দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে আলোচিত রাজনৈতিক দল তৃণমূল বিএনপি মহাসচিব অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার বলেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতেই তারা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে প্রধানমন্ত্রী প্রশ্নবিদ্ধ হবেন। সেক্ষেত্রে এই নির্বাচন আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে কালবেলাকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন।
নির্বাচনী লড়াইয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে কোনো ধরনের সমঝোতা হয়নি দাবি করে তৃণমূল বিএনপির এই নেতা জানান, ‘নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রায় সবাই সরকারি দলে গেছেন। আমরা সরকারের সঙ্গে কোনো সমঝোতা করিনি। নৌকার বিরুদ্ধে দলীয় ‘সোনালী আঁশ’ প্রতীকে নির্বাচন করছি। জনগণ যদি মনে করে, গণতন্ত্রকে রক্ষা ও শক্তিশালী করার জন্য ‘শক্তিশালী বিরোধী দল’ প্রয়োজন, তাহলে আমাদের ভোট দেবেন। সেক্ষেত্রে আমরা ‘প্রধান বিরোধী দল’ হব।’
বিএনপির আলোচিত নেতা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা তৃণমূল বিএনপি এ বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পায়। এর তিন দিন পরই সাবেক মন্ত্রী নাজমুল হুদা মারা যান। এরপর দল পরিচালনার দায়িত্ব নেন তার মেয়ে অন্তরা সেলিমা হুদা। গত ১৯ সেপ্টেম্বর তৃণমূল বিএনপির প্রথম সম্মেলন ও কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে যোগ দিয়েই মহাসচিব নির্বাচিত হন বিএনপি চেয়ারপারসনের সাবেক উপদেষ্টা তৈমূর আলম খন্দকার। এর আগে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ায় গত বছরের জানুয়ারিতে তৈমূর আলম খন্দকারকে বহিষ্কার করেছিল বিএনপি।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-১ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব।
সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত
কালবেলা: দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রচার শুরু হয়েছে। নির্বাচনের পরিবেশ কেমন দেখছেন?
তৈমূর আলম: এখন পর্যন্ত কোনো সংশয় দেখছি না। আমরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলাম। প্রধানমন্ত্রী সেখানে কমিটমেন্ট করেছেন, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে। আমাদের দাবি, ভোটারের নিরাপত্তা, কেন্দ্রের নিরাপত্তা, প্রার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
দেখা যায়, দেশের প্রায় প্রতিটি এলাকায় এমপিদের নিজস্ব একটি বাহিনী থাকে। এরা বিভিন্ন লোকজনকে হুমকি-ধমকি দেয়। এগুলো অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য অন্তরায়।
আমাদের প্রত্যাশা, প্রধানমন্ত্রী সুষ্ঠু নির্বাচনের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, রাষ্ট্রীয় প্রশাসনযন্ত্র যেন সেটা বাস্তবায়ন করেন। আশা করি, সার্বিক পরিস্থিতির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী সতর্ক আছেন।
কালবেলা: বর্তমান সরকারের অধীনে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়—এমনটা দাবি করে বিএনপিসহ বেশ কিছু দল নির্বাচন বয়কট করে আন্দোলনে আছে। এই পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে আপনারা কতটা আশাবাদী?
তৈমূর আলম : ২০১৪ সালে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়নি। কিন্তু তাতে নির্বাচন ও সরকার গঠন ঠেকানো যায়নি। বিদেশিরাও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেনি, সম্পর্ক অটুট রেখেছে। ২০১৮ সালে যাবে না যাবে না বলে শেষ মুহূর্তে নির্বাচনে গেল। কেন গেল, সেটা তারাই ভালো বলতে পারবেন। প্রতি আসনে ৪-৫ জন করে মনোনয়ন দিলেন। নির্বাচনে মাত্র ছয়টি আসন পেলেন। নির্বাচনের দিন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বললেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হচ্ছে। এরপর বললেন, যারা সংসদে যাবে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একজন গেলেন, তাকে বহিষ্কার করা হলো। এরপর মির্জা ফখরুল ইসলাম ছাড়া সবাই গিয়ে হাজির হলেন।
বিএনপি স্থানীয় সরকার নির্বাচন করবে না, জাতীয় নির্বাচন করবে না। তাহলে আমরা সবখানে কি আওয়ামী লীগকে ব্ল্যাঙ্ক চেক দিয়ে দেব? আওয়ামী লীগকে ব্ল্যাঙ্ক চেক দেওয়ার লোক তৈমূর আলম খন্দকার নন, তৃণমূল বিএনপি নয়। নির্বাচন একতরফা করতে করতে সারা দেশে এমপিদের নেতৃত্বে একটি নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে উঠেছে, মানুষ এগুলোর অবসান চায়। তবে প্রধানমন্ত্রী সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তার এই প্রতিশ্রুতির জন্য আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছি। এখন যদি সুষ্ঠু নির্বাচন না হয়, তাহলে প্রশ্নবিদ্ধ হবেন প্রধানমন্ত্রী। আমরা রাজপথে আছি, রাজপথে থাকব।
কালবেলা: অনেকে বলছেন, বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো বয়কট করায় শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হলেও তা গণতান্ত্রিক বিশ্ব বিশেষ করে পশ্চিমাদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। কারণ তারা দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে একটি অবাধ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। এ ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে ভিসা নিষেধাজ্ঞাও কার্যকর করেছে। এ প্রসঙ্গে আপনার মতামত কী?
