মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে তাদের সহধর্মিণীদের সম্পদ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আর্থিক অবস্থানে স্বামীদের ছাড়িয়ে গেছেন তারা। কোনো কোনো এমপি বা মন্ত্রীর আয় ও সম্পদ কমলেও পাঁচ বছরে তাদের স্ত্রীর বেড়েছে বহুগুণ। যেন ‘আলাদিনের চেরাগ’ পেয়েছেন তাদের স্ত্রীরা। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের জন্য দাখিল করা হলফনামা বিশ্লেষণ করে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
ইসিতে দেওয়া হলফনামা পর্যালোচনায় দেখা যায়, জাসদ সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর স্ত্রী আফরোজা হকের নগদ টাকা বেড়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় দেওয়া হলফনামা অনুযায়ী, তখন আফরোজা হক ৬০ লাখ ৩ হাজার ২৫৮ টাকার মালিক ছিলেন। বর্তমানে তা বেড়ে এবার ১ কোটি ৬১ লাখ ৫৪ হাজার ৮৪৩ টাকায় দাঁড়িয়েছে।
সুনামগঞ্জ-৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের স্ত্রী জুলেখা মান্নানের আয় বেড়েছে প্রায় কোটি টাকার। হলিক্রস কলেজ থেকে অবসর গ্রহণ করা জুলেখা মান্নানের অস্থাবর সম্পত্তি রয়েছে ৮৮ লাখ ১০ হাজার ৮৮৫ টাকার। আগে তার নামে ছিল শুধু ৫.৬৮ একর কৃষিজমি।
ঢাকা-৯ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরীর স্ত্রী রেহানা চৌধুরীর ২০১৮ সালে মোট ১৯ কোটি ৮ লাখ ৯৩ হাজার ৯০৬ টাকার সম্পত্তি ছিল। এর মধ্যে নগদ ৭ লাখ ৫২ হাজার ৩৩৩ টাকা, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ২ কোটি ৫৯ লাখ ৬৯ হাজার ৩৮৪ টাকা, বন্ড ও শেয়ারে ৩ কোটি ৬২ লাখ ৯৩ হাজার ১৯০ টাকা, সঞ্চয়পত্রে ১৯ লাখ ৮২ হাজার ৯৯৬ টাকা, স্বর্ণালংকার ৩ লাখ টাকা, ইলেকট্রনিক ৩ লাখ ৯৬ হাজার টাকা, আসবাব ৬৯ লাখ ৪৬ হাজার ৩৬৩ টাকা, অন্যান্য ৮ কোটি ৮৯ লাখ ৫৪ হাজার ২১৩ টাকা এবং ২ কোটি ৯২ লাখ ৯৯ লাখ ৪২৭ টাকার অস্থাবর সম্পত্তি ছিল।
বিগত পাঁচ বছরে বেড়ে এবার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি মিলে তা দাঁড়িয়েছে মোট ৫৪ কোটি ৩৬ লাখ ৮৫ হাজার ৪১৪ টাকায়। এর মধ্যে নগদ ৩ লাখ ৮৭ হাজার ৮০৬, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ১৮ কোটি ৫২ লাখ ২ হাজার ৮৫৪, বন্ড ও শেয়ারে ২১ কোটি ৬১ লাখ ৬৯ হাজার ৩২০, সঞ্চয়পত্রে ১২ লাখ ৭১ হাজার ৯৭২, স্বর্ণালংকার ৩ লাখ টাকার, ইলেকট্রনিক সামগ্রী ৩ লাখ ৯৬ হাজার টাকার, আসবাব ৩৪ লাখ ২০ হাজার ৮১৫ টাকা, অন্যান্য ১২ কোটি ৮ লাখ ৮২ হাজার ৮৪২ টাকা এবং ১ কোটি ৫৬ লাখ ৫৩ হাজার ৮০৫ টাকার অস্থাবর সম্পত্তি রয়েছে।
