নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, স্বতন্ত্র প্রার্থীসহ তাদের সমর্থকদের এ পর্যন্ত ৪৩৬টি শোকজ ও তলব নোটিশ দিয়েছে নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি। এর মধ্যে ঢাকা অঞ্চলে সর্বোচ্চ ১১৬টি এবং সিলেট অঞ্চলে সর্বনিম্ন ১৬টি নোটিশ দেওয়া হয়। এ পর্যন্ত ২৭৩ প্রার্থী ও তাদের সমর্থক অনুসন্ধান কমিটির কাছে সরাসরি অথবা প্রতিনিধির মাধ্যমে লিখিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। নির্বাচন কমিশন (ইসি) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রেকর্ডসংখ্যক শোকজ, তলব, সতর্ক ও জরিমানার পরও প্রার্থীদের বাগে আনতে পারছে না ইসি। কমিশনের কঠোর অবস্থানের পরও সারা দেশে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের হুমকি-ধমকি, হামলা, পোস্টার ছিঁড়ে ফেলাসহ নানাভাবে আচরণবিধি লঙ্ঘন করে চলেছেন বেপরোয়া প্রার্থী ও তাদের সমথর্করা। এসব অভিযোগে গতকালও কয়েক প্রার্থী এবং তাদের সমর্থককে শোকজ করেছে নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি। এ ছাড়া অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে কয়েকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে ইসিতে প্রতিবেদন পাঠিয়েছে কমিটি।
ইসির সংশ্লিষ্ট শাখার তথ্য অনুসারে, তপশিল ঘোষণার পর থেকে গতকাল দুপুর পর্যন্ত যে ৪৩৬টি শোকজ নোটিশ দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে বেশিরভাগই আওয়ামী লীগের প্রার্থী। তাদের মধ্যে অন্তত ৭০ জনই বর্তমান সংসদ সদস্য। পাশাপাশি জাতীয় পার্টির ১৫ জন এবং অর্ধশতাধিক স্বতন্ত্র প্রার্থীকেও শোকজ করা হয়েছে। নোটিশ পাওয়া অন্যদের মধ্যে আছেন দলের কর্মী-সমর্থক ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও। এই তালিকায়ও ক্ষমতাসীন দলের কর্মী-সমর্থক বেশি। বারবার আচরণবিধি লঙ্ঘনের কারণে দুই প্রার্থীর বিরুদ্ধে আদালতে মামলাও হয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের ওপর হামলার ঘটনা প্রমাণিত হওয়ায় তদন্ত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ইসির নির্দেশে ঝিনাইদহ-১ আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী আব্দুল হাইয়ের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে আদালতে দুটি মামলা হয়েছে। মামলা হয়েছে চট্টগ্রাম-১৬ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর বিরুদ্ধেও। গত বৃহস্পতিবার ক্ষমতাসীন দলের আলোচিত দুই প্রার্থী কুমিল্লা-৬ আসনের আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার ও বরগুনা-১ আসনের ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুকে নির্বাচন কমিশনে ডেকে যথাক্রমে ১ লাখ ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে শেষবারের মতো সতর্ক করা হয়েছে। বেপরোয়া প্রার্থীদের লাগাম টানতে প্রার্থিতা বাতিলেরও চিন্তা করছে কমিশন। এরপরও এসব প্রার্থীকে বাগে আনতে পারছে না কমিশন। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ‘ইবলিশ ও শয়তান’ মন্তব্য করায় গতকাল বরগুনা-১ আসনের সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুকে আবারও কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে কমিটি। বরগুনা-১ আসনের নির্বাচন অনুসন্ধান কমিটির চেয়ারম্যান আহমেদ সাইদ এ নোটিশ দেন। নোটিশে আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কমিটির কাছে লিখিত বক্তব্য দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