তৈমূর আলম: নির্বাচন যদি সুষ্ঠু না হয়, ভোটাররা যদি নির্বিঘ্নে ভোট দেওয়ার সুযোগ না পায়—স্বাভাবিকভাবে নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। তাই ভোট অবাধ, সুষ্ঠু হওয়া আবশ্যক। নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টিতে ইসিকে বলব, বৈধ ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে। যারা কেন্দ্র দখল করে, তাদের নজরদারিতে রাখতে হবে। কেন্দ্র দখলের প্রস্তুতি নিলে তাদের গ্রেপ্তার করতে হবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে আমরা এই দাবি জানাচ্ছি। যদি এগুলো করা না হয়, তাহলে বুঝব, তারা সুষ্ঠু নির্বাচন করতে চায় না। নির্বাচন যদি সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর না হয়, প্রধানমন্ত্রী যদি তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে না পারেন, নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্বে প্রশ্ন থাকবেই। নির্বিঘ্নে ভোট দেওয়ার পরিবেশটা তৈরি করতে হবে। মানুষ আমাদের বলে, ভোট দিতে পারব তো, সুষ্ঠু নির্বাচন হবে তো।
কালবেলা: নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনা ছিল, বিএনপি ভোটে না গেলেও দলটির অনেক নেতা তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দিয়ে নির্বাচন করবেন। চূড়ান্তভাবে বিএনপির কতজন নেতা তৃণমূল বিএনপি থেকে ভোট করছেন?
তৈমূর আলম: বিএনপির চারজন সাবেক এমপি নির্বাচন করছেন, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচন করছেন, বিএনপির অনেক নেতা নির্বাচন করছেন। তৃণমূল বিএনপিতে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ সব দল থেকে নেতারা এসেছেন। আমরা আমাদের প্রার্থীদের নিয়ে পরিচিতি সভাও করেছি। কেন্দ্রীয় এবং জেলা পর্যায় মিলিয়ে বিএনপির ৩০ জনের মতো নেতা তৃণমূল বিএনপিতে এসেছেন।
কালবেলা: তৃণমূল বিএনপি থেকে এর আগে বলা হয়েছে, তারা দ্বাদশ জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দল হতে চায়। নির্বাচন ঘিরে দলের আগের সেই চাওয়া এখনো অটুট আছে কি না?
তৈমূর আলম : নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য আমরা তৃণমূল বিএনপি থেকে ২৮০ জন প্রার্থীকে মনোনয়ন দিয়েছিলাম। কিন্তু নানা জটিলতার কারণে ১৫১ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিতে পেরেছেন। এদের মধ্য থেকে এখন পর্যন্ত ১৪০ জনের মতো প্রার্থী দলীয় ‘সোনালী আঁশ’ প্রতীকে ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এর মধ্যে চারজন সাবেক সংসদ সদস্য রয়েছেন। সব মিলিয়ে তৃণমূল বিএনপি থেকে বিজয়ী হওয়ার মতো অনেক প্রার্থী রয়েছেন। আমাদের প্রত্যাশা, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অবাধ ও সুষ্ঠু ভোট হলে তৃণমূল বিএনপির উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রার্থী বিজয়ী হবেন।
জাতীয় পার্টি তো এখন বলতে পারবে না যে, তারা বিরোধী দল। তারা নৌকায় উঠেছেন। ১৪ দলের নেতারাও নৌকা নিয়েছেন। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রায় সবাই সরকারি দলে গেছেন। আমরা জাতীয় পার্টি কিংবা ১৪ দলের মতো সরকারের সাথে আঁতাত-সমঝোতা করিনি। আমরা নৌকার বিরুদ্ধে নির্বাচন করছি। আমরা আগেই বলেছি, তৃণমূল বিএনপি দ্বাদশ জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দল হতে চায়। এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে এখন আমাদের মধ্যে সাহসও বেড়েছে, আত্মবিশ্বাসও বেড়েছে। জনগণ যদি মনে করে, গণতন্ত্রকে রক্ষা ও শক্তিশালী করার জন্য জাতির স্বার্থে শক্তিশালী বিরোধী দল প্রয়োজন, জনগণ আমাদের ভোট দেবে। সেক্ষেত্রে আমরা ‘প্রধান বিরোধী দল’ হবো।
কালবেলা: তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব হিসেবে আপনি নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসন থেকে নির্বাচন করছেন। এখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী। জয়ের ব্যাপারে কতটা আশাবাদী?
তৈমূর আলম : এটা আমার মাতৃভূমি। মানুষকে চাকরি দিয়ে জেল খেটেছি। ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলেছি। এ ছাড়া এখানে আমার বাপ-দাদারও তো কিছু কর্ম আছে। আমার নিজেরও
কর্মী-সমর্থক রয়েছে। সুষ্ঠু ভোট হলে এবং ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারলে নারায়ণগঞ্জ-১ আসনে তৃণমূল বিএনপি বিজয়ী হবে।