স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন প্রখ্যাত বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জন অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন। আলোচনার বাইরে থাকা এই চিকিৎসককে টেকনোক্র্যাট কোটায় মন্ত্রিসভায় নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৃহস্পতিবার শপথ গ্রহণের পর তিনি পূর্বসূরি জাহিদ মালেকের স্থলাভিষিক্ত হন। আগামীকাল রোববার তিনি সচিবালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। গতকাল শুক্রবার তিনি কালবেলার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে নিজের মন্ত্রণালয়ের কাজের পরিকল্পনার বিষয়ে জানিয়েছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কালবেলার নিজস্ব প্রতিবেদক মাহমুদুল হাসান
কালবেলা: প্রথমে আপনাকে অভিনন্দন। নতুন মন্ত্রিসভায় আপনাকে সবচেয়ে বড় চমক বলা হচ্ছে। অনুভূতি কী?
ডা. সামন্ত লাল সেন: অনেক ধন্যবাদ, কষ্ট করে এসেছেন। আমি মন্ত্রী হবার জন্য প্রস্তুত (প্রিপেয়ার্ড) ছিলাম না। সুতরাং হঠাৎ করে কিছু বলা আমার জন্য মুশকিল। আমি যখন খবর পেলাম মন্ত্রী হব, তখন থেকে আমি একটু নার্ভাস। ২০ বছর ধরে কিন্তু আপনারা আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছেন। আপনাদের সহযোগিতায় আমি আজকে এত বড় হাসপাতাল (শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট) করেছি। দায়িত্ব গ্রহণের পর আপনারা আমাকে সহযোগিতা করবেন, আমিও সর্বোচ্চ দিয়ে কাজ করব। সবার সহযোগিতায় অবশ্যই দেশের স্বাস্থ্য খাতের চেহারা বদলে যাবে। এত এত মানুষের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী আমাকে পছন্দ করেছেন, এরচেয়ে বড় তো আর কিছু নেই।
কালবেলা: স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে আপনার কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। এক্ষেত্রে বাড়তি কোনো চাপ অনুভব করছেন কি না?
ডা. সামন্ত লাল সেন: আমি জানি আমার কাছে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে প্রান্তিক জনগণ–সবার প্রত্যাশা অনেক বেশি। আমি একা কিছু করতে পারব না। চিকিৎসক, নার্স, আমার দপ্তরের কর্মকর্তা আর জনগণ সবার সহযোগিতা দরকার হবে। আমার মন্ত্রণালয়ের অফিস সহকারী থেকে আমি পর্যন্ত সবাই যদি একসঙ্গে কাজ করতে পারি, তাহলে কিন্তু লক্ষ্য অর্জন সম্ভব।
কালবেলা: স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালনে কী কী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে বলে মনে করেন?
ডা. সামন্ত লাল সেন: জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া আর দুর্নীতি বন্ধ করা আমার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। স্বাস্থ্য খাত নিয়ে আপনারা অনেক কিছু জানেন। বিভিন্ন সময়ে আমাকে বলেছেনও। রোববার অনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব গ্রহণ করব। তারপর প্রথমেই খুঁজে বের করব স্বাস্থ্য খাতে কী কী সমস্যা আছে; কোথায় কোন ফাঁকফোকর আছে। তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আমার জন্য কঠিন কিছু হবে না। আমি যদি বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারির পাঁচ বেড থেকে ৫০০ বেড বানাতে পারি, তাহলে কেন ভালো চিকিৎসাসেবা দিতে পারব না! নিশ্চয় পারব।
কালবেলা: চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে সাধারণ মানুষের অনেক অভিযোগ। তাদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে আপনার পরিকল্পনা কী?
ডা. সামন্ত লাল সেন: অবশ্যই পরিকল্পনা আছে। আমি কিন্তু প্রান্তিক মানুষের সঙ্গেও কাজ করেছি। চেষ্টা করব, স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর যে স্বপ্ন ছিল জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া, সেই স্বপ্নটাকে বাস্তবায়ন করার জন্য কাজ করব. যেন প্রান্তিক পর্যায়ের রোগীরা ভালো চিকিৎসা পান। এটা আমার প্রধান লক্ষ্য। আমি যে শুধু ঢাকা শহর নিয়ে ব্যস্ত থাকব, সেটা না। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া—সব জায়গার মানুষের জন্য কাজ করব। এক সময় সারা দেশে চষে বেড়িয়েছি। আমি জানি মানুষের কী কষ্ট, মানুষের কী অবস্থা। প্রান্তিক এলাকায় যদি ভালো একটা হাসপাতাল থাকে, সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসককে যদি সব ধরনের সাপোর্ট দিতে পারি, তাহলে কিন্তু তিনি অবশ্যই ভালো কাজ করবেন। আমি এক সময় হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলায় কাজ করতাম। তখন নৌকায় যাতায়াত করতে হতো। এখন তো যোগাযোগ ব্যবস্থার অনেক উন্নয়ন হয়েছে। প্রত্যেকের হাতে স্মার্ট ফোন আছে। মুহূর্তের মধ্যে সারা দেশের খোঁজ ঘরে বসেই নিতে পারছেন।
কালবেলা: আপনার অনেক পরিকল্পনার মধ্যে মূল ফোকাস কোন বিষয়ে থাকবে?
