কবির হোসেন
প্রকাশ : ২৫ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৫ জুন ২০২৩, ০৮:৩৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

জেরিনের প্রেম যেন সিনেমার গল্প

চলছে আইনি লড়াই
জেরিন ও তার স্বামী তুষার। ছবি : সংগৃহীত
জেরিন ও তার স্বামী তুষার। ছবি : সংগৃহীত

সপ্তম শ্রেণিতে লেখাপড়ার সময় তাসনিন জেরিন স্নেহা প্রেমে পড়েন তুষার সরকারের। মিরপুর গার্লস আইডিয়াল ল্যাবরেটরি ইনস্টিটিউটের তখনকার এই ছাত্রী পালিয়ে যান তুষারের সঙ্গে। অপরিণত বয়সেই (১৩ বছরের বেশি) বিয়ে করেন তুষারকে। ঢাকার মিরপুর থেকে পালিয়ে যান চাঁদপুরে। মিরপুরের ১০ নম্বর সেকশন ও সি-ব্লকের বিশাল বিত্তশালী বাবার একমাত্র মেয়ে জেরিন। অন্যদিকে তুষার একই সেকশনে ইন্টারনেটের সংযোগ প্রদানকারী একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। কোনোভাবেই মেয়ের বাবা এ ঘটনা মেনে নিতে পারেননি। ২০১৮ সালের ২ ডিসেম্বর তুষার ও তার পরিবারের আরও ৫ সদস্যের বিরুদ্ধে মিরপুর মডেল থানায় অপহরণ মামলা করেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জোরে মেয়েকে বাসায় ফিরিয়ে আনেন। পলাতক খাকেন তুষার। চলতে থাকে অপহরণ মামলার বিচার।

বিচার চলাকালে মেয়েটি তার জবানবন্দিতে আদালতকে বলেন, ‘তুষারের সঙ্গে আমার ৯ মাস ধরে প্রেমের সম্পর্ক। স্কুল ফাঁকি দিয়ে প্রায়ই তুষারের সঙ্গে ধানমন্ডি লেকসহ বিভিন্ন জায়গায় দেখা করতাম। ২০১৮ সালের ১৪ আগস্ট গোপনে তুষারের সঙ্গে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হই।’ কিন্তু মেয়ে অপ্রাপ্তবয়স্ক (১৮ বছরের নিচে) হওয়ায় আদালতে তার বিয়ে বৈধ হয়নি। ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৮ বিচার শেষে তুষারকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন গত বছরের ১২ জুন। এরই মধ্যে সময় পার হয়েছে। জেরিন এখন প্রাপ্তবয়স্ক। এবার গত ১৯ ফেব্রুয়ারি কলেজ থেকে ফের সাজাপ্রাপ্ত তুষারের সঙ্গে পালিয়ে যান জেরিন। প্রাপ্তবয়স্ক জেরিন নতুন করে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন। কক্সবাজারে শুরু করেন সংসার। মধুচন্দ্রিমা পার করে অন্তঃসত্ত্বাও হয়েছেন জেরিন। এরই মধ্যে হঠাৎ আবার বিষাদের ছায়া। গত ৫ জুন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অপহরণ মামলায় সাজাপ্রাপ্ত তুষারকে গ্রেপ্তার করে। পাঠানো হয়েছে জেলহাজতে। অপরিণত বয়সের প্রেম সফল করতে এবার পরিণত বয়সে জেরিন শুরু করেছেন আইনি লড়াই।

জেরিন কালবেলাকে বলেন, ‘ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ার কারণে বয়সের একটা গ্যাপ আছে। প্রথম যখন বিয়ে হয় তখনই বয়স ১৯ ছিল। কিন্তু বাবা মিথ্যা মামলা করার জন্য ১৩ বছর বয়স দেখিয়েছেন। এখন আমার বয়স ২৩ বছর। তিনি আরও বলেন, স্বামী মধ্যবিত্ত পরিবারের হওয়ায় আমার বিশাল বিত্তশালী বাবা মেনে নিতে পারেননি। আমাদের মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে অর্থ-সম্পদই বড় বাধা। বাবা চার বছর ধরে আমাকে অনেক নির্যাতন করেছেন। আর সহ্য করতে পারছি না। বাবার কাছে ফেরত যেতে চাই না। স্বামীর সঙ্গে সুখে-শান্তিতে সংসার করতে চাই।’

