উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় প্রশিক্ষণের নামে বিদেশ ভ্রমণের প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন না সরকারি কর্মকর্তারা। মাছ চাষ, খিচুড়ি রান্না, ঘাস চাষ শিখতে বিদেশ যাওয়ার খায়েশের পর এবার দেশি মুরগির ডিম ও মাংস উৎপাদন বাড়ানো শিখতে বিদেশ ভ্রমণের আবদার করা হয়েছে। বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) প্রস্তাবিত একটি প্রকল্পে এমন আবদার করা হয়েছে। এ ছাড়া শুধু বিদেশ ভ্রমণই নয়, আলোচ্য প্রকল্পে পরিকল্পনা কমিশনের সুপারিশ আমলে না নেওয়ার পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয় খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশি মুরগির ডিম ও মাংস উৎপাদন বাড়াতে সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনে ‘দেশি মুরগি গবেষণা, সংরক্ষণ ও উন্নয়ন জোরদারকরণ’ শীর্ষক একটি প্রকল্প প্রস্তাব করেছে বিএলআরআই। প্রকল্পের আওতায় বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য ১ কোটি ১৭ লাখ ১০ হাজার টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অর্থ বরাদ্দ রাখা হলেও কোন দেশে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে, কারা প্রশিক্ষণ নেবেন, তা উল্লেখ নেই। এমনকি বিদেশে তাদের প্রশিক্ষণ সংস্থাটির গবেষণায় কী অবদান রাখবে, সেটিও স্পষ্ট নয়। একইভাবে ৭ কোটি ৪৯ লাখ ৭৪ হাজার টাকা ব্যয়ে দেশে প্রশিক্ষণ খাতের কার্যক্রম এবং লক্ষ্যবস্তুও পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা হয়নি। প্রকল্পের আওতায় কী বিষয়ে ও কাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে এবং প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান কীভাবে প্রকল্পের উদ্দেশ্য অর্জনে সহায়তা করবে, সে বিষয়টি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। এসব বিষয়সহ নানা অসংগতির কারণে পরিকল্পনা কমিশনের প্রশ্নের মুখে পড়তে যাচ্ছে প্রস্তাবিত প্রকল্পটি।
প্রকল্প প্রস্তাব সূত্রে জানা গেছে, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বিএলআরআই প্রস্তাবিত প্রকল্পটির ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ১১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। সরকারি অর্থায়নে দেশের ৮ বিভাগের ২১টি জেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে। অনুমোদন পেলে চলতি বছর শুরু করে ২০৩০ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্প শেষ করতে চায় বাস্তবায়নকারী সংস্থা বিএলআরআই।
প্রকল্পের উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে, দেশীয় পরিবেশের উপযোগী, উচ্চ ডিম ও মাংস উৎপাদনশীল এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন দেশি মুরগির জাত উন্নয়নে কার্যক্রম গ্রহণ, জাত সংরক্ষণ ও উন্নয়ন, প্রতিটি দেশি মুরগির ডিম প্রায় ৫ থেকে ১০ শতাংশ এবং প্রতিটি মুরগির মাংস ১০০ থেকে ১৫০ গ্রাম বাড়ানো, লাভজনক দেশীয় মুরগি পালনে ন্যূনতম পাঁচটি প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং খামারি পর্যায়ে অভিযোজন ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দেশীয় মুরগি পালন ব্যবস্থাপনা এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন।
প্রস্তাবে প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট জানিয়েছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে দেশি মুরগির ডিম ও মাংস উৎপাদন বাড়বে। খামারিদের পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি পারিবারিক আয় বাড়বে এবং খামারিরা আর্থিকভাবে লাভবান হবেন। এতে দেশি মুরগির খামার প্রতিষ্ঠায় খামারিদের আগ্রহ বাড়বে, যা দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে অবদান রাখবে। এ ছাড়া গবেষণার মাধ্যমে নতুন জাত উদ্ভাবন করে প্রাণিসম্পদ সম্প্রসারণ করা সম্ভব হবে।
প্রকল্পের প্রস্তাবিত কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে পোলট্রি ফিড ও ফিড এডিটিভস বিতরণ, দেশ-বিদেশে প্রশিক্ষণ, গবেষণা পরিচালনা, খামারিদের জন্য ভ্যাকসিন ও জীবাণুনাশক বিতরণ, হ্যাচারি মেরামত, সরঞ্জামাদি ক্রয় এবং নির্মাণ ও আসবাব ক্রয়।
