গাজীপুরে সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় সরাসরি জড়িত অভিযোগে এক দম্পতিসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গতকাল রাতে যৌথ অভিযানে গাজীপুরের বিভিন্ন জায়গা থেকে তাদের আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গ্রেপ্তার ওই চারজন হলো মো. মিজান ওরফে কেটু মিজান, তার স্ত্রী গোলাপী, মো. স্বাধীন ও আল-আমিন। তারা সবাই সাংবাদিক তুহিন হত্যার ঘটনায় হওয়া মামলার আসামি বলে জানিয়েছেন বাসন থানার ওসি শাহিন খান। সিসিটিভির ফুটেজ দেখে তাদের শনাক্ত করা হয় বলে জানিয়েছে পুলিশ। তারা সবাই ছিনতাইকারী চক্রের সদস্য। ওই সিসিটিভি ফুটেজে তুহিন হত্যার সময় রামদা হাতে কেটু মিজানকে মানুষের ভিড়ের মধ্যে নির্লিপ্ত অবস্থায় দেখা যায়।
এদিকে, নিহত সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটির সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। যে মোবাইলটি দিয়ে তুহিন সন্ত্রাসীদের কোপানোর দৃশ্যের ভিডিও চিত্র ধারণ করেছিলেন, সেই মোবাইলটি বর্তমানে বন্ধ রয়েছে।
গাজীপুর মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার রবিউল ইসলাম বলেছেন, সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে এই হত্যায় জড়িত পাঁচ-ছয়জনকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়ছে।
গত বৃহস্পতিবার রাত ৮টার দিকে গাজীপুর মহানগরীর ব্যস্ততম চান্দনা চৌরাস্তায় মসজিদ মার্কেটের সামনে প্রকাশ্যে কুপিয়ে ও গলা কেটে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় আসাদুজ্জামান তুহিনকে।
পুলিশ জানিয়েছে, সন্ত্রাসীরা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে বাদশা নামের এক ব্যক্তিকে ধাওয়া করছিল। সাংবাদিক তুহিন সেই দৃশ্য মোবাইল ফোনে ভিডিও করছিলেন। তখন দুর্বৃত্তরা তাকে ধাওয়া করে কুপিয়ে হত্যা করে। ঘটনাস্থলের একটি দোকানের সিসিটিভি ফুটেজ থেকে এই তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।
নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিচার ও দ্রুত অপরাধীদের গ্রেপ্তারের দাবি করছেন নিহতের স্বজন ও সাংবাদিকরা। গতকাল সকালে গাজীপুর প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেন জেলায় কর্মরত সাংবাদিকরা।
দ্রুততম সময়ে অপরাধীদের শাস্তি দাবি করে নিহতের বড় ভাই সেলিম বলেন, ‘অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলা দিয়েছি। আমি অপরাধীদের বিচার চাই। এখন তুহিনের দুই ছেলে ছোট ছোট, আমরা গরিব পরিবার। আমার পক্ষে তাদের দেখাশোনা কষ্টকর।
গতকাল যেখানে আসাদুজ্জামান তুহিন নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হন, তার পাশেই চান্দনা চৌরাস্তা ঈদগাহ ময়দানে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৃষ্টির পানিতে ঘটনাস্থল থেকে তুহিনের ছোপ ছোপ রক্ত মুছে গেলেও গভীর আঁচড় রেখে গেছেন দুই সন্তান ও সহকর্মীদের মনে। তার অকাল মৃত্যু মানতে পারছেন না তারা।
ঘটনার কিছু সময় আগে চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় একটি দোকানে বসে ছিলেন সাংবাদিক আসাদুজ্জামান ও তার সহকর্মী শামীম হোসেন।
শামীম হোসেন বলেন, ‘চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় আমরা দুজন একদিক থেকে অন্য পাশে হেঁটে যাচ্ছিলাম। ঠিক এমন সময় একজন নারী ও পুরুষ আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে যায়। এমন সময় কয়েকজন লোক দেশি ধারালো অস্ত্র নিয়ে বলতে থাকে, এই পাইছি, তোরা আয়। ওই ব্যক্তি দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। তখন তারা ধারালো অস্ত্র নিয়ে তাকে ধাওয়া করে। তখন তুহিন (সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন) মুঠোফোন বের করে তাদের পেছনে দৌড় দেন। পরে আমি তুহিনকে খুঁজতে এগিয়ে যাই। অস্ত্রধারী ব্যক্তিরা হঠাৎ থেমে গিয়ে পেছনে তাকায়। তুহিন তখন দৌড়ে চায়ের দোকানে ঢুকে যান। ঠিক ওই মুহূর্তে ওরাও চায়ের দোকানে ঢুকে ওকে কুপিয়ে হত্যা করে পালিয়ে যায়। আমি চৌরাস্তা এলাকায় পুলিশের গাড়ি খুঁজতে থাকি। কোনো গাড়ি দেখতে না পেয়ে বাসন থানার ওসিকে ফোন করি। কিছু সময় পর পুলিশ আসে।’