বরিশাল-৫ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় তার স্ত্রী লায়লা শামীম আরার মাত্র ৩০ ভরি স্বর্ণালংকারের কথা উল্লেখ করেন। এ ছাড়া আর কোনো সম্পদের কথা উল্লেখ করেননি তিনি। এবারের হলফনামায় তা বেড়ে ২ কোটি ২৩ লাখ ১৯ হাজার ৯৯৫ টাকার টাকার বেশি অস্থাবর এবং কোটি টাকা বেশি মূল্যের নাল জমি, ভিটাবাড়ি ও দুটি স্থাবর সম্পদে দাঁড়িয়েছে।
ঢাকা-১৬ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহর স্ত্রীর সম্পদ বেড়েছে আড়াই গুণ। গত পাঁচ বছরে তার সম্পদ বেড়েছে ৩ কোটি ১৭ লাখ ৯৩ হাজার ৫২৪ টাকা। হলফনামার তথ্য অনুযায়ী, ইলিয়াস মোল্লাহর স্ত্রীর স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ৫ কোটি ১৯ লাখ ৮৬ হাজার ১৯৫ টাকা। ২০১৮ সালের হলফনামায় ছিল ২ কোটি ১ লাখ ৯২ হাজার ৬৭১ টাকা। যদিও ২০১৮ ও ২০২৩ সালের হলফনামায় স্ত্রীর আয়ের কোনো উৎস্য উল্লেখ করা হয়নি। ২০১৮ সালের ইলিয়াস মোল্লাহর স্ত্রীর কাছে নগদ টাকা না থাকলেও এখন তার কাছে নগদ টাকা রয়েছে ১ কোটি ৩৯ লাখ ৯৭ হাজার ৪৬০ টাকা। অর্থাৎ স্বামী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর স্ত্রীর কাছ নগদ এ টাকা জমা হয়েছে। এ ছাড়া ব্যাংকেও তার কোনো টাকা ছিল না, তবে এখন ব্যাংকে তার জমা রয়েছে ৪৬ লাখ ৪৮ হাজার ২৪৭ টাকা। কোনো অকৃষি জমি না থাকলেও এখন ইলিয়াস মোল্লাহর স্ত্রীর নামে রয়েছে ১ কোটি ২৪ লাখ ৬৮ হাজার ১৩৬ টাকার প্রায় ১২ শতাংশ জমি।
ফেনী-৩ আসনের বর্তমান এমপি ও জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরীর হলফনামায় দেখা যায়, তার চেয়ে তার স্ত্রী জেসমিন মাসুদ চৌধুরীর স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ বেশি। স্থাবর ও অস্থাবর মিলে তার সম্পদ রয়েছে ৮ কোটি ৫৭ লাখ ৬০ হাজার ২৯৯ টাকার। অন্যদিকে তার স্ত্রীর স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ রয়েছে ৯ কোটি ২৮ লাখ ৮ হাজার ৪৭১ টাকার। এ ছাড়া তার স্ত্রীর শেয়ার সঞ্চয়পত্র, ব্যাংক আমানত থেকে বার্ষিক আয় ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৬২৫ টাকা। অন্য খাতে সম্মানী হিসেবে আয় ৩ লাখ ৯০ হাজার টাকা এবং স্বর্ণ আছে ৫০ ভরি। স্ত্রীর হাতে নগদ রয়েছে ১ কোটি ২৫ লাখ ৫২ হাজার ৪০০ টাকা। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা ৬ লাখ ৫৮ হাজার ৭১ টাকা। বিভিন্ন কোম্পানিতে ৩৩ লাখ টাকার শেয়ার রয়েছে। স্থায়ী আমানতে বিনিয়োগ ৮৭ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। ইলেকট্রনিকস ও আসবাবপত্র ১ লাখ ৬০ হাজার এবং অন্যান্য হিসেবে রয়েছে ১০ হাজার টাকা। তার নামে একটি গাড়ি রয়েছে।
