একাত্তরে হত্যা, নির্যাতন, অপহরণসহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত ঝিনাইদহ সদর উপজেলার হলিধানী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রশিদ মিয়া। বর্তমানে তার বিচার চলছে যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালে। অভিযুক্ত এই রাজাকার মামলা দায়েরের আগ পর্যন্ত ছিলেন ওই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি। নৌকা প্রতীকের ব্যানারে তাকে বানানো হয়েছিল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও। ছিলেন এলাকার একজন দাপুটে প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা। অভিযোগ রয়েছে, কুখ্যাত এই রাজাকারের আওয়ামী লীগের পদপদবি এবং নৌকা প্রতীকে নির্বাচনের সুযোগ পাওয়ার পেছনে রয়েছেন স্থানীয় এক এমপি।
মামলার বাদীপক্ষের অভিযোগ, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ঝিনাইদ-১ আসনের এমপি আব্দুল হাইয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় রাজাকার আব্দুর রশিদ এখনো বেপরোয়া। গ্রেপ্তার হওয়ার পর এক বছরের মধ্যে ট্রাইব্যুনাল থেকে জামিন পান। এরপর থেকে মামলা তুলে নিতে নানা হুমকি-ধমকি চলছে। এজন্য থানায় জিডিও করা হয়। প্রশাসন বরাবরও দেওয়া হয়েছে লিখিত অভিযোগ। রশিদের বিচার বাধাগ্রস্ত করতে এখনো নানা চেষ্টা করে যাচ্ছেন এমপি আব্দুল হাই। এ অবস্থায় অভিযুক্ত রাজাকারদের ফাঁসির দাবি জানিয়ে দ্রুত বিচারকাজ শেষ করার আহ্বান জানিয়েছে বাদীপক্ষ।
মামলার বাদী আনোয়ার হোসেন কালবেলাকে বলেন, আমার বাবা আজিবার মণ্ডল মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ায় রাজাকার আব্দুর রশিদ, সাহেব আলী মালিথা ও আসমত আলীর নেতৃত্বে অন্য রাজাকাররা ধরে নিয়ে হত্যা করেন। তারা লাশটাও গুম করেন। আমরা বাবার লাশ খুঁজে পাইনি। এই মামলার এক নম্বর আসামি আব্দুর রশিদ মিয়াকে সহযোগিতা করছেন স্থানীয় একজন সংসদ সদস্য। তার সুপারিশে এই রাজাকার নৌকা প্রতীক পেয়ে ইউপি চেয়ারম্যান হয়েছেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় অথচ একজন রাজাকার নৌকা প্রতীকে চেয়ারম্যান হলেন! প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার আবেদন, এমন সংসদ সদস্যকে যেন কোনো পদপদবি ও মনোনয়ন না দেওয়া হয়। আর যেন মুক্তিযোদ্ধাকে অপমান করা না হয়। আমি আমার বাবা হত্যার সুষ্ঠু বিচার চাই।
শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিবর মণ্ডলের মেয়ে সুফিয়া খাতুন কালবেলাকে বলেন, আমার বাবা ও দুই চাচাকে ধরে নিয়ে হত্যা করেন রাজাকার আব্দুর রশিদ, সাহেব আলী ও আসমত আলী। তাদের পুড়িয়ে নাকি গুলি করে মেরেছে, জানি না। লাশটাও আমাদের দেয়নি। এসব রাজাকারকে রক্ষা করতে আব্দুল হাই এমপি উঠেপড়ে লেগেছেন। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, আমার বাবার হত্যাকারী রাজাকারদের ফাঁসি চাই।
ঝিনাইদহ জেলা সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সভাপতি ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা কামালুজ্জামান কামাল কালবেলাকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা বিরোধিতা করেছেন, পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করে মুক্তিযোদ্ধাদের ধরিয়ে দিয়েছেন, মা-বোনদের ইজ্জত লুণ্ঠন করেছেন, সেরকম একজন হলেন হলিধানী ইউনিয়নের আব্দুর রশিদ। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে এই রাজাকার আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। এর জন্য আমাদের কিছু নীতিভ্রষ্ট কিছু আওয়ামী লীগ নেতা দায়ী। তাদের কারণে রাজাকার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন। শহীদ এক মুক্তিযোদ্ধার পরিবার যখন তার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন, তখন তিনি ৩০-৪০টি বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছেন। বিচার চাওয়ায় মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে বিভিন্ন সময়ে নির্যাতন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, আব্দুর রশিদ কোনো