বিএনপি অংশ না নেওয়ায় জাতীয় নির্বাচনে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা পুরোপুরি পূরণ হওয়া সম্ভব নয় বলে মনে করেন সরকারবিরোধী আন্দোলন ছেড়ে ভোটে আসা বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক। তার আশা, ২০১৪ ও ’১৮ সালের তুলনায় বাংলাদেশি মানদণ্ডে এবারের নির্বাচন অধিকতর সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রভাবমুক্ত হবে। তা হলেই গণতান্ত্রিক বিশ্বের কাছে নির্বাচন মোটামুটি গ্রহণযোগ্য হবে বলেও মনে করেন এ নেতা।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গতকাল বৃহস্পতিবার কালবেলাকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন সৈয়দ ইবরাহিম। এ সময় নির্বাচনের পরিবেশ, বিএনপিকে ছাড়া নির্বাচনের ভবিষ্যৎ এবং আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতাসহ নানা বিষয় নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন তিনি।
সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের জন্ম ১৯৪৯ সালের ৪ অক্টোবর চট্টগ্রামের হাটহাজারীর উত্তর বুড়িশ্চর গ্রামে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে চাকরিরত অবস্থায় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে সাহসী ভূমিকার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বীরপ্রতীক খেতাব দেয়। ১৯৯৬ সালে তিনি মেজর জেনারেল হিসেবে চাকরি থেকে অবসরে যান।
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি রাজনীতিতে নামেন। ২০১২ সালে বিএনপির নেতৃত্বে ২০ দলীয় জোটে যুক্ত হয় দলটি। গত বছর সেই জোট বিলুপ্ত হলেও বিএনপির সঙ্গে সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে ছিল কল্যাণ পার্টি। সেই আন্দোলন ছেড়ে গত ২২ নভেম্বর ‘যুক্তফ্রন্ট’ নামে নতুন জোট গঠন করে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেন সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম। কল্যাণ পার্টির নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (কাঁঠাল প্রতীক) এবং বিএনপি জোট ছেড়ে আসা বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (বিএমএল, প্রতীক পাঞ্জা) রয়েছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম চট্টগ্রাম-৫ এবং কক্সবাজার-১ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত
কালবেলা: ১৮ ডিসেম্বর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রচার শুরু হতে যাচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে নির্বাচনের পরিবেশ কেমন দেখছেন?
মেজর জেনারেল (অব.) ইবরাহিম: নির্বাচনী পরিবেশ ক্রমান্বয়ে ইতিবাচক হচ্ছে বলে প্রতীয়মান। প্রচারণা শুরুর দিন থেকে সেটা পুরোপুরি বোঝা যাবে। তবে এ মুহূর্তে আমাদের কাছে প্রতীয়মান, নির্বাচনী পরিবেশ ক্রমান্বয়ে ইতিবাচক রূপ নিচ্ছে।
কালবেলা: বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলন ছেড়ে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। চূড়ান্ত বিচারে নির্বাচনে যাওয়ার ওই সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল বলে মনে করেন কি না?
ইবরাহিম: এ জন্য আমি অনুতপ্ত নই। আমি শুকুর আলহামদুলিল্লাহ বলি।
কালবেলা: নির্বাচনে ৪৪টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৯টি দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। কিন্তু অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, ভোটে জিততে অংশগ্রহণকারী প্রায় সব দলই নৌকা চায়। এ ব্যাপারে যুক্তফ্রন্টের অবস্থান কী?
ইবরাহিম: যুক্তফ্রন্টের ৩৬ জন প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন। এর মধ্যে কল্যাণ পার্টির ১৭ জন আছেন। তারা নিজ নিজ দলের প্রতীকে নির্বাচন করবেন। আসন নিয়ে সরকারের সঙ্গে আমাদের কোনো ধরনের সমঝোতা হয়নি। এ জন্য আমরা কোনো উদ্যোগও নিইনি। এটা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্নও নই। আমরা এই প্রত্যাশায় নির্বাচনে গেছি যে, ভোট অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে।
কালবেলা: যুক্তফ্রন্ট যে উদ্দেশ্য নিয়ে বিএনপি-জোট ছেড়ে ভোটে এসেছে, সেই উদ্দেশ্য অটুট আছে কি না?
