

অবৈধ ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল (ভিওআইপি) কার্যক্রমে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০১০ সালে ঢাকা টেলিফোন কোম্পানি লিমিটেডের লাইসেন্স বাতিল করে বিটিআরসি। দীর্ঘ বছর পর সেই বাতিল আদেশ প্রত্যাহারের আবেদন নিয়ে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) দ্বারস্থ হয়েছে কোম্পানিটি। লাইসেন্স বাতিল হওয়ার প্রায় ১৫ বছর পর প্রতিষ্ঠানটি শুধু লাইসেন্স পুনর্বহালই নয়, নতুন লাইসেন্স ও আর্থিক ছাড় এবং বিটিআরসির তহবিল থেকে অনুদানসহ নানা আবদার করেছে। এমনকি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের মতো বিশেষ সুবিধাও চাওয়া হয়েছে।
বিটিআরসির সাম্প্রতিক কমিশন সভা সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। কমিশন সভা সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি বিটিআরসিতে ‘লাইসেন্স বাতিলের আদেশ প্রত্যাহার ও প্রতিকার চাওয়া’ শিরোনামে আবেদন জমা দিয়েছে ঢাকা টেলিফোন কোম্পানি লিমিটেড। আবেদনপত্রে দাবি করা হয়েছে, ২০১০ সালে তৎকালীন আওয়ামী সরকারের আমলে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ও প্রতিহিংসাবশত ঢাকা টেলিফোন কোম্পানি লিমিটেডের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছিল।
প্রতিষ্ঠানটির আবেদনে উদ্দেশ্যপ্রণোদিভাবে লাইসেন্স বাতিলের দাবি করা হলেও তথ্য বলছে ভিন্ন কথা। বিটিআরসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর অবৈধ ভিওআইপি কার্যক্রমের অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির বাড্ডা থানায় মামলা দায়ের করা হয়। তদন্তে দেখা যায়, টেলিফোন কোম্পানিটি অবৈধভাবে আন্তর্জাতিক কল টার্মিনেশন করছিল এবং সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছিল। এরপর ২০১০ সালের ১৫ মার্চ কোম্পানিটির কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। একই বছরের ২৯ মার্চ কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠানোর পর তদন্তে একাধিক গুরুতর অনিয়ম পাওয়া যায়।
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটি পাবলিক সুইচ টেলিফোন নেটওয়ার্ক (পিএসটিএন) মনিটরিং টার্মিনালে বিটিআরসিকে অনলাইন এক্সেস দেয়নি, গ্রাহকের তথ্য ও বিলিং রেকর্ড গোপন রেখেছে এবং ইআই কানেক্টিভিটি ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক গেটওয়ে বাইপাস করে অবৈধ ভিওআইপি কল টার্মিনেশন করেছে এবং সরকারকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন থেকে বঞ্চিত করেছে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটি কমিশনকে লাইসেন্স ফি, রাজস্ব ভাগাভাগি, স্পেকট্রাম চার্জ ও ইন্টারকানেকশন চার্জ পরিশোধ করেনি।
এসব অপরাধের কারণে ২০১০ সালের মে মাসে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ আইন, ২০০১-এর ধারা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটির পিএসটিএন ও আইএসপি লাইসেন্স বাতিল করা হয়। লাইসেন্স বাতিলের পর বিটিআরসি কোম্পানির ব্যাংক জামানত বাজেয়াপ্ত করা হয়। এরপর ২০১৫ সালে কোম্পানিটি তাদের লাইসেন্স বাতিল, বাতিল আদেশ প্রত্যাহার, নিষেধাজ্ঞা ও ব্যাংক গ্যারান্টি নগদায়ন সংক্রান্ত বিষয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন করে। উক্ত রিটে হাইকোর্টের আদেশে ডাচ বাংলা ব্যাংক লিমিটেডের কাছে রক্ষিত টেলিফোন কোম্পানিটির ব্যাংক গ্যারান্টি থেকে ২ কোটি ২০ লাখ টাকারও বেশি নগদায়ন করা হয়।
