মাহবুবা রহমান আঁখি ও তার নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনায় চিকিৎসার ক্ষেত্রে নিজেদের গাফিলতির কথা স্বীকার করেছে সেন্ট্রাল হসপিটাল কর্তৃপক্ষ। গতকাল সোমবার দুপুরে সেন্ট্রাল হসপিটালে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে গাফিলতির দায় স্বীকার করে নেন হাসপাতালের সিনিয়র ডেপুটি ডিরেক্টর ডা. এ টি এম নজরুল ইসলাম। আঁখির মৃত্যুর ঘটনায় দুঃখ প্রকাশও করেছে হাসপাতালটি। এদিকে হাসপাতালটির অনিয়মের বিষয়ে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক জানিয়েছেন, আঁখির মৃত্যু হয়েছে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে। এ ছাড়া আঁখি ও তার সন্তানের মৃত্যুর ঘটনার বিচার ও ক্ষতিপূরণসহ চার দফা দাবি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মানা না হলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ঘেরাও করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, আঁখির চিকিৎসায় হাসপাতালের অবশ্যই গাফিলতি ছিল। গাফিলতি ছিল প্রথমত ডা. সংযুক্তা সাহার, তারপর ওটির চিকিৎসকদের, কারণ সে সময় তারা সিনিয়র ডাক্তারদের ডাকেননি। আমরা এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। সাত কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন আসার কথা। এরই মধ্যে পাঁচ দিন চলে গেছে, আর বাকি আছে দুই দিন। আশা করছি এই সময়ের মধ্যেই তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা সম্ভব হবে। একমাত্র সংযুক্তা সাহার কারণেই এ ঘটনাটি ঘটল। সংযুক্তা সাহাই তো এত বেশি রোগী দেখেন। সংযুক্তা সাহা হাসপাতালে আছেন কি নেই, বিষয়টি যদি শুরুতেই পরিষ্কার করে দেওয়া হতো তাহলে কিন্তু এ বিষয়টি হতো না। রোগী হয়তো আমাদের হাসপাতালের অন্যান্য সিনিয়র কনসালট্যান্টের অধীনে ভর্তি হতেন। অথবা অন্য কোনো হাসপাতালে চলে যেতেন। সংযুক্তা সাহা ওইদিন হাসপাতালে থাকবেন না, সেটি তিনি আমাদেরও জানাননি। আমরা যদি জানতাম তিনি কর্মস্থলে নেই, তাহলে তার রোগীদের জন্য আমরা বিকল্প চিকিৎসকের ব্যবস্থা রাখতাম। কিন্তু তিনি কর্তৃপক্ষকে না জানিয়েই দেশের বাইরে চলে গিয়েছিলেন। সুতরাং এ ঘটনাটি আমরা মনে করি তার জন্যই হয়েছে। এমনকি যারা রোগীদের ইনফরমেশন দিয়েছেন তারা হাসপাতালের স্টাফ নন। তারা সংযুক্তা সাহার পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট, সুতরাং এর দায় সম্পূর্ণ সংযুক্তা সাহার।
সেন্ট্রাল হসপিটালের এই সিনিয়র ডেপুটি ডিরেক্টর বলেন, নিজেদের প্র্যাকটিস বাড়ানোর লক্ষ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে প্রচারণার হাতিয়ার বানিয়ে রোগী বা তাদের অভিভাবকদের আকর্ষণ করা সম্পূর্ণ অনৈতিক ও মেডিকেল ইথিক্স পরিপন্থি। কিন্তু সংযুক্তা সাহা সেই কাজটি নিয়মিত করেছেন। বিষয়টি আমাদের নজরে আসার পর বাকি সব চিকিৎসককে এ বিষয়ে হাসপাতালের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী সময়ে যদি কোনো চিকিৎসক এ ধরনের কোনো কার্যকলাপ করেন, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে হসপিটাল কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে।
সেন্ট্রাল হসপিটালের চিকিৎসায় অনিয়মকাণ্ডে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস: সেন্ট্রাল হাসপাতালে চিকিৎসায় অনিয়মের বিষয়ে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের উদ্বোধনকালে তিনি এ কথা জানান। তিনি বলেন, সেন্ট্রাল হাসপাতালে চিকিৎসায় অনিয়ম তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা হাসপাতালে গিয়ে বিস্তারিত খোঁজখবর নেবেন। দ্রুত সময়ের মধ্যে তদন্ত শেষ করে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এ সময় মন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি ডা. মো. জামাল উদ্দিন ও মহাসচিব অধ্যাপক ডা. মো. কামরুল হাসান মিলন প্রমুখ।
অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা গেছেন আঁখি: ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মোখলেসুর রহমান গতকাল আঁখি ও তার সন্তানের মরদেহের ময়নাতদন্ত করেন। তিনি বলেন, আঁখি অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা গেছেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য মরদেহ থেকে বিভিন্ন অর্গান রাখা হয়েছে। সেগুলোর রিপোর্ট এলে ময়নাতদন্তের পূর্ণ প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।
আঁখির চাচা শফিকুর রহমান মজুমদার জানান, আঁখি ও তার নবজাতক সন্তানের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে তাদের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার গায়নের ডহরা গ্রামে। সেখানে আঁখির বাবার কবরের পাশেই দাফন করা হবে তাদের।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ঘেরাওয়ের ঘোষণা আঁখির সহপাঠীদের: আঁখি ও তার সন্তানের মৃত্যুর ঘটনার বিচার ও ক্ষতিপূরণসহ চার দফা দাবি জানানো হয়েছে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এসব দাবি না মানা হলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ঘেরাওয়ের ঘোষণা দিয়েছেন আঁখির সহপাঠীরা। গতকাল সোমবার রাজধানীর গ্রিন রোডে সেন্ট্রাল হাসপাতালের সামনে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের ব্যানারে অনুষ্ঠিত মানববন্ধন থেকে এই আলটিমেটাম দেওয়া হয়।
মানববন্ধনে ঢাকা কলেজের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী নাজমুল হাসান বলেন, আঁখির মৃত্যুর জন্য দায়ী সেন্ট্রাল হাসপাতালের সবাইকে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। ইডেনের শিক্ষার্থী তাসনুমা পিয়া বলেন, আমাদের দাবি যারা এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত তাদের শাস্তির আওতায় আনা হোক। অন্যথায় আমরা কঠোর আন্দোলনে যাব।
গত ৯ জুন আঁখিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রসবের কিছুক্ষণ পর মারা যায় তার সন্তান। এরপর গত রোববার মৃত্যু হয় আঁখির।
মন্তব্য করুন