পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়। পরিসংখ্যান ব্যবস্থাপনা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নের রূপরেখা তৈরি এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। একই সঙ্গে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন প্রকল্প যাচাই-বাছাই, অনুমোদন এবং বাস্তবায়ন অগ্রগতি দেখভাল করা এই মন্ত্রণালয়ের কাজ। বিভিন্ন সময় মন্ত্রণালয় এবং বিভাগগুলোর চলমান প্রকল্পগুলো নির্ধারিত মেয়াদে শেষ করার তাগাদা দেওয়ার কাজও করে থাকে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করা যে মন্ত্রণালয়ের কাজ, খোদ সেই মন্ত্রণালয়েরই চলমান প্রকল্পে চলছে কচ্ছপগতি। যেটাকে হতাশাব্যঞ্জক বলছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়েরই সংশ্লিষ্ট বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)।
উন্নয়ন বাজেটে সরকারি বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনার দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০১৭ সালে ‘কার্যক্রম বিভাগে একটি নতুন ডাটাবেজ সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে উন্নয়ন বাজেট ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি শক্তিশালীকরণ’ শীর্ষক একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। তিন বছর মেয়াদি প্রকল্পটি বাস্তবায়নকারী সংস্থা পরিকল্পনা কমিশনের কার্যক্রম বিভাগ। এডিপি-আরএডিপি প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় আধুনিক এমআইএস সহায়তা প্রদানের জন্য একটি নতুন ডাটাবেজ ম্যানেজমেন্ট (এএমএস) প্রতিষ্ঠা, আইএমইডি, ইআরডি এবং অর্থ বিভাগের ডাটাবেজের সঙ্গে ডিজিটাল সংযোগ স্থাপন এবং উচ্চতর প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা কর্মসূচির মাধ্যমে বাজেট ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ একটি কার্যকর নলেজ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (কেএমএস) স্থাপন এবং প্রকল্প পরিচালকদের সম্পৃক্ত করে এডিপি-আরএডিপি প্রণয়ন করার উদ্দেশ্যে প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। ২০১৭ সালে নেওয়া প্রকল্পটি শেষ করার কথা ছিল ২০২০ সালে। কিন্তু নির্ধারিত মেয়াদে শেষ করতে না পারায় প্রকল্প সংশোধন করে প্রথমে মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০২৩ সাল পর্যন্ত। সেই সময়ের মধ্যেও কাজ শেষ না হওয়ায় দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০২৫ সাল পর্যন্ত।
বারবার সংশোধন করেও গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পে গতি পাচ্ছে না। তিন বছরের প্রকল্প সাড়ে ছয় বছর শেষে অর্ধেকের কিছু বেশি কাজ হয়েছে। এমনকি প্রকল্পের জনবলও নিয়োগ করা হয়নি। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী হয়নি প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। প্রকল্পের অগ্রগতি প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কাজ হয়েছে ৫৮ শতাংশ। অর্থাৎ নির্ধারিত মেয়াদের দ্বিগুণ সময় বাড়িয়েও অর্ধেকের একটু বেশি কাজ হয়েছে। ৩৮ কোটি ৪০ লাখ টাকার প্রকল্পে এখন পর্যন্ত খরচ হয়েছে ২২ কোটি ৩০ লাখ টাকা।
প্রকল্প শেষ না হলেও এডিপি প্রণয়নসহ এই সিস্টেমে বিভিন্ন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তবে ছয় বছরেও জনবল নিয়োগ না হওয়ায় সিস্টেমে দেখা দিচ্ছে নানান সমস্যা। এই সিস্টেমে এডিপি প্রণয়নের কাজ সহজ হলেও দক্ষ জনবল না থাকায় বিভিন্ন সমস্যার মুখে পড়তে হচ্ছে পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তাদের। জানা গেছে, জনবল না থাকায় এখনো পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের দিয়ে কাজ করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে একাধিক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেছেন, এডিপি প্রণয়নসহ বিভিন্ন কার্যক্রম অনলাইন-নির্ভর হওয়ায় আগের থেকে অনেকটা সহজ হয়েছে। তবে প্রকল্পের কাজ যেহেতু এখনো শেষ হয়নি, এজন্য কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন সময় সমস্যা দেখা দেয়। সেক্ষেত্রে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। তাতে অনেক সময় নষ্ট হয়।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রকল্পের আওতায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে ছয় বছর হয়ে গেলেও এখনো প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শেষ হয়নি। জানা গেছে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ৫৮ জনের মধ্যে ৪৬ জনকে বৈদেশিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। আর ৬ হাজার ৯৭৭ জনের মধ্যে প্রায় ৪ হাজার ৫০০ জনকে স্থানীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনের আলোচ্য প্রকল্পটি সরেজমিন পরিদর্শন করে মূল্যায়ন প্রতিবেদন দিয়েছে আইএমইডি। প্রতিবেদনে প্রকল্পের এমন অগ্রগতিকে হতাশাব্যঞ্জক উল্লেখ করে দ্রুত জনবল নিয়োগসহ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রায় পাঁচ বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও প্রকল্পের আর্থিক ও বাস্তব অগ্রগতি ৫৭ দশমিক ৯৯ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি অর্জনে তৎপরতা বৃদ্ধিসহ নির্ধারিত সময়ে বাকি কাজ সমাপ্তির লক্ষ্যে প্রকল্প কর্তৃপক্ষকে আরও কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
ডিপিপির সংস্থান অনুযায়ী প্রকল্প মেয়াদের মধ্যে সব কাজ শেষ করার জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে পরিকল্পনা বিভাগ ও আইএমইডিতে পাঠানোসহ প্রকল্পের অবশিষ্ট কার্যাবলি সম্পাদন নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতিসহ সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক ও কার্যক্রম বিভাগের যুগ্ম প্রধান আনার কলি কালবেলাকে বলেন, সিস্টেম গড়ে উঠতে একটু বেশি সময় লেগে গেছে। এ ছাড়া প্রকল্পের পরিধি বৃদ্ধির কারণে সময় বেশি লাগছে। তবে বর্ধিত মেয়াদের আগেই বাকি কাজ সম্পন্ন করা হবে।
জনবল নিয়োগের বিষয়ে তিনি বলেন, আগে কয়েকজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তারা চলে যাওয়ার পর থেকে খালি রয়েছে। এ ছাড়া দক্ষ প্রার্থী (ক্যান্ডিডেট) না পাওয়ায় নিয়োগ কার্যক্রম সম্পন্ন হয়নি। তবে এখন জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। দ্রুতই জনবল নিয়োগ দেওয়া হবে। প্রশিক্ষণের বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক বলেন, প্রকল্পের আওতায় বৈদেশিক প্রশিক্ষণ হবে না। তবে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী স্থানীয় প্রশিক্ষণ নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে সম্পন্ন হবে।