কমিশন বলছে, বর্তমানে মামলাটিতে কোনো রুল ও আদেশ নেই এবং হাইকোর্ট বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানের বিপুল পরিমাণ বকেয়া পাওনা এখনো আদায় হয়নি। বিটিআরসির অর্থ, হিসাব ও রাজস্ব বিভাগের সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা টেলিফোন কোম্পানি লিমিটেডের বকেয়া পাওনা রয়েছে ৯ কোটি ৬৫ লাখ ১৩ হাজার ৪৭১ টাকা।
এদিকে, বিটিআরসির বিরুদ্ধে ২০১৭ সালে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দাবিতে মামলা করে। দীর্ঘ শুনানির পর ২০২৩ সালের ৪ অক্টোবর আদালত মামলাটি খারিজ করে বিটিআরসির পক্ষে রায় দেন। এরপর প্রতিষ্ঠানটি সেই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট বিভাগে আপিল দায়ের করেছে, যা বর্তমানে বিচারাধীন। তবে আপিলের ক্ষেত্রে কোনো স্থগিতাদেশ বা অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ নেই।
এমন প্রেক্ষাপটে প্রতিষ্ঠানটি লাইসেন্স পুনর্বহাল ছাড়াও নতুন লাইসেন্স, ফ্রিকোয়েন্সি ছাড়, শুল্কমুক্ত যন্ত্রপাতি আমদানির সুবিধা এবং বিটিআরসির সামাজিক দায়িত্ব তহবিল (এসওএফ) থেকে অনুদান চেয়েছে, যা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অবৈধ কার্যক্রমের দায়ে লাইসেন্স হারানো একটি কোম্পানি আবার রাষ্ট্রীয় তহবিল ও ছাড় সুবিধা চাওয়া অনৈতিক এবং প্রশ্নবিদ্ধ।
বিটিআরসি সূত্রে জানা গেছে, কোম্পানিটি তাদের লাইসেন্স বাতিলের আদেশ প্রত্যাহারসহ ১৪টি দাবি-দাওয়ার আবদার করেছে। এর মধ্যে রয়েছে নতুন জাতীয় টেলিযোগাযোগ পরিবহন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন) লাইসেন্স, বিটিসিএলের আদলে আন্তঃসংযোগ (আইসিএক্স) ও ব্রডব্যান্ড ওয়্যারলেস অ্যাক্সেস (বিডব্লিউএ) লাইসেন্স, সক্রিয় নেটওয়ার্ক ভাগাভাগির অনুমতি, আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট গেটওয়ে ও ইন্টারনেট টেলিফোন সেবা পরিচালনার সুযোগ প্রভৃতি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা টেলিফোন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফা রফিকুল ইসলাম ডিউক কালবেলাকে বলেন, এখানে আমাদের প্রায় ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে। লাইসেন্স বাতিলের কারণে আমাদের পুরো বিনিয়োগ নষ্ট হয়ে গেছে।
অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসায় জড়িত থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, অনেক কোম্পানির বিরুদ্ধেই এই অভিযোগ ছিল। কিন্তু শুধু উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আমাদের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছিল। আমাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ প্রমাণিত নয়।
দাবি-দাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, প্রায় ১৫ বছর লাইসেন্স বাতিল থাকায় আমরা কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছি না। এখানে আমাদের অনেক বিনিয়োগ রয়েছে, কার্যক্রম পরিচালনা না করতে পারায় আমাদের বিপুল ক্ষতি হয়েছে। এসব ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আমরা কিছু সুবিধা চেয়েছি, আমরা ক্ষতিপূরণ চাচ্ছি না।
এ বিষয়ে বিটিআরসি বলছে, চলমান মামলাগুলো নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত লাইসেন্স বাতিল আদেশ বহাল থাকবে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির বকেয়া সরকারি পাওনা আদায়ে পদক্ষেপ নিতে রাজস্ব বিভাগকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
মন্তব্য করুন