

নির্বাচনী আচরণবিধির নানা অসংগতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর তোপের মুখে পড়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সাংঘর্ষিক বিধান, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বিঘ্ন হওয়ার আশঙ্কা, আচরণবিধি প্রতিপালন নিশ্চিতে সক্ষমতা, সদিচ্ছার অভাবসহ বিভিন্ন প্রশ্নবাণে ইসিকে জর্জরিত করে দলগুলো। গতকাল বুধবার রাজধানীর নির্বাচন ভবনে নির্বাচন কমিশন (ইসি) আয়োজিত সংলাপে অংশ নিয়ে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ আমন্ত্রিত দলগুলোর নেতারা এসব বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন।
জবাবে রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনী আচরণবিধি প্রতিপালনে যথাযথভাবে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দীন বলেন, ‘আচরণবিধি প্রস্তুত করাটা বড় কাজ নয়। একটা সুন্দর নির্বাচনের জন্য আচরণবিধি পরিপালনটাই হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের প্রত্যাশা যে, রাজনৈতিক দলগুলো এ আচরণবিধি পরিপালনে প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখবে।’
সংলাপ থেকে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিয়মকানুন মানার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়ার সুপারিশ করে বিএনপি। দলটি মনে করে, এতে দেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আসবে। অন্যদিকে, জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) রদবদলের পেছনে কোনো একটা চক্রান্ত রয়েছে উল্লেখ করে লটারির মাধ্যমে ডিসি, এসপি (পুলিশ সুপার) নিয়োগের দাবি জানিয়েছে জামায়াত। আর জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করলেও নিজ প্রতীকে ভোট করার সিদ্ধান্তে অটল থাকতে ইসির প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।
সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দীনের সভাপতিত্বে সংলাপে ১২টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। এ সময় অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার ও ইসির সিনিয়র সচিব উপস্থিত ছিলেন।
সংলাপে অংশ নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, ‘আচরণবিধিতে শাস্তির বিধান স্পষ্ট নয়। যত নিয়মনীতি তৈরি করা হবে, তত তা লঙ্ঘনের প্রবণতা বাড়বে। কাজেই এটা যত সিম্পল (সাধারণ) করা যায়।’
বিএনপির এ জ্যেষ্ঠ নেতা আরও বলেন, ‘দেশ একটা ক্রান্তিকাল পার করছে। এ সময় ইসির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। আপনাদের যতটুকু লোকবল আছে, তার সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করুন। রিটার্নিং অফিসারদের নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব জনবল থেকে দেওয়ার দাবি জানাই। রিটার্নিং কর্মকর্তা, সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা, নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তা হলে দেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন হবে।’
বিএনপি ও সমমনা দলগুলো দেড় দশক ধরে শুধু একটি উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করছে উল্লেখ করে আব্দুল মঈন খান বলেন, ‘একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ইসি শক্ত অবস্থানে থাকুন। সংবিধানই আপনাদের ক্ষমতা দিয়েছে। নতজানু হওয়ার কোনো কারণ নেই। ধর্মকে রাজনৈতিক কারণে যেন কোথাও ব্যবহার করা না হয়।’
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘জেলা প্রশাসকদের রদবদলের পেছনে যেন কোনো একটা চক্রান্ত রয়েছে এবং কোনো উদ্দেশ্য থেকে এ কাজটি হচ্ছে। জনপ্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের রদবদল লক্ষ করলে দেখা যাবে, এক মাসও হয়নি, ২০ দিনও হয়নি, একজন ডিসি হঠাৎ চলে গেলেন। এক সপ্তাহের মধ্যে অনেককে রদবদল করা হয়েছে। মনে হয় যেন কোনো পরিকল্পনা, কোনো উদ্দেশ্য থেকে এ কাজ হচ্ছে। তপশিল ঘোষণার পর প্রশাসনের অনেক দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের আওতায় আসে। সবচেয়ে নিরপেক্ষ উপায় হলো লটারি পদ্ধতিতে ট্রান্সফার (বদলি) করা, যার যেখানে ভাগ্য, সে চলে যাবে। এতে কোনো প্রশ্ন থাকে না।’
জামায়াত নেতা ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শিশির মনির বলেন, ‘আচরণবিধির ৭-এর ক উপধারায় কোনো প্রকার পোস্টার ব্যবহার করা যাইবে না উল্লেখ থাকার পরও ৭-এর ঘ উপধারায় পোস্টারসহ অন্যান্য প্রচারসামগ্রী ব্যবহারের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করায় বিষয়টি রয়েছে। আগে বলছেন, পোস্টার ব্যবহার করা যাবে না। আবার পোস্টার সরাতে পারবে না, এ কথা বলছেন কেন?’