ডা. সামন্ত লাল সেন: জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া আমার পরিকল্পনার মূল ফোকাস। সাধারণ মানুষ যেন স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত না হয়। কীভাবে পৌঁছে দেওয়া যায় সেই লক্ষ্য নিয়ে আমি এগিয়ে যেতে চাই।
কালবেলা: সরকারি হাসপাতালে যন্ত্রপাতি অকেজো। লোকবল (চিকিৎসক, নার্স, টেকনোলজিস্ট) সংকট। এসব কারণে রোগীরা বেসরকারি হাসপাতালে যেতে বাধ্য হন। আর সামর্থ্যবানরা বিদেশে চিকিৎসা নেন। চিকিৎসাসেবায় বিদেশনির্ভরতা কিংবা বেসরকারীকরণ কমাতে কী ধরনের উদ্যোগ নেবেন?
ডা. সামন্ত লাল সেন: আমাদের চিকিৎসকরাও বিশ্বমানের চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন। বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণের প্রবণতা কমাতে আমাদের চিকিৎসকরা কাজ করছেন। আশা করি সবার মধ্যে আস্থা তৈরি হবে। আমরাও বিদেশে চিকিৎসা দিয়ে থাকি। কিছুদিন আগে আমরা একটা টিম ভুটানে গিয়েছিলাম। সেখানে ১৪টা অপারেশন আমরা করেছি। বর্তমানে ভুটান থেকে একজন রোগী বাংলাদেশে এসেছেন। সপ্তাহখানেক আগে অপারেশন করেছি। এটা কিন্তু সরকারিভাবে বিদেশি রোগী বাংলাদেশে চিকিৎসা প্রদানের ইতিহাসে প্রথম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভুটানের প্রধানমন্ত্রীও এ বিষয়ে অবগত আছেন। সুতরাং আমরা চেষ্টা করছি চিকিৎসার মানোন্নয়ন করতে। একটা জিনিস মনে রাখতে হবে, সরকারি সম্পদের কোনো অপচয় আমি হতে দেব না। যন্ত্রপাতি অকেজো হয়ে পড়ে আছে, এটা সত্য কথা। যন্ত্রপাতি পরে থেকে নষ্ট হয়েছে, এসব আমার দ্বারা সম্ভব না।
কালবেলা: স্বাস্থ্য খাতে লোকবল নিয়োগ, কেনাকাটায় অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এই অপরাধের চক্র ভাঙতে কী উদ্যোগ গ্রহণ করবেন?
ডা. সামন্ত লাল সেন: স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি হয় সেটা আমিও তো আপনাদের মতো শুনছি। কিন্তু কোথায় এই দুর্নীতি হয়, কীভাবে হয়, সেটা তো আমি এখনও দেখিনি। আমি অস্বীকার করছি না এসব অভিযোগ সত্য নয়। অবশ্যই সত্যতা আছে। প্রধানমন্ত্রী আমার ওপর আস্থা রেখেছেন। এত লোকের মাঝে আমাকে উনি (প্রধানমন্ত্রী) বেছে নিয়েছেন। সুতরাং তারও তো একটা প্রত্যাশা আছে। আমিও চেষ্টা করব যেভাবেই হোক প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যাশাটা পূরণ করতে। কোনো অনিয়ম কিংবা সিন্ডিকেটকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না।
কালবেলা: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের মূল স্লোগান ছিল স্মার্ট বাংলাদেশ। স্মার্ট স্বাস্থ্য খাত তৈরিতে আপনি কতটা প্রস্তুত?
ডা. সামন্ত লাল সেন: অবশ্যই আমি এই বিষয়ে গুরুত্ব দেব। স্মার্ট স্বাস্থ্যসেবার একটি পন্থা টেলিমেডিসিন সেবা কিন্তু শুরু হয়েছে। করোনার সময়ে আমি নিজেও করেছি। স্মার্ট বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রীর একটা স্লোগান। সেটাকে বাস্তবায়ন করার জন্য যা যা করা দরকার আমি করব। আমি স্মার্ট বা টেকনোলজি বেসিস স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কাজ করব।
কালবেলা: চিকিৎসদের মনোন্নয়নে আপনার ভূমিকা বা পদক্ষেপ কী হবে?
ডা. সামন্ত লাল সেন: আমার নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আমাদের স্বাস্থ্য খাতকে ঠিক করতে হলে চিকিৎসক সমাজকে ভালো রাখতে হবে। চিকিৎসক যদি ভালো না থাকে, তাহলে তারা সেবা দিতে পারবেন না। চিকিৎসক সমাজের অনেক কষ্ট আমি শুনি। আমার তরুণ চিকিৎসকরা বলে, স্যার আমি পদোন্নতি পাচ্ছি না। আমি যাদের দিয়ে কাজ করাব, তাদের যদি শান্তিতে না রাখি তাহলে তাদের থেকে কাজ আদায় করব কীভাবে। সুতরাং তাদেরকে ভালো রাখতে হবে। আমার প্রত্যেকটি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক, নার্স সবাইকে দেখতে হবে। হাসপাতালে দেখি রোগীরা বেড পান না, মেঝেতে শুয়ে থাকেন। বাংলাদেশের চিকিৎসকদের অনেক গুণ আছে। তারা অনেক ভালো ভালো কাজ করেছেন। আমার চিকিৎসকদের ভালো সুযোগ-সুবিধা দিতে পারলে তারা বিশ্বমানের সেবা দিতে পারবেন।
কালবেলা: আপনাকে ধন্যবাদ
ডা. সামন্ত লাল সেন: আপনাকে ও কালবেলার পাঠকদের ধন্যবাদ।