তবে পরিকল্পনা কমিশন বলছে, প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের কাজ গবেষণা করা, সম্প্রসারণধর্মী কাজ তাদের নয়। এটা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কাজ। কিন্তু আলোচ্য প্রকল্পের অনেক কার্যক্রম প্রকৃতপক্ষে গবেষণা সংক্রান্ত নয়, বরং সম্প্রসারণধর্মী, যা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কাজের আওতায় পড়ে। প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য গবেষণা, সংরক্ষণ ও জাত উন্নয়ন হওয়া সত্ত্বেও বাস্তবায়ন পরিকল্পনায় অনেক অপ্রয়োজনীয় অঙ্গ যুক্ত করা হয়েছে। এখানেই শেষ নয়, কমিশনের সুপারিশ অমান্য করে ব্যয় তিনগুণ বাড়িয়ে প্রস্তাব করা হয়েছে। জানা গেছে, প্রকল্পটি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) অননুমোদিত নতুন প্রকল্প তালিকায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তবে এডিপিতে অন্তর্ভুক্তির জন্য ব্যয় ৩০ কোটি টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার শর্তে আন্তঃমন্ত্রণালয় প্রোগ্রামিং কমিটির সভায় সুপারিশ করেছিল পরিকল্পনা কমিশন। কিন্তু সেটা আমলে না নিয়ে প্রকল্প ব্যয় ৭১ কোটি টাকা বাড়িয়ে ১১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা করা হয়েছে।
দেশি মুরগির উৎপাদন বাড়াতে বিদেশ প্রশিক্ষণ, পরিকল্পনা কমিশনের সুপারিশ আমলে না নেওয়া বা অন্যের কাজ করার প্রস্তাব করেই থেমে থাকেনি প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট। অপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন খাত যুক্ত করার পাশাপাশি অত্যধিক ব্যয়ও নির্ধারণ করেছে সংস্থাটি। গবেষণা সরঞ্জামাদি, কেমিকেল ও রিএজেন্ট, হ্যাচারি মেরামত এবং পিএইচডি-ফেলোশিপসহ বিভিন্ন খাতের ব্যয় বিভাজনেও অস্পষ্টতা এবং গরমিল দেখা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এরই মধ্যে প্রস্তাবটি যাচাই-বাছাই শুরু করেছে পরিকল্পনা কমিশন। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, প্রকল্পটি যাচাই-বাছাইয়ে ডিপিপিতে নানা ত্রুটিবিচ্যুতি পাওয়া গেছে। ডিপিপিতে নানা অসংগতি এবং ব্যয়ের অস্পষ্টতা প্রমাণ করে—প্রকল্পটি বাস্তবায়নে যথাযথ পরিকল্পনা ও তদারকির অভাব রয়েছে। ডিপিপি পাঠানোর আগে যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণ করেনি তারা।
প্রকল্পের ব্যয় বিভাজনে দেখা গেছে, গবেষণা পরিচালনার জন্য ১৩ কোটি ১২ লাখ টাকার সংস্থান রাখা হয়েছে। অন্যদিকে, গবেষণার জন্য কেমিকেল, রিএজেন্ট ও গ্লাসওয়ার খাতে ২ কোটি টাকা এবং পিএইচডি-ফেলোশিপ খাতে ১ কোটি ৪৮ লাখ টাকার সংস্থান রাখা হয়েছে। আবার ছয়টি পিএইচডিতে সময় ধরা হয়েছে ৪৮ মাস, যা সঠিক নয়। তা ছাড়া প্রকল্পটির পিএইচডিতে আবার ব্যয় ধরা হয়েছে ২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এ ছাড়া কার্যক্রম ও খরচের বিস্তারিতও ডিপিপিতে অনুপস্থিত।
ডিপিপিতে অঙ্গভিত্তিক ব্যয় বিভাজনে নির্মাণ ও পূর্ত খাতে ১০ কোটি ৭ লাখ ৮০ হাজার টাকা সংস্থান রাখা হয়েছে, যার মধ্যে ২৪ লাখ ২৮ হাজার টাকা প্রাইস কন্টিনজেন্সি হিসেবে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু বিস্তারিত ব্যয় বিবরণীতে ব্যয় উল্লেখ করা হয়েছে ১২ কোটি ৩৮ লাখ ৩০ হাজার টাকা, যার মধ্যে আবার ২৪ লাখ ২৮ হাজার টাকা রাখা হয়েছে ইঞ্জিনিয়ারিং কনসালটেন্সি খাতে, যা ব্যয়ের হিসাবে গরমিল সৃষ্টি করছে।
প্রকল্পে অঙ্গভিত্তিক ব্যয় বিভাজনে আসবাব, যন্ত্রপাতি, মোটরসাইকেল, সাইকেল, ভ্রমণ ভাতা এবং প্রিন্টিং-পাবলিকেশনের জন্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণে অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। আসবাব ও যন্ত্রপাতি খাতে ১১ কোটি ৪৫ লাখ, ভ্রমণ ভাতা ২ কোটি, মোটরসাইকেল ও সাইকেল কেনার জন্য ৯ লাখ ২০ হাজার এবং প্রিন্টিং ও প্রকাশনা খাতে ১ কোটি ৩২ লাখ টাকা চাওয়া হয়েছে। ডিপিপিতে সেমিনার খাতে ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা, গাড়ি ভাড়া বাবদ ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা, অনিয়মিত শ্রমিক খাতে ৬ কোটি ৭ লাখ, খামারিদের জন্য উপকরণ খাতে ৩ কোটি ৮৯ লাখ, ভ্যাকসিন মেডিসিন ও জীবাণুনাশক খাতে ১ কোটি ৮৬ লাখ টাকার সংস্থান রাখা হয়েছে।
এদিকে বিদেশ প্রশিক্ষণ, সুপারিশ অমান্য এবং অপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন খাত যুক্ত করায় প্রশ্নের মুখে পড়তে যাচ্ছে প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রকল্প প্রস্তাবটি। জানা গেছে, আজ সোমবার আলোচ্য প্রকল্পটির ওপর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা হবে। এতে সভাপতিত্ব করবেন পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) ড. মো. মোস্তাফিজুর রহমান। সভায় প্রস্তাবের বিভিন্ন অসংগতির বিষয়ে ব্যাখ্যা চাওয়া হবে।
জানতে চাইলে কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) ড. মো. মোস্তাফিজুর রহমান কালবেলাকে বলেন, দেশি মুরগি উন্নয়ন প্রকল্পটি খামারিদের আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি জাত সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তবে গবেষণার মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে প্রকল্প প্রস্তাবে বেশকিছু অসংগতি রয়েছে। বিদেশ প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য অসংগতির বিষয়ে পিইসি সভায় আলোচনা হবে এবং অপ্রয়োজনীয় খাতগুলো বাদ দেওয়া হবে।
মন্তব্য করুন