আইনি প্রক্রিয়া সম্পর্কে দুই পক্ষের অনড় ভূমিকার কারণে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। সরকার বলছে, খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিতে হলে তাকে আদালতের অনুমতি নিতে হবে। তবে বিদেশে পাঠানোর অনুমতির জন্য আদালতে যেতে রাজি নয় খালেদা জিয়ার পরিবার ও বিএনপি। তাদের দাবি, সরকার চাইলেই তাকে বিদেশে পাঠানোর অনুমতি দিতে পারে।
জানা গেছে, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়ার বিষয়ে আশাবাদী হয়ে উঠেছিল তার পরিবার। শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হতে পারে—সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে কথাবার্তা বলে এমনটাই ধারণা হয়েছিল তাদের। চিকিৎসার জন্য কোন দেশে নেওয়া যায়, সে বিষয়ে খোঁজখবরও শুরু করেছিলেন তারা। তবে আইনি প্রক্রিয়া ও শর্ত আরোপের প্রশ্নে পরিবারের সদস্যরা রাজি না থাকায় খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানোর বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
জানা যায়, গত ২৫ সেপ্টেম্বর খালেদা জিয়ার ছোট ভাই শামীম ইস্কান্দার বোনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়ার অনুমতি চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেন। এরপর খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর প্রশ্নে ইতিবাচক মনোভাব নিয়েই অগ্রসর হচ্ছিল সরকার। তাকে কোন দেশের হাসপাতালে পাঠানো যায়, তা নিয়েও চলছিল আলোচনা। গত সোমবার সচিবালয়ে এ ইস্যুতে গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার প্রধানদের সঙ্গে কয়েকজন মন্ত্রীর বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়। খালেদা জিয়াকে কোন দেশের হাসপাতালে চিকিৎসা করানো যায়, বিএনপির পক্ষ থেকেও সে ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছিল। সরকারের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছিল, খালেদা জিয়ার ভাইয়ের আবেদনটি অল্প সময়ের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।
এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম ভয়েস অব আমেরিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে হলে এখন যে সাজা স্থগিত করে তাকে বাসায় থাকার অনুমতি দিয়েছি, তা প্রত্যাহার করে নিতে হবে। আবার তাকে জেলে যেতে হবে,
আদালতে যেতে হবে। আদালতের কাছ থেকে তাকে অনুমতি নিতে হবে।’
সংশ্লিষ্টদের মতে, প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে খালেদা জিয়ার বিষয়ে সরকারের মনোভাব ব্যক্ত হয়েছে। তাকে বিদেশে পাঠাতে হলে আদালতের মাধ্যমেই সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে।
অন্যদিকে খালেদা জিয়া কোনো শর্ত মেনে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে চান না বলে তার পরিবারের একটি সূত্র জানিয়েছে। সরকারের নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়া সাময়িক মুক্তি পাওয়ায় তার আইনজীবীরা এ ইস্যুতে আদালতে যেতে চান না।
মূলত আদালতে যাওয়া-না যাওয়া নিয়ে দুপক্ষের পরস্পরবিরোধী অবস্থানের কারণেই খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানোর জটিলতা কাটছে না বলে জানা গেছে।
গতকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘আইনি প্রক্রিয়া মোকাবিলা করে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বিদেশে চিকিৎসা নিতে পারবেন।’
তিনি জানান, খালেদা জিয়াকে বিদেশ নিতে তার ভাইয়ের করা আবেদনে জটিলতা থাকায় তা আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তারা মতামত দিলে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে এ জন্য তাকে আইনি প্রক্রিয়া মোকাবিলা করতে হবে।
আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল শনিবার সাংবাদিকদের বলেছেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে করা আবেদনের বিষয়ে মতামত জানানো হবে রোববার (আজ)।
এদিকে খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা বলছেন, যেহেতু নির্বাহী আদেশে সাজা স্থগিত করে খালেদা জিয়াকে সাময়িক মুক্তি দেওয়া হয়েছে, সে কারণে এখানে আদালতের কোনো বিষয় নেই। সরকারই তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর অনুমতি দিতে পারে।
খালেদা জিয়ার আইনজীবী ব্যারিস্টার কায়সার কামাল কালবেলাকে বলেন, ‘একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, খালেদা জিয়া নির্বাহী আদেশে সাময়িক মুক্তি পেয়েছেন। উনি হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টের আদেশে মুক্তি পাননি। অতএব, এখানে আদালতের কোনো বিষয় নেই। পুরোটাই সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আইনে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা প্রয়োগের মাধ্যমে সরকার নির্বাহী আদেশে কোনো আসামির কারাবাস স্থগিত করতে পারে। সেটা শর্তযুক্ত অথবা শর্তহীনভাবে। ৪০১ ধারা অনুযায়ী যেহেতু নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়াকে শর্তসাপেক্ষে সাময়িক মুক্তি দেওয়া হয়েছে, এখন শর্ত উঠিয়ে নিলেই হয়ে গেল। সেক্ষেত্রে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ায় আর কোনো বাধা থাকবে না। বিষয়টি পুরোপুরি সরকারের হাতে।’
লিভার জটিলতা ছাড়াও ৭৮ বছর বয়সী সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ফুসফুস, কিডনি, হৃদরোগ, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে। গত ৯ আগস্ট গুলশানের বাসা ফিরোজায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্তে তাকে বসুন্ধরার এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ৫২ দিন ধরে তিনি ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। বর্তমানে করোনারি কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ) সেটঅ্যাপে কেবিনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. শাহাবুদ্দিন তালুকদারের নেতৃত্বে ১৯ সদস্যের একটি মেডিকেল বোর্ড তাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখে চিকিৎসা দিচ্ছে।
খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন বলেছেন, ‘বোর্ডের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, উনার লিভার প্রতিস্থাপন জরুরি হয়ে পড়েছে। সেজন্য তাকে দ্রুত বিদেশে উন্নত মাল্টিডিসিপ্লিনারি সেন্টারে পাঠানো দরকার।’
দুর্নীতির দুই মামলায় সাজাপ্রাপ্ত খালেদা জিয়া ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাবন্দি হন। দুই বছরের বেশি সময় কারাবন্দি ছিলেন তিনি। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে পরিবারের আবেদনে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সরকার নির্বাহী আদেশে সাজা স্থগিত করে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দিয়েছিল। এরপর পরিবারের আবেদনে ছয় মাস পরপর তার সাজা স্থগিত করে মুক্তির মেয়াদ বাড়াচ্ছে সরকার। সর্বশেষ গত ১২ সেপ্টেম্বর খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত করে মুক্তির মেয়াদ আরও ছয় মাস বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।