মাথা ন্যাড়া, চোখে মোটা চশমা, পরনে চার খণ্ডের পরিধেয় বস্ত্র গেরুয়া ত্রি-চীবর, পায়ে চটি আর হাতে ব্রহ্মের মালা—দেখলেই সম্মান আর ভক্তি চলে আসে। তার নাম ডিপু চাকমা। তিনি একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু ও সম্মানিত মানুষ হিসেবে পরিচিত। খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ির আদর্শ বৌদ্ধবিহারের প্রধান পুরোহিত তিনি। লোভ আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে শান্তির বার্তা ছড়ানো, সমাজের হিংসা আর বিদ্বেষের অন্ধকারে ধৈর্য ও সহনশীলতার আলো ছড়ানো তার কাজ। প্রকাশ্যে তাকে সে কাজেই দেখা যায়। কিন্তু আড়ালে মাদক পাচারে জড়িত এই বৌদ্ধ ভিক্ষু!
গত বুধবার রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকা থেকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) লালবাগ বিভাগের সদস্যরা এই বৌদ্ধ ভিক্ষুকে ১৬ হাজার পিস ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করেন। একই সঙ্গে তার দুই সহযোগী আপেল বড়ুয়া ও মোমিন হাওলাদারকেও গ্রেপ্তার করা হয়। এর পরই বেরিয়ে আসে ধর্মীয় লেবাসে তার ইয়াবা পাচারের তথ্য।
অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া ডিবির লালবাগ বিভাগের ডিসি (অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) মশিউর রহমান কালবেলাকে বলেন, তাদের কাছে গোয়েন্দা তথ্য ছিল—পার্বত্য অঞ্চলের একজন মর্যাদাবান ব্যক্তি অবৈধ মালপত্র নিয়ে রাজধানীর মগবাজার বা রমনা এলাকায় আগমন করবেন। সেই তথ্যানুযায়ী ওই এলাকায় গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে হাতিরঝিলের বড় মগবাজার এলাকা থেকে সন্দেহভাজন হিসেবে ডিপু চাকমা ও তার দুই সহযোগীকে আটক করা হয়। ডিপু চাকমার ব্যাকপ্যাকে বিশেষভাবে রাখা ১৬ হাজার পিস ইয়াবা জব্দ করা হয়।
ডিবির এই কর্মকর্তা বলেন, এমন ধর্মীয় নেতাকে ইয়াবাসহ ধরার পর ডিবির টিমও বিব্রত হয়। বৌদ্ধ ভিক্ষু হিসেবে তার কাজ ছিল লোভ আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া। আলোকিত মানুষ হিসেবে সমাজের হিংসা আর বিদ্বেষের অন্ধকারে ধৈর্য ও সহনশীলতার আলো ছড়ানোর কথা ছিল তার। তিনিই অন্ধকার পথে হেঁটেছেন দীর্ঘদিন ধরে।
অনলাইন জুয়ার টাকা জোগাতে ইয়াবা পাচারে তিনি: একজন ধর্মীয় নেতা কেন, কীভাবে ইয়াবা পাচারের মতো অপরাধে জড়ালেন—সেই তথ্যানুসন্ধান শুরু করেছেন ডিবির কর্মকর্তারা। অবশ্য প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ডিপু চাকমা জানিয়েছেন, তিনি মোবাইল ফোন ব্রাউজ করতে করতে অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়ে পড়েন। জুয়া খেলতে গিয়ে একপর্যায়ে কয়েক লাখ টাকা খুইয়ে ফেলেন। এভাবে নিজের বেতন, দান দক্ষিণা, মৃত বাবার ভিটামাটি বিক্রয় করা টাকা এবং মায়ের ধার করা টাকাও জুয়ায় ঢালেন লাভের আশায়। তবে সর্বস্বান্তে দিশেহারা হয়ে যাচ্ছিলেন। এর পরই তার এক শিষ্য আপেল বড়ুয়ার কাছে নিজের হতাশার কথা বলেন। শেষ পর্যন্ত ঘুরে দাঁড়াতে আপেল বড়ুয়ার হাত ধরে ইয়াবা পাচারে নেমে পড়েন।
ডিবির অ্যাডিশনাল ডিআইজি মশিউর রহমান কালবেলাকে বলেন, চিরকুমার ডিপু চাকমা ছোটবেলা থেকেই ধূমপানে আসক্ত। খাগড়াছড়ি জেলা সদরে পুরোহিতের দায়িত্বে থাকার সময়ই মোবাইল ব্রাউজিং করে পরিচিত হয়েছিলেন অনলাইন জুয়ায়। তা তার আসক্তিতে রূপ নেয়। ঋণগ্রস্ত হয়ে যাওয়ার সুযোগটাই কাজে লাগায় ইয়াবার কারবারিরা। তিনিও পা দেন তাতে। এরপর কক্সবাজারের টেকনাফ, খাগড়াছড়ি আর বান্দরবান থেকে বৌদ্ধ ভিক্ষুর বেশে ঢাকায় ইয়াবা পাচার করে আসছিলেন।