সময় আওয়ামী লীগের নেতা নন। দলের মধ্যে আত্মগোপনকারী একজন খুনি, যুদ্ধাপরাধী। নীতিভ্রষ্ট নেতাদের কারণে এসব লোকজন আওয়ামী লীগের নাম ব্যবহার করে মামলা থেকে জামিন নিয়েছেন। এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়া দরকার। মামলা হওয়ার পরও যুদ্ধাপরাধী রশিদকে আওয়ামী লীগের ভেতরে প্রশ্রয় দেওয়ার ঘটনায় যারা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত, সেসব নেতা কোনোভাবেই তাদের দায় এড়াতে পারেন না। এ বিষয়ে জানতে মোবাইলে বারবার ফোন করে এবং হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দিয়েও এমপি আব্দুল হাইয়ের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
জানা যায়, একাত্তরে রাজাকার বাহিনীর হাতে হলিধানী ইউনিয়নের কোলা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আশির উদ্দীনের পরিবার নির্যাতনের শিকার হয়। ওই পরিবারের তিন সদস্য মুক্তিযোদ্ধা আজিবর মণ্ডল, হবিবার মণ্ডল ও আনসার মণ্ডলকে হত্যা করেন রাজাকাররা। পরে নিহতের স্বজনরা তাদের লাশও খুঁজে পায়নি। ২০০৯ সালের ২৫ মার্চ সদর উপজেলার কোলা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ও সেনাবাহিনীর সাবেক সদস্য মরহুম আশির উদ্দীন রাজাকারদের বিরুদ্ধে ঝিনাইদহ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন। আদালত মামলাটি প্রাথমিক অনুসন্ধান করে ঝিনাইদহ সদর থানার ওসিকে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন; কিন্তু সেই মামলা রাজনৈতিক চাপে তুলে নিতে বাধ্য হন। পরে ২০১৫ সালে নিহত আজিবর মণ্ডলের ছেলে আনোয়ার হোসেন অভিযোগ দাখিল করেন ঢাকার যুদ্ধাপরাধ বিচার ট্রাইব্যুনালে।
এ অভিযোগের ওপর ২০১৬ সালের ২৭ জুন তদন্ত শুরু হয়। তদন্ত শেষ হয় ২০১৯ সালের ২৮ নভেম্বর। তথ্য প্রমাণে অভিযোগের সত্যতা উঠে আসায় তদন্ত চলাকালেই ২০১৯ সালের ১৯ নভেম্বর আব্দুর রশিদ মিয়াকে ইউপি চেয়ারম্যান পদ থেকে বহিষ্কার করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। একই মাসে আওয়ামী লীগ থেকেও বহিষ্কার করা হয় তাকে। এর দুদিন পর ২১ নভেম্বর গ্রেপ্তার হন আব্দুর রশিদ। একই বছরের ২৮ নভেম্বর রশিদসহ চারজনের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ অভিযোগের তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। আসামিদের মধ্যে মো. আব্দুর রশিদ মিয়া (৭০) ও মো. সাহেব আলী মালিথাকে (৭২) কারাগারে পাঠানো হয়। অন্য দুজন পলাতক থাকায় তদন্ত সংস্থা তাদের নাম প্রকাশ করেনি।
সংস্থার তৎকালীন প্রধান সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান খান আসামিদের রাজনৈতিক পরিচয় তুলে ধরে বলেছিলেন, মো. আব্দুর রশিদ মিয়া মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির কৃষক সংগ্রাম সমিতির হলিধানী ইউনিয়নের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এরপর যোগ দেন আওয়ামী লীগে। মামলাটিতে এরই মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। আসামিপক্ষের সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ২৯ নভেম্বর দিন ধার্য রয়েছে বলে জানান ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রেজিয়া সুলতানা চমন।
আসামিদের বিরুদ্ধে দুই অভিযোগ: ১৯৭১ সালের ১৭ জুন মো. আব্দুর রশিদ মিয়ার নেতৃত্বে সহযোগী সাহেব আলী মালিথা, পলাতক আসামিসহ ১০ থেকে ১৫ রাজাকার কোলা গ্রামে শহীদ আজিবর মণ্ডলের বাড়ি আক্রমণ করে। এ সময় মুক্তিযোদ্ধা মহির উদ্দিন মণ্ডল ও আসির উদ্দিন মণ্ডলকে না পেয়ে তাদের তিনভাই আজিবর, হবিবর রহমান মণ্ডল ওরফে হাবা মণ্ডল ও আনছার মণ্ডলকে আটক ও মারধর করে। পরে তাদের পিঠমোড়া করে বেঁধে ঝিনাইদহ শহরের দিকে নিয়ে যাওয়ার পর মাগুরা রোডের ধোপাঘাটা ব্রিজের ওপর গুলি করে হত্যার পর লাশ নবগঙ্গা নদীতে ফেলে দেয় আসামিরা। এ ছাড়া ১৯৭১ সালের ২৪ জুন আসামিরা মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী কোলা গ্রামের নিরীহ, নিরস্ত্র মুলুক চানকে তার বাড়ি থেকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার পর তার আর সন্ধান মেলেনি।