জানা যায়, জেরিন ও তার শ্বশুর মনির সরকার হাইকোর্টে এসে আইনজীবী হিসেবে বেছে নেন ব্যারিস্টার আশরাফ রহমানকে। এই আইনজীবী মামলাটির সাজার রায় বাতিল চেয়ে আবেদন করেন তুষারের পক্ষে। এই বাতিল আবেদনে বলা হয়েছে, তদন্ত কর্মকর্তা ২০১৯ সালের ২৮ মে তুষার এবং আরও দুজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠন করে আদালত বিচার শুরু করেন। অভিযোগ গঠনের দিন তুষার পলাতক ছিলেন। এ মামলার বিচার চলাকালে বাদীপক্ষের ৫ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য নেওয়া হলেও আসামিপক্ষে কারও সাক্ষ্য নেওয়া হয়নি। সাজাপ্রাপ্ত তুষার এ মামলা সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। আবেদনকারী নির্দোষ। সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে ৫ জুন পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এরপর তিনি প্রথম এই মামলা এবং রায় সম্পর্কে জানতে পারেন।

আবেদনে আরও বলা হয়েছে, ভিকটিমের জবানবন্দি অনুযায়ী যেহেতু তার সঙ্গে একটা প্রেমের সম্পর্ক ছিল এবং তিনি নিজ ইচ্ছায় তুষারের সঙ্গে গিয়েছেন। সেহেতু এখানে অপহরণের কোনো ঘটনা ঘটেনি। এ মামলায় কোনো প্রত্যক্ষ সাক্ষীও ছিল না। মামলার এক নম্বর সাক্ষী হচ্ছেন বাদী (মেয়ের বাবা), দুই নম্বর সাক্ষী হচ্ছেন ভিকটিম (জেরিন), তিন নম্বর সাক্ষী হচ্ছেন বাদীর প্রতিবেশী এবং ৪ ও ৫ নম্বর সাক্ষী হচ্ছেন তদন্ত কর্মকর্তা। মামলার মোট ১১ জন সাক্ষীর মধ্যে ৫ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেই রায় দিয়েছেন এবং এ ক্ষেত্রে বিচারক তার বিচারিক মনের প্রয়োগ করেননি। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ২(খ) ধারা অনুযায়ী ‘অপহরণ অর্থ বলপ্রয়োগ বা প্রলুব্ধ করিয়া বা ফুসলাইয়া বা ভুল বুঝাইয়া বা ভীতি প্রদর্শন করিয়া কোনো স্থান হইতে কোনো ব্যক্তিকে অন্যত্র যাইতে বাধ্য করা।’ কিন্তু এ ক্ষেত্রে সাজাপ্রাপ্ত তুষার জোরপূর্বক ভিকটিমকে উঠিয়ে নিয়ে যাননি এবং কোনো ভয়ভীতিও প্রদর্শন করেননি। এ কারণে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের এই রায় বাতিলযোগ্য।

এ আবেদনের শুনানিকালে অন্তঃসত্ত্বা জেরিন নিজেই গত সোমবার হাইকোর্টে হাজির হন। সেদিন জেরিন আদালতকে বলেন, ‘তুষারের সঙ্গে আমার প্রেমের সম্পর্ক। আমি স্বেচ্ছায় তুষারের সঙ্গে চলে এসেছি এবং বিয়ে করেছি। আমার স্বামী ও শ্বশুর গরিব হওয়ায় আমার বাবা মেনে নেননি। হাইকোর্ট মেয়েটির কাছে জানতে চেয়েছিলেন, এখন তিনি কোথায় থাকেন? জবাবে জেরিন আদালতকে বলেন, ‘আমার এক আন্টির বাসায় আছি।’ শ্বশুরের বাড়িতে নেই কেন জানতে চাইলে তিনি আদালতকে জানান, ‘আমার বাবা শ্বশুরকে এলাকাছাড়া করেছেন।’ পরের দিন জেরিন হাইকোর্টে হাজির হওয়ার পর তার মা-বাবাকে দেখে পালিয়ে যান। তবে সেদিন (২০ জুন) প্রাথমিক শুনানি শেষে হাইকোর্টের বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হক এ মামলায় তুষারকে জামিন দেন। একই সঙ্গে তার সাজার রায় কেন বাতিল ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। এ ছাড়া ২ লাখ টাকা জরিমানার আদেশ স্থগিত করেছেন। আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানিতে সিনিয়র আইনজীবী হিসেবে ছিলেন ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল।

এই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে আবেদন জানায়। গত বৃহস্পতিবার আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকীর আদালত রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে ‘নো অর্ডার’ আদেশ দেন। তুষারের জামিন আপিল বিভাগেও বহাল রয়েছে। এখন তার কারামুক্তির অপেক্ষা।