তিনি আরও বলেন, ‘বিধি ভাঙলে শাস্তির কথা বলা আছে। কিন্তু কে দেবে শাস্তি তা উল্লেখ নেই। আচরণবিধিতে বলতে হতো কোর্ট কে নির্ধারণ করবে। আপনার এই বিধান পড়ে মনে হয় না যে, আপনি যে শাস্তিটা আরোপ করতে চাচ্ছেন, কে শাস্তি আরোপ করবে—এই মর্মে আচরণবিধিতে থাকা উচিত ছিল।’
এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব জহিরুল ইসলাম মুসা নির্বাচনী পোস্টারে দলীয় প্রধান ছাড়া অন্য কারও ছবি ব্যবহার করতে না দেওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, ‘বেগম খালেদা জিয়া হচ্ছেন বিএনপির প্রধান, তারেক রহমানের বা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ছবি কেউ ব্যবহার করলে এই বিধি ব্যবহার করে ব্যবস্থা নিতে হবে। তখন এই কমিশনের সক্ষমতা আমরা দেখতে পারব।’
এনসিপির এই নেতা আরও বলেন, ‘মাইকের ক্ষেত্রে ৬০ ডেসিবল শব্দের মাত্রার কথা বলেছেন। কিন্তু এটা মাপার যন্ত্র কি আছে। নির্বাচন ঘনিয়ে এলে অস্ত্রের ঝনঝনানি নিয়ন্ত্রণ করে কীভাবে অন্য দলের প্রার্থীকে সুরক্ষা দেবেন। যে আইন করেছেন, সেটা বাস্তবায়ন করার সক্ষমতা এবং সদিচ্ছা নেই আপনাদের। তরুণ প্রার্থীদের জনগণের কাছে পৌঁছানোর সুযোগ দিতে হবে। অবশ্যই আগের মন্ত্রী, এমপিদের সঙ্গে এক মঞ্চে বিতর্কের সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। যারা পেশি বা কালো টাকা বা অস্ত্র দিয়ে ভোট নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, তাদেরও একই বৈঠকে বিতর্কের সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে।’
দলটির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, ‘দল যেন নিজের প্রতীকেই জোট করলেও ভোট করতে পারে—এ সিদ্ধান্তে অটল থাকার অনুরোধ জানাব নির্বাচন কমিশনকে।’
সংলাপে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘এরই মধ্যে হাজার হাজার ফেস্টুন, বিলবোর্ড লেগে গেছে। এগুলো আপনি অপসারণ করলেন, তারপরে আপনি একজন প্রার্থী যার ওই পরিমাণ অর্থ ব্যয় করার সামর্থ্য নেই, সক্ষমতা নেই, তাকে আপনি আগে থেকেই অসম প্রতিযোগিতার মধ্যে ফেলে দিলেন।’
প্রচারে প্লাস্টিকের ব্যবহার রোধের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কাপড়ের কথা বলেছেন, আমরা নিশ্চিতভাবে পরিবেশসম্মত যে পদ্ধতি, সেটাকে সমর্থন করি। প্র্যাক্টিক্যাল রিয়ালিটিতে বিকল্প জায়গাগুলো কী? আপনারা পোস্টারও বন্ধ করে দিয়েছেন। মূলত লিফলেট ছাড়া আর কোনো প্রচারের জায়গা থাকছে না। প্র্যাকটিক্যালি এটা কিন্তু ইলেকশন প্রচারের জন্য... ধরুন ভিজুয়াল ইজ ইমপরট্যান্ট। সেটা পোস্টারে দেখেন, সেটা বিলবোর্ডে দেখেন—প্র্যাক্টিক্যাল। বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনপিসি) শাপলা প্রতীক দিয়ে তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে নির্বাচন কমিশন। আমরা কমিশনকে সব প্রশ্নের ঊর্ধ্বে দেখতে চাই।’
সভাপতির বক্তব্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনী আচরণবিধি প্রতিপালনে যথাযথভাবে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘‘ভোট গ্রহণের প্রতিটি পদক্ষেপে আপনাদের সবার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা অতীতে কেয়ারটেকার আমলে দু-তিনটা নির্বাচন দেখেছি, নির্বাচনী আচরণবিধি পালনের ব্যাপারে দলগুলো ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। নির্বাচনী আচরণবিধি মেনে চলার জন্য আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চাইতেও প্রতিটি রাজনৈতিক দল এবং তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। তাই এ ক্ষেত্রে আমরা আশা করব, আপনারা আমাদের ও দেশের জনগণের প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করবেন।’
সিইসি বলেন, ‘শুধু নির্বাচন কমিশন একা নয়, একটা সুন্দর আর গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য আপনারাও (দলগুলোর নেতারা) জাতির কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ। এতদিনের সংলাপে ‘আমরা একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাই না’—এমন বক্তব্য কোনো রাজনৈতিক দল দেয়নি। সবাই একটা সুন্দর, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য জাতির কাছে ওয়াদা করেছেন।’’
আচরণবিধি প্রস্তুত করাটা বড় কাজ নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘একটা সুন্দর নির্বাচনের জন্য আচরণবিধি পরিপালনটাই হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের প্রত্যাশা যে, রাজনৈতিক দলগুলো এই আচরণবিধি পরিপালনে প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখবে।’
চলমান এ সংলাপে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ, আব্দুর রহমানেল মাছউদ, তাহমিদা আহমেদ, মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদসহ কমিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
গতকাল সকালের সংলাপে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলো হলো— বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশ মাইনরিটি জনতা পার্টি-বিএমজেপি, ইনসানিয়াত বিপ্লব, বাংলাদেশ, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণসংহতি আন্দোলন, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম) ও বাংলাদেশ লেবার পার্টি।
এ ছাড়া দুপুরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), গণঅধিকার পরিষদ, নাগরিক ঐক্য, বাংলাদেশ রিপাবলিকান পার্টি (বিআরপি) ও বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)-মার্কসবাদী নির্বাচন কমিশনের সংলাপে অংশ নেয়।
মন্তব্য করুন