কক্সবাজার-১ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত সংসদ সদস্য জাফর আলম ও তার স্ত্রী শাহেদা বেগমের সম্পদ বেড়েছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেওয়া হলফনামা অনুযায়ী, স্ত্রীর নিট সম্পদের মূল্যমান ছিল ৬১ লাখ ৫০ হাজার ৫০০ টাকা। এবারের হলফনামায় তার স্ত্রীর বার্ষিক আয়ের পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে ১৭ লাখ ১৩ হাজার ১৩৩ টাকা। স্ত্রীর অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ৭৮ লাখ ৯৫ হাজার ৫০১ টাকা ও স্থাবর সম্পদের পরিমাণ ১ কোটি ৬৮ লাখ ৩৫ হাজার ৭৫৩ টাকা। গত ৫ বছরে স্ত্রীর নিট সম্পদ দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ৬৪ লাখ ৪৪ হাজার ৩৮৭ টাকা। পাঁচ বছরে তার সম্পদ বেড়েছে ২ কোটি ২ লাখ ৯৩ হাজার ৮৮৭ টাকা। এ ছাড়া এবারের হলফনামায় ১ কোটি ৩৫ লাখ ৫০ হাজার টাকার যৌথ মালিকানাধীন সম্পদও দেখানো হয়েছে।
হলফনামায় সস্ত্রীক এমপি জাফর আলমের নামে আরও শত কোটি টাকার সম্পদের হিসাব গোপন করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এর আগে তাদের অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ ওঠায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কক্সবাজার কার্যালয়ে তাদের পুরো পরিবারকে তলব করা হয়েছিল।
কক্সবাজার-৪ আসনে গত নির্বাচনে শাহীন আক্তারের বার্ষিক আয়ের পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ৭১ হাজার ৮০৫ টাকা। তখন তার নগদ অর্থসহ অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ছিল ৫ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। কৃষিজমি, দালান বাড়িসহ তার স্থাবর সম্পদের আর্থিক মূল্য ছিল ১২ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। নিট সম্পদের পরিমাণ ২৩ লাখ ১২ হাজার ৮০৫ টাকা। আর আগামী নির্বাচনের হলফনামার তথ্য অনুযায়ী শাহীন আকতারের বার্ষিক আয়ের পরিমাণ দেখানো হয়েছে ৬ লাখ ৭৬ হাজার ৬৯৭ টাকা। নগদ টাকা, স্বর্ণালংকারসহ তার বর্তমান অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ১ কোটি ৩৬ লাখ ৬১ হাজার ৯৩২ টাকা। কৃষি ও অকৃষি জমিসহ তার স্থাবর সম্পদের মূল্যমান দেখানো হয়েছে ২৫ লাখ ৯০ হাজার টাকা। এতে নিট সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ কোটি ৬৯ লাখ ২৮ হাজার ৬২৯ টাকা। গত ৫ বছরে তার সম্পদ বেড়েছে ১ কোটি ৪৬ লাখ ১৫ হাজার ৮২৪ টাকা।
হবিগঞ্জ-৩ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে টানা তিনবারের সংসদ সদস্য জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. আবু জাহিরের স্ত্রীর আয় ও সম্পদ ১৫ বছরে বেড়েছে সাড়ে ২৬ গুণ। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তিনি হলফনামায় উল্লেখ করেন, স্ত্রীর নামে ১৫ ভরি স্বর্ণ, আগ্নেয়াস্ত্রসহ ৮ লাখ ৬০ হাজার ৫৮৪ টাকার অস্থাবর এবং স্থাবর সম্পত্তি ১৪ শতাংশ পুকুর রকম ভূমি, যার মূল্য ১ লাখ ১০ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে ৯ লাখ ৭০ হাজার ৫৮৪ টাকার সম্পত্তি।
