রাজধানীর মুগদা এলাকার বেশিরভাগ সড়ক খানাখন্দে ভরা। অলিগলিতে যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ। মুগদা মেডিকেল থেকে বড় মসজিদ যাওয়ার সড়কে জমে আছে পানি। স্থানীয় এক বাসিন্দা জানালেন, রাতে কয়েল দিয়েও কাজ হয় না, দিনের বেলাও কামড়ায় মশা। এখন সব জায়গায় শুনছি ডেঙ্গু আর ডেঙ্গু। সবসময় ভয়ে থাকি। সিটি করপোরেশনের লোকজন মাঝেমধ্যে ধোঁয়া দিয়ে যায়। তাও অলিগলিতে আসে না। এই ধোঁয়া দিয়ে কোনো লাভ হয় বলে মনে হয় না।
মুগদা ঝিলপাড় এলাকার বাসিন্দা সাইদুর রহমান বলেন, ‘একটু বৃষ্টি হলেই এই এলাকায় পানি জমে। এই এলাকা সবসময় স্যাঁতসেঁতে হয়ে থাকে। ঠিকমতো পরিষ্কার না করায় বেশি মশা থাকে।’ আশপাশের মান্ডা, মানিকনগর, খিলগাঁও, গোড়ান ও বাসাবোতেও মশার রাজত্ব। এসব এলাকা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরিপে ডেঙ্গুর ‘উচ্চ ঝুঁকিতে’ রয়েছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, সপ্তাহে দু-এক দিন ফগার মেশিন দিয়ে স্প্রে করতে আসে করপোরেশনের লোকজন। অলিগলি ও ঘিঞ্জি এলাকায় মশার বিচরণ বেশি। তবে ফগার মেশিন দিয়ে মশককর্মীরা মাঝেমধ্যে স্প্রে করে প্রধান সড়কগুলোতে।
মায়াকানন, সবুজবাগ, বাসাবো এলাকার বাসিন্দারাও মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ। তারা বলছেন, কোনোভাবেই মশার অত্যাচার থেকে রেহাই পাওয়া যাচ্ছে না। মশা নিধন অভিযান খুব একটা দেখা যায় না। তবে স্থানীয় কাউন্সিলর চিত্তরঞ্জন দাসের দাবি, অন্যান্য এলাকার চেয়ে এ এলাকায় মশার উৎপাত কম। তিনি বলেন, নিয়মিত সকালে কীটনাশক ও বিকেলে ফগার মেশিন দিয়ে স্প্রে করছি। নতুন নির্মিত ভবনগুলোতে গিয়ে দেখছি কোথাও পানি জমে আছে কি না। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সচেতনতামূলক কাজ করে যাচ্ছি।
রাজধানীর অনেক স্থানের মতো ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩১ নম্বর ওয়ার্ডেও ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিয়েছে। এ ওয়ার্ডের একটি বড় জায়গাজুড়ে রয়েছে ষাট ও সত্তরের দশকে নির্মিত ভবন। রয়েছে উর্দুভাষী ক্যাম্প। সরেজমিন মোহাম্মদপুর এলাকায় দেখা গেছে, সারি সারি বাড়ির মাঝখানে সুইপার প্যাসেজ। আর সেই প্যাসেজে ফেলা হয় ময়লা-আবর্জনা। বিষয়টি অনৈতিক ও দৃষ্টিকটু হলেও বছরের পর বছর চেষ্টা করেও এই কর্মকাণ্ড বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। বৃষ্টির কারণে প্যাসেজে জমা ময়লা-আবর্জনা এবং পলিথিনে জমছে পানি। নিয়মিত পরিষ্কার না করায় সেখানে মশার লার্ভা জন্ম নিচ্ছে। সেই মশা ছড়িয়ে পড়ছে পুরো এলাকায়। এমন বেশ কয়েকটি প্যাসেজ রয়েছে ওয়ার্ডে। সব প্যাসেজেই পানি জমার চিত্র দেখা গেছে। সুইপার প্যাসেজে ময়লা, পানি জমে থাকার বিষয়ে আপত্তি স্থানীয়দের। তবে সচেতনতার অভাবে বিষয়টি সমাধানে পৌঁছাচ্ছে না বলে জানান স্থানীয়রা।
ওয়ার্ডটির কাউন্সিলর শফিকুল ইসলাম সেন্টু বলেন, সুইপার প্যাসেজ ছাড়া আর কোথাও জমাটবদ্ধ পানি নেই। এই প্যাসেজের বিষয়েও নগর ভবন স্থায়ী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সুইপার প্যাসেজগুলো পরিষ্কার রাখতে পারছি না। মানুষ শুধু ময়লা ফেলে। আমরা পরিষ্কার করি, এক সপ্তাহের মধ্যে ভরে যায়। ওখানেই পানি জমে।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন বছরে শত কোটি টাকা খরচ করেও নগরবাসীকে মশার যন্ত্রণা ও ডেঙ্গু আতঙ্ক থেকে রক্ষা করতে পারছে না। দক্ষিণ সিটি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ২০১৯-২০ থেকে ২০২১-২২ পর্যন্ত এই তিন অর্থবছরে মশা নিধনের জন্য মোট ৮০ কোটি ২১ লাখ টাকা ব্যয় করেছে। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রস্তাবিত বাজেট ৩০ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে কীটনাশক কিনতে ২৫ কোটি, যন্ত্রপাতি কিনতে ২ কোটি ও পরিবহনের জন্য বাজেট রাখা হয়েছে ৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। এদিকে ঢাকা উত্তর সিটি মশক নিয়ন্ত্রণে ২০১৯-২০ অর্থবছরে খরচ হয়েছে ৭০ কোটি, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫৫ কোটি ৫০ লাখ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫৯ কোটি ৮৫ লাখ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১০১ কোটি টাকা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকাকে মশামুক্ত করা কঠিন। বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে কার্যক্রম পরিচালনা করলে সফলতা মিলবে। দুই সিটি করপোরেশনের এমন কোনো ব্যবস্থাই নেই। নেই কোনো কীটতত্ত্ববিদ। জলবায়ুগত কারণে মশার অভ্যাসসহ নানা দিক পরিবর্তন হয়েছে বলা হলেও এ নিয়ে কোনো গবেষণা নেই।
কীটতত্ত্ববিদ ও গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, এ বছর দেশের সর্বত্র ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যে ডেঙ্গু রোগী আরও বাড়বে। কারণ হিসেবে তিনি জানান, ছুটি থাকার কারণে সব কিছু বন্ধ ছিল। এতে মশার বিস্তার বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। একজন গবেষক হিসেবে বলতে পারি, আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় ডেঙ্গু সংক্রমিত হবে। ঢাকার পর চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, গাজীপুর, চাঁদপুর, ফরিদপুর, যশোর, বরিশাল ও পটুয়াখালীতে প্রাদুর্ভাব বেশি ঘটবে।
এ বিশেষজ্ঞ জানান, এফডিএমএন বা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এডিস মশার ঘনত্ব বেশি থাকার কারণে সেখানে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বাড়বে এবং সেখান থেকে কক্সবাজারে সংক্রমণ বৃদ্ধি পাবে। এই সময়ে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঠেকাতে বিজ্ঞানভিত্তিকভাবে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। এই নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়ায় সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জনসাধারণকেও সরাসরি সম্পৃক্ত হতে হবে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির বলেন, কারও বাসাবাড়িতে ঢুকে মশা নিধন করা সম্ভব নয়। মানুষ সচেতন না হলে জোর করে কিছু করানো যায় না। মশা নিধনে আমরা বিশেষ কার্যক্রম চালাচ্ছি। যেসব ভবন বা প্রতিষ্ঠানে এডিসের লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা ও অর্থ জরিমানা করা হচ্ছে। এ অভিযানের ফলাফল পেতে একটু সময় লাগবে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ত করে ডেঙ্গু প্রতিরোধে দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা ও সমন্বিত প্রচেষ্টা যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ছিল না, তা বলাই বাহুল্য। আর যেটুকু উদ্যোগ দেখা গেছে, তা পরিস্থিতি বিবেচনায় যে অপ্রতুল কিংবা লোক দেখানো প্রচারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, তা-ও না বললেই চলে। রাজধানীতে ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি রোধ করার যে সম্ভাবনা ছিল, সেদিকে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি বাস্তবে কতটুকু ছিল, তা প্রশ্নবিদ্ধ।
ঢাকার দুই সিটিতে এক দিনে ১৬ লাখ টাকা জরিমানা:
ডেঙ্গু প্রতিরোধে ঢাকায় দুই সিটি করপোরেশনের এডিস মশকনিধন অভিযানে বিভিন্ন ভবনে লার্ভা পাওয়ায় ১৬ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এর মধ্যে উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) সাড়ে ১২ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করেছে। দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) আদায় করেছে ৩ লাখ ৭৩ হাজার টাকা। দুই সিটি করপোরেশনের ভ্রাম্যমাণ আদালত বিভিন্ন আবাসিক ভবন, বাণিজ্যিক ভবন, অফিস ভবনে যাচ্ছে। যেখানে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে জরিমানা করা হচ্ছে।
মন্তব্য করুন