বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে জুনিয়র অপারেটর জিএসই (ক্যাজুয়াল) পদে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর নির্ধারণ করা হয় লিখিত পরীক্ষার তারিখ। পরীক্ষার আগের দিন করা হয় প্রশ্ন প্রণয়ন। এরপর প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য বিমানের ডিজিএম (সিকিউরিটি) মেজর তাইজ ইবনে আনোয়ারকে একটি খসড়া প্রশ্নপত্র দিয়ে এর ভুলত্রুটি সংশোধনের জন্য বলা হয়। এ সময় মোবাইল ফোনে ওই খসড়া প্রশ্নপত্রের ছবি তুলে নেন আনোয়ার। পরে তা অন্যদের কাছে সরবরাহ করেন। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে রাজধানীর বিমানবন্দর থানায় করা মামলার চার্জশিটে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।
আট মাসের তদন্ত শেষে গত ২২ জুন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও গোয়েন্দা লালবাগ বিভাগের পরিদর্শক আলমগীর হোসেন পাটোয়ারী আদালতে চার্জশিটটি দাখিল করেন। এতে মেজর আনোয়ারসহ ৩০ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তবে কার্গো হেলপার কামরুজ্জামান, ক্লিনার আমির ও প্রার্থী আরাফাতের নাম জবানবন্দিতে প্রকাশিত হলেও আমির এবং আরাফাতের সঠিক নাম-ঠিকানা পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া আসামি কামরুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি বলে চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়।
এ বিষয়ে আলমগীর হোসেন পাটোয়ারী কালবেলাকে বলেন, বিমানের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের ঘটনার মূলহোতা মেজর তাইজ ইবনে আনোয়ার। সবার অগোচরে তিনি এ প্রশ্নপত্রের ছবি তুলে তা ফাঁস করেন। তাকে ২৪ লাখ টাকা দেওয়ার তথ্য ডায়েরিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
চার্জশিটভুক্ত অন্য আসামিরা হলেন বিমানের সিডিউলিং সুপারভাইজার মাহবুব আলম শরীফ, সিকিউরিটি গার্ড আইউব উদ্দিন, এমটি অপারেটর মহসিন আলী, মিজানুর রহমান, ফারুক হোসেন, নজরুল ইসলাম, ফিরোজ আলম, জাহাঙ্গীর আলম, মো. মাসুদ, মো. মাহবুব আলী, এনামুল হক, মাহফুজুল আলম, ট্রাফিক হেলপার আল আমিন, আ. মালেক, আলমগীর হোসেন, গাড়িচালক আব্দুল্লাহ শেখ, সাজ্জাদুল ইসলাম, এমএলএসএস তাপস কুমার মণ্ডল, জাহিদ হাসান, হারুন অর রশিদ, সমাজু ওরফে সোবাহান, জাকির হোসেন, বিএফসিসি অপারেটর সুলতান হোসেন, মুরাদ শেখ ওরফে মোস্তাফিজুর রহমান, বাংলাদেশ বেতারের গাড়ি চালক ফারুক হোসেন, জুয়েল মিয়া, রাজিব মোল্লা, অফিস সহায়ক আওলাদ হোসেন ও হেলপার জাবেদ হোসেন।
যেভাবে প্রশ্নফাঁস করেন মেজর আনোয়ার : গত বছরের ১৯ অক্টোবর আনোয়ারসহ নিয়োগের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কমিটির চার সদস্য বিমানের জিএসই পদসহ অন্য পদের লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরির কাজ শুরু করেন। ওইদিন বিমানের বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ট্রেনিং সেন্টারের প্রিন্সিপাল নজমুল হুদা ও ইঞ্জিনিয়ার কায়সার জামান নিজেদের অংশের প্রশ্নপত্র পেনড্রাইভে নিয়ে আসেন। তার কিছু সময় পরে আনোয়ার জিএমের (অ্যাডমিন) রুমে আসেন। তারা প্রশ্নপত্র সেট করার পর মেজর তাইজ ইবনে আনোয়ারকে এর ভুলত্রুটি সংশোধনের জন্য দেখতে বলেন। তখন আনোয়ার বলেন ল্যাপটপের স্ক্রিনে দেখতে সমস্যা হচ্ছে বলে প্রিন্ট কপি চান। তাকে প্রিন্ট কপি দেওয়া হলে তিনি তা চেকব্যাক করেন। এরপর মেশিন দিয়ে ওই কপিটি নষ্ট করা হয়। এরপর তারা জুনিয়র টেইলর কাম অ্যাপহোলস্টারসহ ৯টি টেকনিক্যাল পদের জন্য একটি প্রশ্নপত্র প্রণয়নের কাজ শুরু করেন।