এবারের হলফনামায় দেওয়া তথ্যে জানা যায়, স্ত্রীর নামে ব্যবসাসহ বিভিন্ন খাতে আয় ৬৭ লাখ ৮ হাজার ৭৯ টাকা। অস্থাবর সম্পত্তি ১০০ ভরি স্বর্ণ, গাড়ি, আসবাবসহ ৮৩ লাখ ৬৫ হাজার টাকা এবং স্থাবর সম্পত্তি কৃষি, অকৃষি জমি ১ কোটি ৭ লাখ ২০ হাজার টাকার। স্ত্রীর মোট সম্পত্তি আছে ২ কোটি ৫৭ লাখ ৯৩ হাজার ৭৯ টাকার। ছেলের কৃষি, ব্যবসা ও বিভিন্ন খাত থেকে আয় ৯৩ লাখ ৪১ হাজার ৬৫৯ টাকা। অস্থাবর সম্পত্তি ১০৮ ভরি স্বর্ণ ও ইলেকটনিক্স পণ্য ৬৩ লাখ ১০ হাজার টাকার। স্থাবর সম্পত্তি কৃষি ও অকৃষি জমি ৯৫ লাখ ৫৩ হাজার ৫০০ টাকার। তার নামে মোট সম্পত্তি রয়েছে ২ কোটি ৫২ লাখ ৫ হাজার ১৫৯ টাকার।
রাজশাহী-১ আসনে আওয়ামী লীগের ওমর ফারুক চৌধুরীর স্ত্রী ও সন্তানদের কাছে থাকা নগদ টাকার পরিমাণ উল্লেখ করেছেন ৪০ লাখ ৬১ হাজার ৭৮০ টাকা। ২০১৮ সালে শেয়ারে কোনো টাকা না থাকলেও পাঁচ বছর পর বিনিয়োগ ২ লাখ টাকা দেখানো হয়েছে। নিজের ও স্ত্রীর চারটি গাড়ির দাম দেখানো হয়েছে ৫৪ লাখ ৭৪ হাজার টাকা। স্ত্রী ও সন্তানদের কাছে রয়েছে শতভরি স্বর্ণালংকার। এবার ৮৫ লাখ টাকা মূল্যের নিজের নামে আবাসিক ভবন ছাড়াও ৯৬ লাখ ৮০ হাজার মূল্যের ফ্ল্যাট এবং স্ত্রীর নামে ৬৫ লাখ টাকা মূল্যের ফ্ল্যাট থাকার কথা উল্লেখ্য করা হয়েছে। এর বাইরে আরও ৫৪ লাখ ৬২ হাজার টাকার বাড়ি অথবা ভবন থাকার কথা বলা হয়েছে।
রাজশাহী-৩ আসনে আয়েন উদ্দিন আওয়ামী লীগ থেকে ২০১৪ সালে প্রথমবার ও ২০১৮ সালে তিনি দ্বিতীয়বার এমপি নির্বাচিত হন। এবার তিনি দলের মনোনয়ন পাননি। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে তিনি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। ২০১৩ সালের আগে তার স্ত্রী এলিনা খাতুনের নামে কোনো ফ্ল্যাট ছিল না। ২০১৮ সালে ৩০ লাখ টাকায় তিনি একটি ফ্ল্যাট কেনেন। এবার স্ত্রীর নামে দুটি ফ্ল্যাট দেখানো হয়েছে। দাম প্রায় ৮৬ লাখ টাকা। ২০১৩ সালে আয়েনের স্ত্রীর হাতে নগদ ১ লাখ টাকা ছিল। স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবে কোনো টাকা ছিল না। এখন তার শিক্ষক স্ত্রীর হাতে নগদ ১৮ লাখ ২৯ হাজার ৯১৯ টাকা আছে। সঞ্চয়পত্র আছে ১০ লাখ টাকার।
কুষ্টিয়া-১ আসনের বর্তমান এমপি ও আওয়ামী লীগ প্রার্থী আকম সরওয়ার জাহান বাদশার স্ত্রীর সম্পদ ৫ বছরে কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। একাদশ জাতীয় নির্বাচনের হলফনামায় বাদশার স্ত্রীর কোনো আয়ের কথা উল্লেখ না থাকলেও পাঁচ বছর পর এবারের হলফনামায় স্ত্রীর নামে ঢাকায় ফ্ল্যাট, গাড়িসহ ১ কোটি ১৩ লাখ টাকার সম্পদের কথা উল্লেখ করেছেন তিনি।