যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞার পরিপ্রেক্ষিতে চলমান একদফার আন্দোলনকে আরও জোরদার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। দাবি আদায়ে ভিসা নিষেধাজ্ঞাকে এক ধরনের সুযোগ হিসেবে দেখছে দলটি। বিএনপি নেতারা মনে করছেন, ভিসা নিষেধাজ্ঞার ফলে সরকার দেশে-বিদেশে ব্যাপক চাপে পড়েছে। এই চাপ কাজে লাগিয়ে তারা আন্দোলনকে লক্ষ্যে পৌঁছাতে চান। এখন তারা একদফার সঙ্গে দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অসুস্থতা ও মুক্তি ইস্যুকেও জোরালোভাবে সম্পৃক্ত করতে যাচ্ছেন। এ নিয়ে দলের পক্ষ থেকে কঠোর কর্মসূচির কথা ভাবা হচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, নির্ধারিত সময়ের আগেই
একদফার আন্দোলন বড় ধরনের মোড় নিতে পারে। যদিও এর আগে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ইস্যুতে দলটি মধ্য অক্টোবরে আন্দোলনকে সর্বোচ্চ চূড়ায় নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিল।
বিএনপি নেতারা বলছেন, খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ। তিনি জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছেন। দীর্ঘ এক মাসের বেশি সময় তিনি বসুন্ধরার এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। গত ৯ আগস্ট গুলশানের বাসায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্তে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ৭৮ বছর বয়সী সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী লিভারের জটিলতায় ভুগছেন। এ ছাড়া তিনি ফুসফুস, কিডনি, হৃদরোগ, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগে ভুগছেন দীর্ঘদিন ধরে।
এভারকেয়ার হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. শাহাবুদ্দিন তালুকদারের নেতৃত্বে ১৯ সদস্যের একটি মেডিকেল বোর্ড তাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখে চিকিৎসা দিচ্ছেন। বর্তমানে করোনারি কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ) সেটআপে কেবিনেই অসুস্থ খালেদা জিয়া নিবিড় পর্যবেক্ষণে আছেন। তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন বলেন, চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ম্যাডামের লিভার প্রতিস্থাপন জরুরি। সেজন্য তাকে দ্রুত বিদেশে উন্নত মাল্টি ডিসিপ্লেনারি সেন্টারে পাঠানো দরকার।
এর আগে গত শনিবার খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা প্রসঙ্গে তার চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের এক সদস্য জানান, বিএনপি চেয়ারপারসনের স্বাস্থ্যের বিভিন্ন প্যারামিটার আবারও বাড়ছে। অবস্থার অবনতি হওয়ায় ঘন ঘন নিতে হচ্ছে সিসিইউতে। এখন লিভার প্রতিস্থাপন ছাড়া কোনো চিকিৎসা নেই; কিন্তু এটা দেশে সম্ভব নয়। সিসিইউতে ম্যাডামের ফুসফুস থেকে পানি বের করা হয়েছে। লিভার সিরোসিসের কারণেই এমন হচ্ছে। ইলেক্টোরাল ইমব্যালেন্স হওয়ায় শরীরে দুর্বলতা রয়েছে। স্যুপ ও তরল জাতীয় খাবার ছাড়া তিনি তেমন কিছু খেতে পারছেন না। হাসপাতালের বিছানায় সারাক্ষণ থাকতে হচ্ছে ইনজেকশন ও স্যালাইনের ওপর। সর্বশেষ গত শুক্রবার সকালে জরুরি অক্সিজেন সাপোর্টের জন্য খালেদা জিয়াকে সিসিইউতে নেওয়া হয়। ওইদিন দুপুরে তাকে আবার কেবিনে স্থানান্তর করা হয়। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সোমবারও খালেদা জিয়ার ফুসফুস থেকে পানি অপসারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া তার আল্ট্রাসনোগ্রামও করা হয়।
দলীয় চেয়ারপারসনের নিঃশর্ত মুক্তি ও উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে দীর্ঘদিন ধরেই দাবি জানিয়ে আসছে বিএনপি। এ ইস্যুতে সরকারের কাছে একাধিকবার আবেদনও করেছে বেগম জিয়ার পরিবার। তবে এ ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে ইতিবাচক কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। সরকারের পক্ষ থেকে বরাবরই নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়ার মুক্তির শর্ত ও আদালতের কথা বলা হয়েছে। তাই এই ইস্যুতে এবার হার্ডলাইনে যাচ্ছে বিএনপি। এরই অংশ হিসেবে গত রোববার সরকারকে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেওয়া হয়।
জানা গেছে, বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে দাবি না মানলে শক্ত কর্মসূচিতে যাবে দলটি। এক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয় ঘেরাওয়ের কথা ভাবা হচ্ছে। বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের দুজন নেতা বলেন, খালেদা জিয়া ইস্যুতে শক্ত কর্মসূচি দিতে কেন্দ্রের ওপর দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের চাপ ক্রমেই বাড়ছে।
এতদিন শুধু বিভিন্ন সভা-সমাবেশ, সেমিনার থেকে বেগম জিয়ার মুক্তির দাবি জানানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল দলটির কর্মকাণ্ড। তবে এবার এই ইস্যুতে রাজপথে নেমেছে দলটি। দলের প্রধানের মুক্তি ও উন্নত চিকিৎসায় বিদেশে পাঠানোর দাবিতে গত রোববার ঢাকাসহ দেশব্যাপী মহানগর ও জেলায় সমাবেশ করেছে বিএনপি। ঢাকার সমাবেশ থেকে সরকারকে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
এই আল্টিমেটামকে ‘খুবই বাস্তবসম্মত ও ন্যায়সংগত’ বলে মনে করেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল। তিনি কালবেলাকে বলেন, বেঁধে দেওয়ার সময়ের মধ্যে সরকারের সাড়া পাওয়া না গেলে দলের মহাসচিব পরবর্তী কর্মসূচি দেবেন। গোটা বিশ্বের গণতন্ত্রকামী মানুষ ও দেশের জনগণের প্রত্যাশা যখন গোঁয়ার্তুমির মাধ্যমে সরকার প্রত্যাখ্যান করছে, তখন কর্মসূচিও সংগত কারণেই বড় ধরনের মোড় নেবে। তবে খালেদা জিয়ার অসুস্থতাকে কেন্দ্র করে সেই মোড় হয়তো একটু আগেই নিচ্ছে।
জানা গেছে, খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার বিষয়ে সরকারের সঙ্গে ভেতরে ভেতরে এক ধরনের আলোচনা চলছে বিএনপির। এটিকে আরও ফলপ্রসূ করার কৌশল হিসেবেই বিএনপি আল্টিমেটাম দিয়েছে বলে দলের কেউ কেউ মনে করেন। সরকারও আইনের মধ্যে থেকে খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর উপায় খুঁজছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
মন্তব্য করুন