

বহু বছর ধরেই বিজ্ঞানীরা বার্ড ফ্লু বা এইচ৫এন১ ভাইরাস একদিন পাখি থেকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং তা বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সংকট ডেকে আনতে পারে বলে সতর্ক করে আসছেন। নতুন এক গবেষণায় ভারতীয় বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, এমন সংক্রমণ কীভাবে শুরু হতে পারে এবং কোন পর্যায়ে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
বৃহস্পতিবার (১৮ ডিসেম্বর) বিবিসির এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এইচ৫এন১ ধরনের এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াজুড়ে দীর্ঘদিন ধরেই বিদ্যমান। ২০০৩ সাল থেকে ২০২৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ২৫টি দেশে মানুষের মধ্যে ৯৯০টি সংক্রমণের ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। এর মধ্যে ৪৭৫ জন মারা গেছেন। যেখানে মৃত্যুহার প্রায় ৪৮ শতাংশ।
যুক্তরাষ্ট্রে এ ভাইরাসে ১৮ কোটি পাখি আক্রান্ত হয়েছে, ১৮টি অঙ্গরাজ্যের এক হাজারের বেশি দুগ্ধ খামারে ছড়িয়েছে এবং অন্তত ৭০ জন মানুষ সংক্রমিত হয়েছেন। ভারতে চলতি বছরের জানুয়ারিতে নাগপুরের একটি বন্যপ্রাণী উদ্ধারকেন্দ্রে তিনটি বাঘ ও একটি চিতাবাঘ এই ভাইরাসে মারা যায়।
বিজ্ঞানীরা জানিয়েছে, মানুষের মধ্যে সংক্রমণের লক্ষণ সাধারণত তীব্র ফ্লুর মতো—উচ্চ জ্বর, কাশি, গলা ব্যথা, শরীর ব্যথা এবং কখনো চোখের সংক্রমণ দেখা দেয়। কারও ক্ষেত্রে আবার কোনো লক্ষণই দেখা যায় না। যদিও বর্তমানে মানুষের জন্য ঝুঁকি কম, তবুও ভাইরাসটি নজরদারিতে রেখেছে স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ।
এই উদ্বেগ থেকেই আশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ফিলিপ চেরিয়ান ও গৌতম মেনন একটি নতুন কম্পিউটার মডেল তৈরি করেছেন। বিএমসি পাবলিক হেলথ জার্নালে প্রকাশিত এই গবেষণায় দেখানো হয়েছে, মানুষের মধ্যে এইচ৫এন১ ছড়ালে তা কীভাবে বিস্তার লাভ করতে পারে এবং শুরুতেই কোনো পদক্ষেপ নিলে তা ঠেকানো সম্ভব।
গবেষণায় ‘ভারতসিম’ নামে একটি ওপেন-সোর্স সিমুলেশন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করা হয়েছে, যা আগে কভিড-১৯ বিশ্লেষণে কাজে লাগানো হয়েছিল। গবেষকদের মতে, একটি মহামারি নীরবে শুরু হতে পারে—সংক্রমিত একটি পাখি থেকে প্রথমে কোনো খামারকর্মী বা বাজারে কাজ করা ব্যক্তির শরীরে ভাইরাস ঢুকতে পারে। সবচেয়ে বড় ঝুঁকি তখনই তৈরি হয়, যখন মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ শুরু হয়।
মডেল অনুযায়ী, সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা যদি দুই থেকে ১০ জনের মধ্যে থাকে, তবে তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তবে ১০ জনের বেশি হলে সংক্রমণ সমাজে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা অত্যন্ত বেড়ে যায়।
গবেষণার জন্য তামিলনাডুর নামাক্কাল জেলার একটি গ্রামকে মডেল হিসেবে নেওয়া হয়েছে। এই অঞ্চলটি ভারতের প্রধান পোলট্রি কেন্দ্র, যেখানে হাজারের বেশি খামার ও কোটি কোটি মুরগি রয়েছে। কৃত্রিমভাবে তৈরি একটি গ্রামে বাড়ি, কর্মক্ষেত্র ও বাজার ধরে নিয়ে সংক্রমণের বিস্তার পর্যবেক্ষণ করা হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, পাখি নিধন কার্যকর—তবে কেবল তখনই, যখন ভাইরাস মানুষের শরীরে প্রবেশের আগেই তা করা যায়। মানুষ সংক্রমিত হলে দ্রুত আইসোলেশন ও পরিবারভিত্তিক কোয়ারেন্টিনে সংক্রমণ থামানো সম্ভব। কিন্তু তৃতীয় স্তরের সংক্রমণ শুরু হলে কঠোর ব্যবস্থা, এমনকি লকডাউন প্রয়োজন হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজিস্ট সীমা লক্ষদাওয়ালা বলেন, এই মডেল ধরে নেয় যে ভাইরাস খুব দ্রুত ছড়াবে, কিন্তু বাস্তবে সব ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সংক্রমণ ক্ষমতা সমান নয়। কিছু মানুষ ‘সুপার স্প্রেডার’ হতে পারে—যেমনটা কভিড-১৯–এ দেখা গিয়েছিল।
তিনি জানান, যদি এইচ৫এন১ মানুষের মধ্যে স্থায়ীভাবে ছড়িয়ে পড়ে, তবে তা ২০০৯ সালের সোয়াইন ফ্লুর মতো বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। তবে ইনফ্লুয়েঞ্জার বিরুদ্ধে কার্যকর অ্যান্টিভাইরাল ও সম্ভাব্য টিকার মজুত থাকায় বিশ্ব কিছুটা প্রস্তুত।
গবেষকরা বলছেন, এই ধরনের সিমুলেশন বাস্তব সময়ের তথ্য দিয়ে হালনাগাদ করা সম্ভব। এতে প্রাথমিক পর্যায়েই কোন সিদ্ধান্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
মন্তব্য করুন