রংপুর-১ আসনে জাতীয় পার্টির বহিষ্কৃত মহাসচিব ও বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ স্বতন্ত্র প্রার্থী মসিউর রহমান রাঙ্গাকে আবারও কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে অনুসন্ধান কমিটি। রাঙ্গার বিরুদ্ধে ভোটারদের ভূরিভোজের অভিযোগ উঠেছে। তাকে আজ সোমবার সকাল সাড়ে ১১টায় সশরীরে উপস্থিত হয়ে বা প্রতিনিধির মাধ্যমে তাকে এ বিষয়ে লিখিত ব্যাখ্যা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আবার শোকজ করা হয়েছে পটুয়াখালী-১ আসনের জাতীয় পার্টির প্রার্থী এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারকে।
ডিসি ও এসপিকে বদলির হুমকি দেওয়ায় লক্ষ্মীপুর-১ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য হাবিবুর রহমান পাবনকে তলব করেছে ইসি। গতকাল তাকে সশরীরে নির্বাচন ভবনে হাজির ও ব্যাখ্যা তলবের চিঠি পাঠিয়েছেন ইসির আইন শাখার উপসচিব মো. আব্দুছ সালাম। এতে তাকে আজ সোমবার বিকেল ৩টায় ইসি সচিবালয়ের ৩১৪ নম্বর কক্ষে সশরীরে উপস্থিত হয়ে ব্যাখ্যার নির্দেশ দেওয়া হয়। বরিশাল-৬ আসনের বাকেরগঞ্জের পৌর মেয়র লোকমান হোসেন ডাকুয়াকে আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়েছে অনুসন্ধান কমিটি। গতকাল বরিশাল-৬-এর নির্বাচন অনুসন্ধান কমিটির চেয়ারম্যান সিনিয়র সহকারী জজ মাহাদী হাসান এ নোটিশ দেন। গত ২৬ ডিসেম্বর বাকেরগঞ্জে এক বৈঠকে প্রতিপক্ষ নৌকা সমর্থকদের ৫ মিনিটও মাঠে টিকতে না দেওয়ার হুমকি দেন মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লোকমান হোসেন ডাকুয়া। এ আসনে বাকেরগঞ্জ উপজেলার নিয়ামতি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান কামাল হোসেন তালুকদারকেও ৩ জানুয়ারি সকাল ১১টায় সশরীরে হাজির হয়ে কমিটির কার্যালয়ে ব্যাখ্যা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এ ছাড়া আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে সিলেট-৫ আসনের প্রার্থী হুছামুদ্দীন চৌধুরী, বগুড়ার চৌধুরী আদর্শ মহিলা ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক আমিনুল ইসলাম হেলাল, সাভারের বনগাঁও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আরিফ আহমেদ, ও ফেনীর দাগনভূঞার ১ নম্বর সিন্দুরপুর ইউপি চেয়ারম্যান নূর নবীসহ আরও অন্তত ৩০ জনকে শোকজ ও তলব করা হয়।
ইসির সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, এ পর্যন্ত দেওয়া ৪৩৬ নোটিশের মধ্যে ২৭৩টি প্রতিবেদন পাওয়া গেছে। ইসির অনুমোদন ও নথিতে উপস্থাপন হয়েছে ৫৮টি এবং অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে ১১৬টি প্রতিবেদন। এ ছাড়া আরও ৯৯টির কার্যক্রম চলমান। ঢাকা অঞ্চলে ১১৬টি, রংপুর অঞ্চলে ২২টি, কুমিল্লা অঞ্চলে ৬৪টি, ফরিদপুর অঞ্চলে ১৮টি, চট্রগ্রাম অঞ্চলে ৩৪টি, সিলেট অঞ্চলে ১৬টি, বরিশাল অঞ্চলে ২৭টি, খুলনা ৩০টি, রাজশাহী অঞ্চলে ৬৬টি ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে ৪৩টি নোটিশ দেওয়া হয় প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের।
কমিশন বলছে, দায়ীদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এরপরও যারা নিয়ন্ত্রণে আসবেন না, তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ সিদ্ধান্তের দিকে যাবে কমিশন। তবে ভোটের সময় আরও ঘনিয়ে এলে আচরণবিধি লঙ্ঘনের মাত্রা কমে আসবে বলেও তারা আশাবাদী।