চায়ের দোকানে আড্ডা, ট্রেনের সিট নিয়ে দ্বন্দ্বসহ তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বারবার সংঘর্ষে জড়াচ্ছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। প্রতিটি সংঘর্ষেই তাদের হাতে থাকে লাঠিসোঁটা, রামদাসহ ধারালো অস্ত্র। গত বুধবার রাতে এক দফা সংঘর্ষ হয়। পরদিন বৃহস্পতিবার দুই দফায় সংঘর্ষে জড়ায় ছাত্রলীগ। সেদিন আহত হন ২১ জন। ১৮ ঘণ্টার ব্যবধানে গতকাল শুক্রবার বিকেল সাড়ে ৪টায় আবারও সংঘর্ষ বাধে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে। এদিন রাত ১০টা পর্যন্ত চলে সংঘর্ষ। এতে আহত হয়েছেন পুলিশ সদস্যসহ অন্তত ১৫ জন। তাদের মধ্যে পুলিশসহ চারজনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত (রাত ১১টা) বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই হলে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান চালিয়েছে পুলিশ।
ছাত্রলীগের এ দুটি পক্ষ সিক্সটি নাইন ও চুজ ফ্রেন্ডস উইথ কেয়ারের (সিএফসি) মধ্যে দফায় দফায় এ সংঘর্ষ হয়। গত ৪৮ ঘণ্টায় পাঁচবার সংঘর্ষে জড়িয়েছেন তারা। সিএফসির নেতাকর্মীরা শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী ও সিক্সটি নাইন সাবেক সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী হিসেবে ক্যাম্পাসে পরিচিত।
গত বুধবার রাতে সিক্সটি নাইন ও বিজয় পক্ষের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছিল। বৃহস্পতিবার চায়ের দোকানে চেয়ারে বসা নিয়ে বগিভিত্তিক গ্রুপ সিএফসির এক কর্মীকে মারধর করেন সিক্সটি নাইন গ্রুপের কর্মীরা। এ নিয়ে সংঘর্ষে জড়ান তারা। দুপক্ষের হামলা, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপে আহত হন ২১ জন।
আগের দিনের সংঘর্ষের ঘটনা নিয়ে উত্তেজনা চলছিল দুপক্ষের মধ্যেই। গতকাল বিকেলে সিক্সটি নাইনের নেতাকর্মীরা শাহজালাল ও সিএফসির নেতারা শাহ আমানত হলের সামনে অবস্থান নেন। এরপর একে অপরকে ধাওয়া দিচ্ছিলেন তারা। একে অপরকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ও কাচের বোতল নিক্ষেপ করছেন। তারা আবাসিক হলের কক্ষ ও শৌচাগারের দরজা, খাট রাস্তায় এনে ঢাল (শিল্ড) হিসেবে ব্যবহার করছেন। এভাবে একে অপরের ইটপাটকেল আটকাচ্ছেন। পুলিশ ও প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা উপস্থিত থাকলেও তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলেন না। সংঘর্ষে পুলিশ সদস্যসহ উভয় পক্ষের অন্তত ১৫ জন আহত হয়েছেন। আহতদের প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে পুলিশ সদস্যসহ গুরুতর আহত চারজনকে চমেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বিকেলে শুরু হওয়া এই সংঘর্ষ চলে রাত ১০টা পর্যন্ত। পুলিশসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়। পরে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই হলে অভিযান চালায় পুলিশ। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত (রাত ১১টা) পুলিশের এই অভিযান চলছিল।
ছাত্রলীগের এই দুপক্ষের এমন সংঘর্ষের ঘটনায় আতঙ্কিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন, প্রশাসন চাইলেই দেশীয় অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ করা সম্ভব। প্রতিটি হল তল্লাশি করলেই মিলবে অস্ত্র।
এদিকে একাধিক শিক্ষার্থী বলেছেন, বিভিন্ন হলে ছাত্রলীগের দখলে থাকা রুমগুলোতে রয়েছে ব্যাপক পরিমাণে অবৈধ অস্ত্র, যা দিয়ে তারা রীতিমতো ভয়ভীতিও দেখাচ্ছে। অন্যদিকে সামান্য থেকে সামান্য কিছু হলেই এসব অবৈধ অস্ত্র সামনে আনে তারা।
সিক্সটি নাইন গ্রুপের নেতা ও শাখা ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক সাঈদুল ইসলাম সাঈদ বলেন, ‘দুপুরেও (বৃহস্পতিবার) আমাদের একটা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছিল। ওটা যখন আমরা সমাধানের দিকে যাচ্ছিলাম তখন রেলস্টেশন এলাকায় সিএফসির জুনিয়ররা আমাদের এক সিনিয়র কর্মীর সঙ্গে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বেয়াদবি করে। এটা নিয়ে দুই হলের মধ্যে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। সিএফসি বর্তমানে নেতৃত্বহীন অবস্থায় আছে। তাই ওদের ছেলেরা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে।’
সিএফসির নেতা ও শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি মির্জা খবির সাদাফ বলেন, ‘আমাদের একটা ছেলেকে সিক্সটি নাইনের ছেলেরা স্টেশনে বিনা কারণে মারধর করেছে। তারা আসলে নেতৃত্ব সংকটে ভুগছে। ওরা জানে যে কমিটি হবে; কিন্তু চায় না কমিটি আসুক। তাই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এগুলো করেছে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর নুরুল আজিম সিকদার বলেন, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য ক্যাম্পাসে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে আছে। সংঘর্ষের ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্তের রিপোর্ট পেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ডা. আবু তৈয়ব বলেন, এখন পর্যন্ত যাদের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে, তারা ভালো আছেন। রাতে (গতকাল) পুলিশ সদস্যসহ চারজনকে চমেক হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার বলেন, অবৈধ দেশীয় অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধে প্রশাসন ইতোমধ্যে ব্যবস্থা নিয়েছে। অনেক হল থেকেই এসব অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। সামনে আরও অভিযান চালানো হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো অবৈধ দেশীয় অস্ত্র থাকবে না।