নতুন জঙ্গিগোষ্ঠী জামাআ’তুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার সঙ্গে পাহাড়ের বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগঠন কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) গোপন চুক্তিটি ছিল পাঁচ দফার। ২০২০ সালের মার্চে করা ওই চুক্তিতে শারক্বীয়ার পক্ষে স্বাক্ষর করেন সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা শামীন মাহফুজ এবং কেএনএফের পক্ষে সংগঠনটির প্রধান নাথান বোম। কক্সবাজারের কলাতলীর বে ওয়ার্ল্ড হোটেলে বসে ওই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। হাতে লেখা দুই পাতার ওই চুক্তিপত্রে দুপক্ষের চারজন সাক্ষী হিসেবে স্বাক্ষর করেন। শামীন মাহফুজকে গ্রেপ্তারের সময় উদ্ধার করা চুক্তিপত্রটি থেকে এ তথ্য পেয়েছেন কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের কর্মকর্তারা।
সিটিটিসির দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, ওই চুক্তির আওতায় শারক্বীয়া কেএনএফের মাধ্যমে অন্তত ৪২ লাখ টাকার আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি কিনেছিল। এসব অস্ত্র দিয়ে পাহাড়ে প্রশিক্ষণ শেষে তা দিয়ে সমতলে শারক্বীয়ার জঙ্গিরা সশস্ত্র হামলার পরিকল্পনায় ছিল। সিটিটিসির এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, কেএনএফের মাধ্যমে একে-৪৭ রাইফেল কেনার চেষ্টায় ছিল শারক্বীয়া। শামীনকে গ্রেপ্তারের পর সে দাবি করেছে, এই অস্ত্র মিয়ানমার থেকে তাদের হাতে আসার কথা ছিল; কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা সংগ্রহ করতে পারেনি।
ওই কর্মকর্তা বলেন, ৪২ লাখ টাকা খরচ করে শারক্বীয়া এরই মধ্যে একে-২২ রাইফেল, বিপুলসংখ্যক শটগান ও পাইপগান, কার্তুজ, গুলি ও বিস্ফোরক কিনেছে। এসব অস্ত্র দিয়েই তারা পাহাড়ে কুকি চিনের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল। এই অস্ত্র সমতলে কোনো নাশকতায় ব্যবহারের আগেই তাদের ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালাতে পেরেছে। অস্ত্রগুলো হয়তো গহিন পাহাড়ে রয়েছে। অবশ্য অনেক অস্ত্র-গোলাবারুদ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী উদ্ধারও করেছে।
কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের উপকমিশনার নাজমুল হক বলেন, শারক্বীয়ার প্রতিষ্ঠাতা শামীন মাহফুজ ও তার স্ত্রী নাজনীন সুলতানাকে গ্রেপ্তারের পর তাদের আদালতের মাধ্যমে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। তাদের কাছ থেকে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলেছে। এসব তথ্য যাচাই করা হচ্ছে।
যা আছে চুক্তিতে : পার্বত্য অঞ্চলে র্যাবের টানা অভিযানে একের পর এক আস্তানা আবিষ্কারের পর শারক্বীয়ার জঙ্গিদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছিল। গত বছরের অক্টোবরে বান্দরবান ও রাঙামাটির দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে অভিযান চালিয়ে ১০ জনকে গ্রেপ্তারের পরই র্যাব জানিয়েছিল, কেএনএফ ও শারক্বীয়ার মধ্যে সমঝোতা রয়েছে। জঙ্গিগোষ্ঠীটিকে পাহাড়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার চুক্তিও রয়েছে তাদের মধ্যে। তবে ওই চুক্তিপত্রে কী ছিল, তা তখন বিস্তারিত জানানো হয়নি। গত শুক্রবার শামীন মাহফুজকে গ্রেপ্তারের পর সিটিটিসি কর্মকর্তারা জানান, ওই চুক্তিপত্র তারা উদ্ধার করতে পেরেছেন। যদিও তাতে কী রয়েছে, তা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি।
সিটিটিসি সূত্র কালবেলাকে জানিয়েছে, হাতে লেখা দুই পাতার চুক্তিপত্রটিতে পাঁচটি দফা রয়েছে। এর প্রথম দফায় বলা হয়েছে, সংগঠন দুটি এক পক্ষ অন্য পক্ষের সঙ্গে এমনভাবে মিলিত থাকবে যে, তাদের দুপক্ষের শত্রুর বিরুদ্ধেও তারা একসঙ্গে থাকবে। কেএনএফ কোনো দিন তার বন্ধুপক্ষর কাছেও প্রকাশ করতে পারবে না যে শারক্বীয়া এখানে (পাহাড়ে) আছে। চুক্তির দ্বিতীয় দফায় বলা হয়, শারক্বীয়ার ‘মুজাহিদরা’ কেএনএফের মাধ্যমে অস্ত্র কিনতে পারবে। তবে অস্ত্রের বাজারমূল্যের চেয়ে সার্ভিস চার্জ হিসেবে কেএনএফকে ১৪ ভাগ বেশি অর্থ দিতে হবে। তৃতীয় দফায় বলা হয়, শারক্বীয়া চাইলে পাহাড়ে অস্ত্রসহ প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নিতে পারবে। সেক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ ভাতাসহ সব ধরনের খরচ শারক্বীয়া বহন করবে। সিটিটিসি সূত্র চতুর্থ দফাটি যাচাই-বাছাইয়ের স্বার্থে প্রকাশ করতে রাজি হয়নি। চুক্তির পঞ্চম ও শেষ দফায় বলা হয়েছে, দুপক্ষের মধ্যে কোনো ভুল বোঝাবুঝি হলে তা দুপক্ষের শীর্ষ নেতারা বসে সমাধান করবেন।
গ্রেপ্তার শামীন মাহফুজকে জিজ্ঞাসাবাদে সংশ্লিষ্ট সিটিটিসি সূত্র জানায়, নিষিদ্ধ জঙ্গিগোষ্ঠী আনসার আল ইসলামের জঙ্গিদের সঙ্গে শারক্বীয়ার জঙ্গিদের যোগসাজশ মিলেছে। শামীন মাহফুজ এক সময়ের আনসার আল ইসলামের শীর্ষ নেতা ইজাজ আহমেদের কাছ থেকে দীক্ষা নেন। ইজাজ কারগিল যুদ্ধে যাওয়ার আগে তাকে এই ‘বাইয়্যাত’ দিয়ে যান। সেখানেই তিনি ড্রোন হামলায় মারা যান। এর আগে নিজের স্ত্রী নাজনীন সুলতানাকে তালাক দেন এবং শামীন মাহফুজকে বিয়ের নির্দেশ দেন। সে অনুযায়ী নাজনীনকে বিয়ে করেন শামীন।
সিটিটিসি কর্মকর্তারা বলছেন, শারক্বীয়া এই অস্ত্র কেনা ও প্রশিক্ষণের লাখ লাখ টাকা পেল কোথায়, কারা তাদের অর্থায়ন করেছে—সে বিষয়েও কিছু তথ্য মিলেছে। পুরো বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে।
মন্তব্য করুন