ডিবি কর্মকর্তা মশিউর বলেন, ধর্মীয় বেশভূষা দেখে টেকনাফ থেকে ঢাকা পর্যন্ত কোনো চেকপোস্টেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাকে সন্দেহ করত না। সেই সুযোগটাই কাজে লাগিয়ে গত কয়েক বছরে অর্ধশতবার ইয়াবার চালান নিয়ে ঢাকায় এসেছেন তিনি। যদিও প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, ৮ থেকে ১০ বার ইয়াবা নিয়ে ঢাকায় এসেছেন। তবে ইয়াবার মূল উৎস মিয়ানমারের কোনো মাদক কারবারির সঙ্গে ডিপু চাকমার যোগাযোগ রয়েছে কি না, তা যাচাই করা হচ্ছে।
ইয়াবার চালান এনে কত টাকা পেতেন ডিপু চাকমা?: গ্রেপ্তারের পর ডিপু চাকমা স্বীকার করেছেন, তিনি বৌদ্ধ ভিক্ষু হওয়ায় পথেঘাটে কেউ তাকে সন্দেহ করত না, উল্টো সম্মান নিয়েই চলতেন। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রতিবারই বড় চালান নিয়ে ঢুকতেন ঢাকা ও আশপাশের এলাকায়। ইয়াবার মূল ডিলাররা তার জন্য ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে রুম ভাড়া করে রাখত। তিনি নির্ধারিত রুমে অবস্থান নিলে মোমিন হাওলাদার তার আনা চালান বুঝে নিত। তিনি জেনেছেন, মোমিন তার কাছ থেকে ইয়াবা নিয়ে ঢাকাসহ গাজীপুর, উত্তরবঙ্গ এবং দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা এবং থানা পর্যায়ে তা সরবরাহ করত।
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে ডিপু চাকমা বলেন, এই অবৈধ কাজ করে তিনি প্রতি চালানে সর্বনিম্ন ১০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা করে পেতেন। সঙ্গে যাতায়াত ভাড়া এবং খাবারের খরচও দেওয়া হতো তাকে।
ডিবি কর্মকর্তা মশিউর রহমান কালবেলাকে বলেন, মূলত আপেল বড়ুয়ার মাধ্যমে কক্সবাজারসহ ওই অঞ্চল থেকে ইয়াবা নিয়ে ঢাকায় আসতেন ডিপু চাকমা। আপেলকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পাশাপাশি ঢাকার অংশে মোমিন নামে যে ইয়াবার চালান গ্রহণ করত, তাকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই তিনজনকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে বিস্তারিত তথ্য মিলবে।
তিনি বলেন, অনলাইন জুয়ার আসক্তির কারণে একজন সম্মানিত মানুষ কীভাবে পতিত হতে পারেন অসম্মানের পঙ্কিলতায়, একজন আলোকিত মানুষ নিজেই কীভাবে ডুবে যেতে পারেন অন্ধকারে, একজন সচ্ছল মানুষ কীভাবে হতে পারেন নিঃস্ব, একজন দায়িত্বশীল ধর্মগুরু কীভাবে হতে পারেন ইয়াবা নামক মাদকের পাচারকারী, ডিপু চাকমা তার এক করুণ দৃষ্টান্ত।
জানা গেছে, ৩০ বছর বয়সী ডিপু চাকমার বাবা রূপায়ন চাকমা ছিলেন খাগড়াছড়ি সদরের এক কাঠুরিয়া। সংসারের ঘানি টানার ক্লান্তি আর লিভারের রোগে আক্রান্ত হয়ে ৪৫ বছর বয়সেই মারা যান তিনি। এর আগে তিনি স্বপ্ন দেখতেন ছেলে ডিপু চাকমা একজন প্রথিতযশা বৌদ্ধ ভিক্ষু হিসেবে লোভ আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দেবেন। ছেলে ডিপু চাকমা সেই পথে অগ্রসরও হয়েছিলেন বহুদূর। আলো ও শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দিতে সাফল্যের মাঝপথে ছিলেন প্রায়। তরুণ এই বৌদ্ধ ভিক্ষু ২০১২ সালে খাগড়াছড়ি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি এবং ২০১৪ সালে দীঘিনালা ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ২০১৫ সালে তিনি রাঙামাটি রাজবিহার পালি কলেজ থেকে পালি শাস্ত্রে পাঁচ বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা কোর্স সম্পন্ন করেন। সঙ্গে দীক্ষা নেন পুরোহিত হওয়ার, পরেন কঠিন চীবর ও গেরুয়া বসন।
ডিপু চাকমা বিভিন্ন বৌদ্ধবিহারে পুরোহিতের দায়িত্ব পালন শেষে চট্টগ্রামের বায়েজিদ থানাধীন বৌদ্ধবিহারের প্রধান হিসেবে বছরখানেক দায়িত্ব পালন করেন। পরে দায়িত্ব গ্রহণ করেন খাগড়াছড়ি জেলা সদরে। সেখান থেকে বদলি হয়ে সর্বশেষ খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি থানাধীন আদর্শ বৌদ্ধবিহারের প্রধান হিসেবে দুই বছর ধরে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।