সিসিটিভি ফুটেজে নারীর সঙ্গে যে ব্যক্তির ধস্তাধস্তি হয়েছিল, তিনি আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছেন।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গাজীপুরের বাসন, ভোগরা ও চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় একটি চক্র আছে, যারা ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত। সিসিটিভির ভিডিওতে যাদের দেখা গেছে, তারা সবাই ছিনতাইকারী দলের সদস্য। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। ভিডিওতে যে নারীকে দেখা গেছে, তিনিও ওই চক্রের সদস্য হতে পারেন। চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ পেতে ওই চক্র ছিনতাই করে থাকে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় কয়েকটি ছিনতাইকারী চক্র সক্রিয়। তারা বিভিন্ন সময় টার্গেট ব্যক্তির সর্বস্ব লুটে নেয়।
তুহিনের মোবাইলের সন্ধান নেই: নিহত সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনের ব্যবহৃত মোবাইলটির সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না।
যে মোবাইলটি দিয়ে তুহিন সন্ত্রাসীদের কোপানোর দৃশ্যের ভিডিও চিত্র ধারণ করেছিলেন, সেই মোবাইলটি বর্তমানে বন্ধ রয়েছে।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, তুহিনের মোবাইলটি উদ্ধার করা গেলে আসামি সনাক্ত করতে সহায়ক হবে। কারণ সাংবাদিক তুহিন ওই মোবাইলটি দিয়ে কোপানোর দৃশ্যটি ধারণ করেছিলেন।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার রবিউল ইসলাম বলেন, সাংবাদিক তুহিনের মোবাইলটি একটি হত্যা রহস্য উদঘাটনে একটি গুরুত্বপর্ণ আলামত। তাই মোবাইলটি উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। মোবাইলটি পাওয়া গেলে তিনি কি ভিডিও করেছিলেন, কারা হত্যায় জড়িত চিহ্নিত করতে সহজ হবে। সাংবাদিক তুহিনের ব্যবহৃত মোবাইলটি উদ্ধারের চেষ্টা করা হচ্ছে।
দাদার কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত: নিহত সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার নিজ গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। বড় ভাই মো. সেলিম মিয়া জানান, গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে ফুলবাড়িয়া উপজেলার ভাটিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে নিহত তুহিনের দ্বিতীয় জানাজা হয়। এরপর দাদার কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়। এ সময় স্থানীয় রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংবাদিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দরা উপস্থিত ছিলেন। এর আগে গাজীপুর চৌরাস্তা এলাকায় বাদ জুমা তুহিনের প্রথম জানাজা শেষে গ্রামের বাড়িতে মরদেহ নিয়ে আসা হয়।
জেলায় জেলায় বিক্ষোভ: সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে কুপিয়ে হত্যার প্রতিবাদে গতকাল দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেছেন সাংবাদিকরা। এসব কর্মসূচি থেকে এই হত্যায় জড়িতদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে দ্রুত বিচার আইনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানানো হয়।
ফুলবাড়িয়ায় সাংবাদিকদের মানববন্ধন: সাংবাদিক তুহিন হত্যার প্রতিবাদ ও জড়িতদের দ্রত গ্রেপ্তারে দাবিতে মানববন্ধন করেছেন ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার গণমাধ্যমকর্মীরা। গতকাল ফুলবাড়িয়া প্রেসক্লাবের উদ্যোগে উপজেলা পরিষদ চত্বরের সামনে এই কর্মসূচি পালিত হয়।
বগুড়ায় মানববন্ধনে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ: সাংবাদিক তুহিন হত্যার প্রতিবাদে গতকাল বিকেলে বগুড়া শহরের সাতমাথা চত্বরে মানববন্ধন হয়। এই কর্মসূচিতে স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে বহু সাধারণ মানুষও অংশ নেয়।
টাঙ্গাইলে বিক্ষোভ মিছিল : সাংবাদিক তুহিন হত্যার প্রতিবাদে জেলায় কর্মরত বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা মানববন্ধন কর্মসূচিতে অংশ নেন প্রেসক্লাবের সামনে। এর আগে হয় বিক্ষোভ।
ভোলা: সাংবাদিক তুহিন হত্যায় জড়িতদের গ্রেপ্তার ও বিচার দাবিতে গতকাল বিকেলে ভোলা প্রেসক্লাব চত্ত্বরের সামনে মানববন্ধন হয়।
খাগড়াছড়িতে বিক্ষোভ মিছিল : সাংবাদিক তুহিন হত্যার প্রতিবাদে প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণ থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের হয়ে শহরের বিভিন্ন সড়কে প্রদক্ষিণ করে প্রেস ক্লাবের সামনে সকল গণমাধ্যমকর্মীরা খুনিদের শাস্তির দাবি জানান।
নবীনগর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়: সাংবাদিক তুহিন হত্যার প্রতিবাদে ডাকবাংলো প্রাঙ্গণে মানববন্ধনে অংশ নেন নবীনগরের বিভিন্ন গণমাধ্যমকর্মীর, ও সামাজিক সংগঠনের স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং সাধারণ আমজনতারা শাস্তির দাবি করেন।
প্রতিবেদনটিতে তথ্য দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট জেলা-উপজেলার প্রতিনিধিরা
মন্তব্য করুন