বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রানীতির যে পদক্ষেপগুলো ঘোষণা করেছে, তা যথাযথ বলেই মনে হয়েছে। তবে বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করবে এর কার্যকারিতা। মূল্যস্ফীতিকে কমিয়ে আনাটাই প্রধান লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এজন্য ঋণের সুদহারের সীমা তুলে দিয়ে বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এটা আমরা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছি। বাংলাদেশ ব্যাংক দেরিতে হলেও শেষ পর্যন্ত সেদিকেই আসছে, যা ঘোষিত মুদ্রানীতিতে স্পষ্ট হয়েছে।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংক যে পদ্ধতিতে এটা করবে সেটা পুরোপুরি বাজারভিত্তিক হবে না। কারণ বর্তমানে সরকারের বেশিরভাগ ট্রেজারি বিল বাংলাদেশ ব্যাংকই কিনে নিচ্ছে। এটা পুরোপুরি বাজারে ছাড়া হচ্ছে না। এটা করা যাবে না। এটা পুরোপুরি বাজারে ছেড়ে দিতে হবে। কেননা, টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দিলে মূল্যস্ফীতি কখনো কমবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি করে বাজার থেকে যে টাকা তুলে নিচ্ছে এর ফলে বাজারে টাকা এবং ডলারের এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হচ্ছে, যা কখনো কাম্য নয়। বর্তমানে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার যে সংকট তৈরি হয়েছে, তা টাকা দিয়ে পূরণ করা সম্ভব নয়। এতে আমদানি, রপ্তানিসহ সব খাতেই নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ফলে টাকা ছাপানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও সংযত হবে হবে। খুব পরিমিতভাবে টাকা ছাপাতে হবে।
ডলারের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে মুদ্রানীতিতে। এটা ভালো। ডলারের দাম বাজারভিত্তিক হলে প্রবাসী আয় বাড়বে, রপ্তানিকারকরাও তাদের আয় দ্রুত দেশে নিয়ে আসবেন। এ ছাড়া বিদেশি ঋণের সুদহার এখন ৬ শতাংশ, দেশের ব্যাংকগুলোর ৮-৯ শতাংশ সুদে ঋণ দিচ্ছে। ফলে বিদেশি ঋণ নেওয়া বন্ধ করে দিয়ে উল্টো আগের ঋণ শোধ করা হচ্ছে। এ জন্য দেশের ব্যাংকগুলোর ঋণের হার বাড়ালে আবারও বিদেশি ঋণের দিকে ব্যবসায়ীরা ঝুঁকতেন। এতে ডলারের প্রবাহ বাড়ত।
সুদহার বাড়ানোর ফলে আমানতের যে সংকট চলছে, তা-ও অনেকটা কমে যাবে। অপ্রয়োজনীয় আমদানি কম হবে। তবে আমদানি প্রবৃদ্ধি যেভাবে কমে যাচ্ছে, এভাবে চললে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে যাবে। দেশের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে আমদানি বাড়াতে হবে। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার মজুতও ধরে রাখতে হবে।
মূল সমস্যা হচ্ছে, সরকারের রাজস্ব আয় নেই। এবং এই রাজস্ব আয় বাড়াতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। ফলে সরকারের এ সমস্যার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক চাইলেও অনেক কিছু চালু করতে পারছে না। সরকার যে বিশাল ব্যয়ের লক্ষ্য ঠিক করেছে বাজেটে, তা তো ব্যাংক মেটাতে পারবে না। ফলে বাধ্য হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককেই টাকা ছাপিয়ে ঋণ দিতে হবে।
তাহলে মূল্যস্ফীতি কীভাবে নিয়ন্ত্রণ হবে— সেটাই বড় সংশয়। ফলে সরকারকে তার ব্যয় কমাতে হবে। আর তা না করে যদি সরকার আগের মতোই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে থাকে, তাহলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ হবে না। কাজেই মুদ্রানীতির যে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করবে এর কার্যকারিতা।
এ ছাড়া, ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। এটা কমানোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, তা ঠিক করতে হবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল খেলাপি ঋণের সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। এর মধ্যে নামতে না পারলেও কী উদ্যোগ নেওয়া হলো, তা পরিষ্কার করতে হবে। অনেক ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে আছে, আরও অনেক ব্যাংক সেই সংকটে পড়বে। অনেক ব্যাংক দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। এসব ব্যাংককে একীভূত করে সূচকগুলো ঠিক করার উদ্যোগ নিতে হবে। কয়েকটি ইসলামী ধারার ব্যাংকে যা চলছে, তা বন্ধে শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট
মন্তব্য করুন