ইবরাহিম: আমাদের সামনে তখন দুটি বিকল্প ছিল। অনিশ্চিত ফলাফলের আন্দোলন, অসম্পূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া অথবা বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সর্বোত্তম না হলেও যেটা মৌলিক পদ্ধতি তার আশ্রয় নিয়ে জনগণের খেদমতের জন্য চেষ্টা করা। আমি দ্বিতীয় বিকল্পটা বেছে নিয়েছি। ভোটে আসার সেই উদ্দেশ্য এই মুহূর্ত পর্যন্ত ঠিক আছে, বাকিটা আল্লাহ রাব্বুল আল আমিন জানেন।
কালবেলা: শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়—এমন দাবিতে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো নির্বাচন বয়কট করে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে। এমন পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে আপনি কতটা আশাবাদী?
ইবরাহিম: পাশ্চাত্যের মানদণ্ডে উন্নত দেশগুলোতেও শতভাগ সুষ্ঠু নির্বাচনের আশা করা মুশকিল। কিন্তু ২০১৪ ও ২০১৮ সালের তুলনায় বাংলাদেশি মানদণ্ডে এবারের নির্বাচনটা অধিকতর সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রভাবমুক্ত হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
কালবেলা: অনেকে বলছেন, বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো বয়কট করায় শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হলেও তা গণতান্ত্রিক বিশ্ব, বিশেষ করে পশ্চিমাদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। কারণ তারা দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে একটি অবাধ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। এ ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে ভিসা নিষেধাজ্ঞাও কার্যকর করেছে। এ প্রসঙ্গে আপনার মতামত কী?
ইবরাহিম: বিএনপি দেশের দুটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের একটি। তারা নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার কারণে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, তা অন্যদের দিয়ে পুরোপুরি পূরণ করা সম্ভব নয়। এই শূন্যতা আংশিকভাবে পূরণ করা সম্ভব। আন্তর্জাতিক বিশ্বের কাছে এটা শতভাগ গ্রহণযোগ্য হবে না, আবার শতভাগ অগ্রহণযোগ্যও হবে না। আন্তর্জাতিক বিশ্ব বাংলাদেশ নামক একটি উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করবে না। অতীতেও দেখা গেছে, বাংলাদেশে এ ধরনের নির্বাচন হয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচন নিয়েও সমালোচনা ছিল। কিন্তু পাঁচ বছর সরকার দেশ পরিচালনা করেছে। সরকারবিহীনভাবে দেশ চলতে পারে না, অসম্ভব। এটা আন্তর্জাতিক বিশ্বও জানে, বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষও জানে। সুতরাং মধ্যম পন্থা হলো, যতটা সম্ভব নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন করা, পাশ্চাত্যের কাছে নির্বাচনী স্বচ্ছতার প্রমাণ দেওয়া এবং তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা।
কালবেলা: নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে থাকা বিএনপিসহ যুগপতের শরিক দলগুলোর এখন লক্ষ্য ভোট ঠেকানো। এমন প্রেক্ষাপটে ৭ জানুয়ারি নির্বাচন হওয়া নিয়ে কোনো সংশয় দেখছেন কি না?
ইবরাহিম : ভোট হওয়া নিয়ে কোনো সংশয় নেই। তবে বাজারে অনেক গুজব রয়েছে। আমি মনে করি, ভোট ৭ জানুয়ারি না হলে ৮ জানুয়ারি হবে, অন্যথায় ৯ জানুয়ারি হবে, ১০ জানুয়ারি হবে; কিন্তু ভোট হতে বাধ্য। তবে শেষ পর্যন্ত যদি ভোট না হয়, তার মানে এই নয় যে, একটি দল জিতবে, আরেকটি দল পরাজিত হবে। ভোটবিহীন বাংলাদেশ আর সরকারবিহীন বাংলাদেশ এক নয়, এটা আলাদা জিনিস। সরকারবিহীন বাংলাদেশ সম্ভব নয়। এটা অবাস্তব, অকল্পনীয়। যদি ভোট না হয়, যে সরকার আসার গুঞ্জন আছে সেই সরকার ক্ষতিকারক হলে প্রত্যেকের জন্য সমান ক্ষতিকারক হবে। আর লাভজনক হলে সবার জন্যই লাভজনক হবে। আমি আশা ও কামনা করি, ভোট হবে।
কালবেলা: নির্বাচন বয়কট করে ভোট ঠেকানোর আন্দোলনে রয়েছে বিএনপি ও যুগপতের মিত্ররা। এমন প্রেক্ষাপটে সদ্য সাবেক হওয়া মিত্রদের প্রতি আপনার কোনো পরামর্শ আছে কি না?
ইবরাহিম: বিএনপিসহ তাদের উদ্দেশে আমি কোনো পরামর্শ দেব না। তাদের জন্য সব সময় শুভেচ্ছা, শুভকামনা ও দোয়া থাকবে। এই বাংলাদেশ আমাদের সবার। এই দেশ কারও একলার নয়।