আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে—এমনটা ধরে নিয়েই নেতাকর্মীদের প্রস্তুতি নিতে নির্দেশনা দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পরিবর্তে এটিকে বিতর্কিত ও বানচাল করার দিকেই বিএনপি নজর বেশি দিতে পারে—এমন আশঙ্কা থাকায় এই চক্রান্ত প্রতিহত করতেও নেতাকর্মীদের প্রস্তুত থাকতে বলেছে আওয়ামী লীগ। এ ছাড়া নির্বাচন ঘিরে বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের তৎপরতা প্রসঙ্গে অশোভন ও অশালীন বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে গণভবনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় এসব নির্দেশনা দেওয়া হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে আওয়ামী লীগের এক নেতা কালবেলাকে বলেন, বিএনপি নির্বাচনে আসতে পারে ধরে নিয়েই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিয়েছেন দলের সভাপতি শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, দলটি নির্বাচনে অংশ নিলে অবশ্যই মনোনয়ন বাণিজ্য করবে এবং যত উপায়ে সম্ভব নির্বাচনকে বিতর্কিত করবে। নির্বাচন বানচাল করার পরিকল্পনাও তাদের রয়েছে, সেজন্য তারা তপশিল ঘোষণার পরপরই সারা দেশে নাশকতা শুরু করতে পারে। সেজন্য নেতাকর্মীদের প্রস্তুত থাকতেও নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
দলের সভাপতিমণ্ডলীর একজন সদস্য জানান, তৃণমূলে বিএনপির বাড়াবাড়ি (অরাজকতা) বন্ধ করার জন্য আরও কড়া পাহারায় থাকতে বলেছেন দলীয়প্রধান। তিনি বলেছেন, সংসদ নির্বাচন ভন্ডুলের চক্রান্ত যে কোনো মূল্যে প্রতিরোধ করতে এবং এদের পরাজিত করতে হবে। এটাই তার মূল নির্দেশনা।
আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ অনেকটা এগিয়ে আছে জানিয়ে বৈঠকে উপস্থিত একজন নেতা জানান, যারা আসন্ন নির্বাচনে ভোট বাড়াতে পারবেন তাদেরই নৌকার প্রার্থী হিসেবে চূড়ান্ত মনোনয়ন দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন দলের সভাপতি। এ-সংক্রান্ত আসনভিত্তিক সার্বিক তথ্য, বিভিন্ন দেশি-বিদেশি সংস্থার প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করেই চূড়ান্ত মনোনয়ন দেওয়া হবে।
এ ছাড়া কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে নেতারা বিভিন্ন জেলায় নাশকতা, দলীয় সমস্যা, নিয়মবহির্ভূতভাবে কমিটি ভাঙা ও গঠন করা নিয়ে বিভিন্ন অভিযোগ উপস্থাপন করেন। কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের কমিটি অর্থমন্ত্রী দ্বারা তিনবার বিলুপ্ত করা ও গঠন নিয়ে অভিযোগ দেয়। একই সঙ্গে লালমনিরহাটে বিএনপির নেতা আসাদুল হাবীব দুলুর পুনরায় অত্যাচার-নির্যাতন, রংপুরে আওয়ামী লীগ নেতাকে বিএনপি কর্তৃক হত্যা, বগুড়ায় নাশকতা বৃদ্ধির বিষয় উত্থাপন করলে প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় টিমসহ সবাইকে সক্রিয় হতে নির্দেশ দেন। সম্মেলন ছাড়া কমিটি গঠনের এখতিয়ার কারও নেই বলেও হুঁশিয়ার করেন। একই সঙ্গে কোথায় কোথায় অগ্নিসন্ত্রাসীরা নাশকতা ও অরাজকতা করছে, তা নিয়ে কাজে মাঠে নেমে যেতে নির্দেশ দেন।
বৈঠকে তিন সাংগঠনিক সম্পাদক বিভাগীয় প্রতিবেদন দাখিল করেন। নির্বাচন পর্যন্ত নতুন করে কোনো কমিটি গঠন ও বিলুপ্ত না করতে নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে দলের ৮টি বিভাগীয় সাংগঠনিক টিমকে সক্রিয় হতে নির্দেশ দেন। বিএনপির নেতৃত্বে যে অগ্নিসংযোগ, নাশকতা চলছে—তা রোধে আওয়ামী লীগের আটটি বিভাগীয় কমিটিকে আরও সক্রিয় হয়ে প্রতি বিভাগে, জেলায় গিয়ে সতর্ক পাহারার বিষয়টি আরও জোরদার করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে জেলা, থানা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের সংগঠনগুলোকে সুসংগঠিত করতে নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন নেতারা।
বৈঠকে আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে দলের সভাপতি শেখ হাসিনাকে চেয়ারম্যান এবং সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে সদস্য সচিব করা হয়। তবে কো-চেয়ারম্যান হিসেবে প্রয়াত এইচটি ইমামের স্থলাভিষিক্ত কে হবেন, সেই সিদ্ধান্ত হয়নি। এই সিদ্ধান্তের ভার শেখ হাসিনার ওপর ন্যস্ত করেন কেন্দ্রীয় নেতারা। নির্বাচন পরিচালনা কমিটিতে দলের কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের রাখা হয়েছে। একই সঙ্গে প্রচার, দপ্তর, অর্থ, আইনসহ ১৪টি উপকমিটি গঠনেরও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পরদিনই আওয়ামী লীগ দলীয় মনোনয়নপত্র বিক্রি শুরু করবে বলে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়। এজন্য বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ১০টি বুথ করার সিদ্ধান্ত হয়। ঢাকা ও চট্টগ্রামের জন্য দুটি করে, অন্যান্য বিভাগের জন্য একটি করে বুথে মনোনয়নপত্র বিক্রি হবে। মনোনয়নপত্রের দাম গত নির্বাচনের চেয়ে ২০ হাজার টাকা বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা চূড়ান্ত করা হয়েছে।
এ ছাড়া এবারই প্রথম সশরীরে মনোনয়নপত্র সংগ্রহের পাশাপাশি অনলাইনেও সংগ্রহের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। দলের কোনো কোনো সদস্য অনলাইনে মনোনয়নপত্র বিক্রিতে জোর দেওয়ার কথা বললেও দলের জ্যেষ্ঠ সদস্যরা দ্বিমত পোষণ করেন। দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, সশরীরে মনোনয়নপত্র বিক্রি ও জমা না দিলে নির্বাচন জমে ওঠে না। তার বক্তব্যকে সমর্থন করে সভাপতি শেখ হাসিনা অনলাইনের চেয়ে অফলাইনে মনোনয়ন বিক্রির বিষয়ে জোর দেন।
বৈঠক শেষে গণভবনের বাইরে সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, নাশকতা, গাড়ি ভাঙচুর ও নির্বাচন ভন্ডুল করার অপচেষ্টা যতক্ষণ চলবে ততক্ষণ সরকারের পাশাপাশি সারা দেশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সতর্ক পাহারায় থাকবে। তিনি আরও বলেন, নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পরপরই আওয়ামী লীগ মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরু করবে। নির্বাচন পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান শেখ হাসিনা। কো-চেয়ারম্যানের পদ পূরণ হয়নি। আমি সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করব।