নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ বন্ধ হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে একজন প্রার্থী থাকলে তাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে ‘না’ ভোটের সঙ্গে। আর ভোটের সময় কোনো জায়গায় কারচুপি হলে পুরো আসনের ভোটই বাতিল করে দিতে পারবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ ছাড়া হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দিলে নির্বাচিত হওয়ার পরও সদস্যপদ বাতিল করতে পারবে সংস্থাটি। এমন সব বিধান রেখে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ১৯৭২ (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫-এর খসড়া চূড়ান্ত করেছে ইসি।
গতকাল সোমবার নির্বাচন ভবনে অনুষ্ঠিত কমিশন সভায় এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সভায় ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) পদ্ধতি-সংক্রান্ত সব ধরনের বিধিবিধান বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন। এ ছাড়া ভোটে দায়িত্ব পালনকারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনীকেও অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ফলে নির্বাচনে সেনা মোতায়েনে আর অনুমতির প্রয়োজন হবে না। পাশাপাশি জোটের হয়ে প্রার্থী হলেও মার্কা হিসেবে নিজ দলের প্রতীকেই ভোট করতে হবে প্রার্থীকে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিনের সভাপতিত্বে এ বৈঠকে চার নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ, তাহমিদা আহমদ, মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার, আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ ও ইসি সচিব আখতার আহমেদসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, সাংবাদিকরা ভোট গ্রহণের সময় ভোটকেন্দ্রে অবস্থান করতে পারবেন। পাশাপাশি ভোট গণনার সময়ও উপস্থিত থাকতে পারবেন। তবে গণনার সময় আর বের হতে পারবেন না।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার দিনভর আলোচনা চলে। সেদিন কয়েকটি বিষয় নিয়ে সিদ্ধান্ত হলেও আরপিও নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি কমিশন। গতকালের বৈঠক শেষে নির্বাচন কমিশন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, কোনো আসনে একজন প্রার্থী থাকলে তিনি আর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হবেন না। এ ক্ষেত্রে ‘না’ ভোটের সঙ্গে তাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ‘না’ ভোটের চেয়ে সংশ্লিষ্ট প্রার্থী বেশি ভোট পেলেই কেবল তিনি নির্বাচিত হবেন। আর ‘না’ ভোট বেশি হলে ফের নির্বাচন হবে। পরের নির্বাচনেও যদি একক প্রার্থী থাকে, তবে আর ভোট হবে না। ওই প্রার্থীই নির্বাচিত হবেন।
তিনি আরও বলেন, জোটের প্রার্থী হলেও নিজ দলের প্রতীকে ভোট করতে হবে, এটা সংস্কার কমিশনেরও প্রস্তাব ছিল। আমরা এখানে উৎসাহিত বা নিরুৎসাহিত কিছু করছি না। এটা রাজনৈতিক স্বাধীনতা (ফ্রিডম)। কে এককভাবে, কে দলীয়ভাবে নির্বাচন করবে, সেটা তার স্বাধীনতা। তবে জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করলেও রাজনৈতিক দলগুলো তার নিজের প্রতীকটা, যে রিজার্ভ প্রতীক আছে, সেটা দিয়ে নির্বাচন করবে। কোনো একটি প্রতীক দিয়ে নয়।
ইসি সানাউল্লাহ বলেন, আরপিওতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনী বিভাগকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ইভিএম-সংক্রান্ত যাবতীয় বিধি বিলুপ্ত করা হয়েছে। ইসি অবস্থা বুঝে নির্বাচনের ফল স্থগিত করতে পারবে, যা আগে ছিল না। এ ছাড়া সমভোট হলে লটারি প্রথা বিলোপ করে ফের ভোট হবে।
তিনি বলেন, হলফনামায় দেওয়া তথ্য মিথ্যা প্রমাণিত হলে নির্বাচিত হওয়ার পরও পাঁচ বছর মেয়াদ পর্যন্ত কমিশন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে। এমনকি সদস্যপদ বাতিলও করতে পারবে।
নির্বাচন কমিশনার বলেন, ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত অনুদান নিতে পারবেন প্রার্থীরা। তবে সেটা হতে হবে ব্যাংকের মাধ্যমে।
বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, গণমাধ্যমকর্মীরা ভোট গণনার সময় উপস্থিত থাকতে পারবেন। তবে সেক্ষেত্রে গণনা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরোটা সময় থাকতে হবে। মাঝপথে বের হয়ে যাওয়া যাবে না। ইসি সানাউল্লাহ জানান, ইসি চাইলে ৩০০ আসনের ফল বাতিল করতে পারবে।
একজন প্রার্থী কত আসনে ভোটে দাঁড়াতে পারবেন—এমন প্রশ্নের জবাবে এ নির্বাচন কমিশনার বলেন, এটা নিয়ে ডিল করছি না। এটা আমরা মনে করি একটা ঐকমত্যের বিষয়। ঐকমত্য কমিশনের বাইরেও কিন্তু আরপিও রিলেটেড কিছু কিছু প্রভিশন আসতে পারে এবং সংশোধনীর প্রয়োজন হতে পারে। এটা মাথায় রাখতে হবে। আমরা আশা করছি, আগামী সপ্তাহে আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের জন্য পাঠাতে পারব।
এ সময় তিনি জানান, নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা ৮৪টি নতুন দলের মধ্যে ২২টি দল বিবেচিত হয়েছে। এসব দলের মাঠপর্যায়ে যাচাই-বাছাই চলবে। ৮৩টি সংসদীয় আসনে সীমানা নির্ধারণে নির্বাচন কমিশন আপত্তি পেয়েছে বলেও জানান এই নির্বাচন কমিশনার।
২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশের ইতিহাসে ভোটাররা প্রথমবারের মতো ‘না’ ভোট প্রয়োগ করেছিল। ওই সময় জারি করা আরপিও আদেশের ধারা ৩১(৫)(বিবি)-তে এ বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ বিধান অনুযায়ী ব্যালট পেপারের সবশেষ প্রার্থীর স্থানে লেখা থাকে ‘ওপরের কাউকে নয়’ এবং ভোটারদের সহজ পরিচিতির জন্য মার্কা রাখা হয় ‘ক্রস’ (ঢ)। তখন সারা দেশে মোট প্রদত্ত ৬ কোটি ৯৭ লাখ ৫৯ হাজার ২১০ ভোটের মধ্যে ৩ লাখ ৮২ হাজার ৪৩৭টি ‘না ভোট’ পড়েছিল।
মন্তব্য করুন