প্রশ্নপত্র চেকব্যাকের সময় মেজর আনোয়ার গোপনে মোবাইল ফোনে খসড়া প্রশ্নটির ছবি তুলে নেন। পরে সেটি প্রিন্ট করে আসামি মাসুদ এবং জাহাঙ্গীর আলমকে সরবরাহ করেন। সেটির কপি জাহাঙ্গীর আলম, হারুন অর রশিদ, মাহফুজুল আলম ও আওলাদ হোসেনের কাছে থেকে উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া প্রশ্নটির ছবি আসামি জাহাঙ্গীর, মাসুদ, হারুন, এনামুল, মাহফুজুল, জাহিদ, জাবেদেরও মোবাইল ফোনে পাওয়া যায়। এ ছাড়া গত বছরের ২০ অক্টোবর সকালে বিমানের প্রধান কার্যালয়ে জুনিয়র অপারেটর (জিএসই) ক্যাজুয়াল পদের প্রশ্নপত্র ফটোকপির সময় এর ছবি তুলে নেন এমএলএসএস জাহিদ হাসান। পরে তা আওয়াদ ও সমাজুকে সরবরাহ করেন।
জাহাঙ্গীর, মাসুদ ও মেজর আনোয়ার সিন্ডিকেট অত্যন্ত ক্ষমতাশালী : জাহাঙ্গীর আলম, মাসুদ, মেজর আনোয়ারসহ মামলার গ্রেপ্তার আসামিরা একটি সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট। তারা বিমানে নিয়োগ প্রার্থীদের থেকে বিপুল পরিমাণে টাকা হাতিয়ে নিয়ে যোগ্যদের চাকরিবঞ্চিত করে আসছিল। তাদের মধ্যে মেজর আনোয়ার, জাহাঙ্গীর, মাসুদ, মাহবুব অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস, সংগ্রহ এবং বিক্রির কাজে নেতৃত্ব দেন। আর আওলাদ, মাহফুজ, হারুন, এনামুল, জাকির ও জাবেদ প্রশ্নপত্র সংগ্রহ এবং ক্রয়-বিক্রয় করেন। জাহিদ প্রশ্নপত্র ফাঁস ও বিতরণ করেন। এ ছাড়া মহসিন, মাহবুব, আইউব, মিজানুর, ফারুক, নজরুল, আল আমিন, মালেক, আব্দুল্লাহ, সাজ্জাদুল, আলমগীর, ফিরোজ, তাপস, সুলতান, মুরাদ, ফারুক, জুয়েল ও রাজিব এ চক্রের সদস্য হিসেবে কাজ করেন।
ডায়েরিতে ২৪ লাখ টাকা দেওয়ার তথ্য : এ ঘটনায় জাহাঙ্গীরের কাছে থেকে তিনটি ডায়েরি জব্দ করা হয়। সেগুলোতে বিমানের নিয়োগ পরীক্ষায় চাকরিপ্রার্থীদের থেকে টাকা নিয়ে জাহাঙ্গীর, মাসুদ এবং আনোয়ারের ভাগাভাগি করে নেওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। এ ছাড়া ডায়েরিগুলোতে বিমানের নিম্নপদে চাকরিরত কর্মচারীর মাধ্যমে সংগ্রহ করা শত শত চাকরি প্রার্থীর নাম, রোল নম্বর তিনটি ডায়েরিতে রয়েছে। যাতে বিভিন্ন প্রার্থীর কাছে চাকরি দেওয়ার জন্য নেওয়া থাকা এবং নিয়োগ বাবদ বিমানের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মচারীকে এই বাবদ প্রদত্ত টাকার হিসাব পাওয়া যায়। এর মধ্যে একটি ডায়েরিতে জিএসএ পদে লোক নিয়োগ বাবদ ‘স্যার’কে ২৪ লাখ টাকা দেওয়ার তথ্য রয়েছে।
জবানবন্দিতে প্রশ্নফাঁসের চিত্র : প্রশ্নফাঁসের পর এ মামলায় ১১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। বর্তমানে তারা কারাগারে রয়েছেন। তাদের মধ্যে ১০ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দিতে প্রশ্নফাঁসের মূলহোতাদের নাম উঠে এসেছে।
জাহাঙ্গীর তার জবানবন্দিতে বলেন, তিনি মেজর আনোয়ারের গাড়িচালক হিসেবে কাজ করতেন। নিয়োগ পরীক্ষার তিন-চার দিন আগে তিনি মেজর আনোয়ারের সঙ্গে দেখা করে বলেন তার তিন-চারজন প্রার্থী রয়েছে। তখন আনোয়ার প্রশ্নপত্রের ব্যবস্থা করতে পারবেন বলে তাকে জানান। পরীক্ষার আগে ১৯ অক্টোবর বিমানের অফিসে যান তিনি। পরে তাকে ও মাসুদকে এক সেট করে প্রশ্নপত্রের কপি দেন আনোয়ার।
মেজর আনোয়ারের গাড়িচালক মাসুদ তার জবানবন্দিতে বলেন, পরীক্ষার পাঁচ থেকে ছয় দিন তিনি মেজর আনোয়ারের সঙ্গে কথা বলেন। তার দুজন লোক আছে এবং চাকরি হলে তাদের থেকে ৪ লাখ টাকা নিতে পারবেন বলে জানান। এর মধ্যে ২ লাখ মেজর আনোয়ারাকে দিতে চান তিনি। পরীক্ষার আগের দিন তিনি আনোয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। অফিসে গেলে তাকে প্রশ্নপত্র দেওয়া হয়। তখন আনোয়ার চুক্তি করা দুজনের কাছে প্রশ্ন দিতে বলেন। এরপর তিনি প্রশ্নপত্র নিয়ে উত্তরা যান। সেখানে গিয়ে দোকান থেকে এক সেট প্রশ্ন কপি করেন। তিনি এমডির ড্রাইভার মাহাবুব আলী ও এমটি অপারেটর মহসিনকে প্রশ্ন দেন।
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আব্দুল্লাহ আবু কালবেলাকে বলেন, যারা দায়িত্বে থেকে প্রশ্নফাঁস করেছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা হওয়া উচিত। প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি কোনোভাবেই কাম্য নয়। এ মামলার সাক্ষীদের আদালতে হাজির করে দ্রুত বিচার শেষ করা যাবে।
মন্তব্য করুন