জানতে চাইলে এ মামলার মূল আইনজীবী ব্যারিস্টার আশরাফ রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘এ মামলার গল্প সিনেমার গল্পকেও হার মানায়। বিত্তশালী পরিবারের এই মেয়ের বাবার ঢাকায় কমপক্ষে ৭টি বাড়ি আছে। মেয়েটি তার প্রতিবেশী এক ছেলে, যে ইন্টারনেট লাইনের কাজ করে তার সঙ্গে প্রেম হয়। স্কুল থেকে পালিয়ে তারা বিয়ে করে। যেহেতু ১৩ বছরের মেয়ে, তাই তাদের কোর্ট ম্যারেজ বৈধ নয়। মেয়ের বাবা থানায় অপহরণের মামলা করে ছেলে, ছেলের বাবা, বোন ও বোন জামাইয়ের নামে এবং পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে পাঠায়। পুলিশের সহযোগিতায় মেয়েকে চাঁদপুর থেকে ধরে আনেন এবং ছেলে পালিয়ে যায়। বিচার শেষে তুষার ছাড়া সবাইকে আদালত খালাস দেন। পলাতক তুষারকে যাবজ্জীবন সাজা ও ২ লাখ টাকা জরিমানা করেন আদালত। এত দিনে ১৩ বছরের মেয়েটি প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে যায় এবং ২০২৩ সালে এসে মেয়েটি কলেজ ফাঁকি দিয়ে সাজাপ্রাপ্ত ছেলের সঙ্গেই আবার পালিয়ে বিয়ে করে কক্সবাজার চলে যান। এরই মধ্যে মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা হয়। অতঃপর পুলিশ যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত স্বামীকে কক্সবাজার থেকে গ্রেপ্তার করে জেলে প্রেরণ করে।

তিনি আরও বলেন, হাইকোর্টে শুনানিকালে মেয়ে নিজেই এসে আদালতে তার বক্তব্য দেন। রাষ্ট্রপক্ষ তীব্র বিরোধিতা করলে ও বয়স নিয়ে সন্দেহ তুললে আদালত পরের দিন আদেশের জন্য রাখেন। হাইকোর্ট মেয়ের বক্তব্য শুনে এবং আমাদের বক্তব্য ও আইনি বিশ্লেষণে সন্তুষ্ট হয়ে আদালত আসামিকে মাত্র ১৫ দিনের মাথায় জামিন মঞ্জুর করেন। আপিল বিভাগও তার জামিন বহাল রেখেছেন।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বাসাবোতে নির্মাণাধীন ভবন থেকে পড়ে তিন শ্রমিকের মৃত্যু 

শেখ হাসিনা: স্বাধীন বাঙালির অনিঃশেষ প্রেরণা

রাজধানীর সড়কে প্রাণ গেল তরুণীর

নির্বাচনী প্রচারণার মাঠের পাশেই ককটেল বিস্ফোরণ, গ্রেপ্তার ৫

জনতার মুখোমুখি হলেন চেয়ারম্যান প্রার্থীরা

‘বিএনপি পাকিস্তানের দালাল হয়ে জনগণকে শোষণ ও অত্যাচার করত’

দিঘিতে মিলল এক মণ কোরাল মাছ

চবিতে ঝরনার নেমে স্কুলশিক্ষার্থীর মৃত্যু

ভালো ফলনের পরও হতাশ কৃষক

কিশোর গ্যাংবিরোধী র‌্যালিতে গ্যাং লিডার মিজান

১০

সাহাবির তিলাওয়াতে যে কারণে দিগ্‌বিদিক ছুটছিল ঘোড়া

১১

গ্রাম থেকে আসা নারীদের টার্গেট করে তারা

১২

শেখ হাসিনার হাতেই গণতন্ত্র সুরক্ষিত : খাদ্যমন্ত্রী

১৩

যুক্তরাজ্যে অবৈধ বাংলাদেশিদের জন্য দুঃসংবাদ

১৪

ঢাবি শিক্ষার্থীদের ফ্রিতে আইএলটিএস কোর্স করাবে মাস্টারমাইন্ড

১৫

হ্যাক হওয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ফিরিয়ে দেবে মেটা 

১৬

ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপ / ডাচ দলে চোটগ্রস্ত বার্সা তারকা

১৭

স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন

১৮

গাছতলায় জায়েদ খান

১৯

নিরব-রিফাতের ‘অবুঝ মনের প্রেম’

২০
X