক সেভাবে।

এআইর অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণের উপায়: বর্তমানে এআই ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও সাইবার ব্ল্যাকমেইলের ক্ষেত্রেও ব্যবহার হচ্ছে, যা নাগরিক মানবাধিকার ও সাংবিধানিক অধিকার হুমকির মুখে ফেলছে। এ সংকট মোকাবিলায় প্রয়োজন বহুমাত্রিক পদক্ষেপ। প্রথমত, আইনগতভাবে এআই-চালিত ভুয়া কনটেন্টকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রযুক্তিগতভাবে ডিপফেক ভিডিও শনাক্ত করার জন্য উন্নত টুল চেইনভিত্তিক তথ্য যাচাই ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। বিশ্লেষকরা বলেছেন, এআই কনটেন্ট কোনটা তা প্ল্যাটফর্ম ইঞ্জিন সহজেই ধরতে পারে। এআই মার্কিং কনটেন্টে পুশ অ্যালার্ট দিলে ভিডিওটি এআই দ্বারা তৈরি কি না, তা সহজেই শনাক্ত করা যায়।

বিষয়টি নিয়ে অধ্যাপক মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, একটি মনিটরিং টিম হলে সবাই সতর্ক থাকবে, যে অপপ্রচার করলে রক্ষা পাওয়ার সুযোগ নেই। সাইবার স্পেসে মনিটরিং করা না গেলে অপতথ্য ছড়ানো বন্ধ করা যাবে না। আশা করি নির্বাচন কমিশন সব প্রার্থীর সুরক্ষা নিশ্চিত করে জনবল নিয়োগ করে যথোপযোগী কাজ করবে। তবে এ ধরনের প্রতিরোধ ব্যবস্থা এখনই করতে হবে নির্বাচনের আগে, সেটা নিয়ন্ত্রণে আনা অসম্ভব।

যেহেতু সরকারের পক্ষ থেকে এআই নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত গাইডলাইন নেই, তাই বাংলাদেশে ব্যবহার হয়—এমন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর কর্তৃপক্ষ কোনো ধরনের রেস্ট্রিকটেড রাখেনি। যার ফলে সহজেই এসব কনটেন্ট স্পেস (সংকুচিত) না হয়ে উল্টো ছড়িয়ে যাচ্ছে। তাই দেশে ব্যবহার হয় এমন প্ল্যাটফর্মগুলোর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে বলে জানান শামীম সরকার। তিনি বলেন, সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট রিচের খেলা, গুজবের পর কারেকশন পোস্টের রিচ আমি আমার কর্মজীবনে পাইনি। হংকংয়ের মত দেশে যদি এড রান করার জন্য ফেসবুক কনটেন্ট প্রমোশন রেস্ট্রিকটেড করে রাখতে পারে, তাহলে বাংলাদেশের মত জনবহুল দেশের জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া হিসেবে রাষ্ট্র ফেসবুক, এক্স, ইউটিউবে এআই কনটেন্ট রিমুভের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না কেন? সোশ্যাল সাইটগুলোর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এসব নিয়ে আলোচনা জরুরি। সরকার যদি এখনই এ বিষয়ে সিরিয়াস না হয়, তাহলে পরবর্তী সরকার গঠনের ভীত পরিবর্তিত হতে পারে। নির্বাচনের আগের দুই মাস এবং নির্বাচিত সরকার শপথের আগ পর্যন্ত এআই ব্যবহার করে কনটেন্ট বানিয়ে সোশ্যাল মব সন্ত্রাস করা যে কোনো ডিজিটাল মার্কেটারের জন্য খুবই সহজ বিষয়।

প্রযুক্তিবিদরা প্রশ্ন করে বলেন, নতুন ভাবেই যদি বাংলাদেশ এগিয়ে যায়; তাহলে অতীতের সার্ভার সাইটের কাজ, আইনি কাজ সেদিকে নাই কেন? কখনোই এসব বিষয় গ্রাহক পর্যায়ে সচেতনতা তৈরি করে কমানো যাবে না কারণ, মানুষ একটা কনটেন্ট দেখার সময় মনস্তাত্বিক গবেষণা করবে এটা আশা করা বাড়াবাড়ি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

নিম্নচাপের প্রভাবে তলিয়ে গেছে সুন্দরবনের নিচু এলাকা

‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে ভিডিও বানাচ্ছিলেন তারা, অতঃপর...

আবর্জনায় ছেয়ে গেছে আমেরিকার বিভিন্ন শহর, বিপর্যস্ত নগরজীবন

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় পারভেজ মল্লিক

বাংলাদেশ থেকে বিপুল ভিডিও সরাল টিকটক

নেপালে আদালতের রায়ের খবর প্রত্যাখ্যান ইউএস-বাংলার

এইচআইভি আক্রান্ত কিশোরীকে দুবছর ধরে ধর্ষণের অভিযোগ

সাংবাদিকরা সত্য তুলে ধরলে বিভ্রান্তি দূর হবে : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

৫ কোটি টাকার সড়ক ভেসে গেল সমুদ্রে

অপেশাদার আচরণের অভিযোগে মুখ খুললেন বাসার

১০

‘৪-৫ দিনের মধ্যে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করবেন প্রধান উপদেষ্টা’

১১

দুর্যোগে মানবিক প্রতিবেদন শীর্ষক কর্মশালা অনুষ্ঠিত

১২

মানবাধিকারকে সংস্কৃতি হিসেবে গড়ে তুলতে হবে : আসিফ নজরুল

১৩

দুঃখজনকভাবে বিচার বিভাগ এখনো নির্বাহী বিভাগের উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল : বিজেএসএ

১৪

পথেই বগি ফেলে চলে গেল কক্সবাজার এক্সপ্রেস ট্রেন

১৫

মোহাম্মদপুরে দিনে-দুপুরে যুবককে কুপিয়ে হত্যা

১৬

ট্রেনে উঠিয়ে দেওয়ার কথা বলে তরুণীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ

১৭

ছাত্রলীগ ‘আখ্যা’ দিয়ে ঢাবি ছাত্রদল কর্মীকে হয়রানির অভিযোগ

১৮

মাদকমুক্ত সমাজ বিনির্মাণে ক্রীড়ার কোনো বিকল্প নেই : কামরুজ্জামান সোহাগ

১৯

গুগল ম্যাপ দেখে গাড়ি চালাতে গিয়ে মৃত্যুফাঁদে নারী চালক

২০
X