দেশের ১০ কোটি নাগরিককে সর্বজনীন পেনশনের আওতায় আনতে চায় সরকার। গত বছরের আগস্টে শুরু হওয়ার পর প্রথম ২০০ দিনে এ কার্যক্রমে যুক্ত হয়েছেন ২১ হাজার ৯৫ জন। সে হিসাবে গড়ে প্রতিদিন সর্বজনীন পেনশন স্কিমে হিসাব খুলছেন ১০৫ জনের মতো মানুষ। এই গতিতে চলতে থাকলে সরকারের নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য সময় লাগবে আড়াই হাজার বছর! এমনকি চলমান গতি শতগুণ বাড়লেও লক্ষ্য অর্জনে প্রায় ২৬ বছর লেগে যাবে। জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের দেওয়া সর্বশেষ তথ্যে এমন চিত্র উঠে এসেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, ২০২০ সালে দেশে ষাটোর্ধ্ব জনসংখ্যা ছিল ১ কোটি ২০ লাখ। এ সংখ্যা ২০৪১ সালে ৩ কোটি ১০ লাখ হবে। গড় আয়ু বৃদ্ধির কারণে ধীরে ধীরে দেশে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকবে। পর্যায়ক্রমে এই গড় আয়ু বেড়ে ৮৫ বছর হবে বলে মনে করা হচ্ছে। এতে অর্থনীতিতে উপার্জনহীন ও নির্ভরশীল মানুষের হারও বাড়বে। বর্তমানে এই হার ৭ দশমিক ৭ শতাংশ, যা ২০৫০ সালে ২৪ শতাংশ এবং ২০৭৫ সালে ৫৮ শতাংশে দাঁড়াবে।
এই যখন পরিস্থিতি, তখন ১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশে সরকারি চাকরি করছেন মাত্র ১৪ লাখ মানুষ। যাদের পেনশন সুবিধা রয়েছে। বাকি ১৮ থেকে ৫০ বছরের বেশিরভাগ মানুষ কৃষি, বেসরকারি খাত, ব্যবসায়ী কিংবা অন্যান্য পেশায় জড়িত রয়েছেন। মূলত এদের কোনো পেনশন নেই। ফলে অবসর জীবন কিংবা বার্ধক্যজনিত কারণে যারা অভাবগ্রস্ত হবেন, তাদের জীবিকার বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। বয়স্ক নাগরিকদের জীপবনযাপনে এই অনিশ্চয়তা দূর করতেই দেশে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সর্বজনীন পেনশন স্কিমে প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা ও সমতা—এই চার ধরনের স্কিম রয়েছে। ২০২৩ সালের ১৭ আগস্ট সারা দেশে একযোগে প্রথমবারের মতো বৃদ্ধবয়সের এই স্বপ্নময় উদ্যোগটি চালু হওয়ার পর গত শনিবার (২ মার্চ, ২০২৪) পর্যন্ত ২০০ দিন পার হয়েছে।
তবে এ সময়ে ওই চার ধরনের স্কিমে মোট ২১ হাজার ৯৫ জন পেনশনার নিবন্ধিত হয়েছে। সেই হিসাবে এখন পর্যন্ত সরকার নির্ধারিত লক্ষ্যের মাত্র শূন্য দশমিক শূন্য ২১ শতাংশ অর্জিত হয়েছে। প্রতিদিন গড়ে নিবন্ধিত হচ্ছেন মাত্র ১০৫ দশমিক ৪৮ জন। এখন পর্যন্ত মোট জমা পড়েছে ৩২ কোটি ৬২ লাখ ৭৫ হাজার ৫০০ টাকা।
২০০ দিনের প্রকাশিত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে পেনশন কর্তৃপক্ষ প্রকাশিত প্রতিবেদনে দুটি প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এর প্রথমটি হচ্ছে, সর্বজনীন পেনশন স্কিমে মানুষের অংশগ্রহণের চলমান এই গতি ভবিষ্যতে অপরিবর্তিত ধরা হয়েছে। অর্থাৎ চলমান গতি বজায় থাকলে ১০ কোটি জনগোষ্ঠীকে পর্যায়ক্রমে পেনশন সুবিধার আওতায় আনতে সময় লাগবে ২ হাজার ৫৯৭ বছর। অন্য হিসাবে অন্তর্ভুক্তির চলমান এই গতি ১০০ গুণ বৃদ্ধি বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এর মানে হচ্ছে, মানুষের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সর্বজনীন পেনশনে অংশ নেওয়ার আগ্রহ জাগ্রত হলে বা জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটে প্রতিদিন গড়ে ১০ হাজার ৫৪৮ জন পেনশনার যোগ হলে ১০ কোটি মানুষকে সর্বজনীন পেনশন স্কিমে ভেড়াতে সময় লাগবে প্রায় ২৬ বছর।
সর্বজনীন পেনশন স্কিমের কচ্ছপ গতিতে চলার আরও একটি উদাহরণ পাওয়া যায় গত রোববারের (৩ মার্চ) নিবন্ধন তথ্যে। এতে দেখা যায়, ২০১তম দিন পর্যন্ত সর্বজনীন পেনশন স্কিমে মানুষের অন্তর্ভুক্তির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার ১৭৭ জনে। অর্থাৎ এক দিনে পেনশনার যোগ হয়েছেন মাত্র ৮২ জন।
এদিকে গত রোববার পর্যন্ত প্রবাস স্কিমে নিবন্ধিত পেনশনারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫৩৭ জনে, যাদের জমাকৃত অর্থের পরিমাণ ২ কোটি ৫৩ লাখ ৫০০ টাকা। এ ছাড়া প্রগতি স্কিমে ১৭ কোটি ৫৭ লাখ ৮৩ হাজার ৫০০ টাকা জমা করে নিবন্ধিত হয়েছেন ৮ হাজার ৪৬ জন। সুরক্ষা স্কিমে যুক্ত হয়েছেন ৮ হাজার ৬৪৪ জন, যারা ১১ কোটি ৫০ লাখ ৬২ হাজার ৫০০ টাকা জমা করেছেন। আর সমতায় ভিড়েছেন ৩ হাজার ৯৫০ জন। তারা এই স্কিমে ১ কোটি ২২ লাখ ১৫ হাজার টাকা জমা করেছেন।
এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদ কালবেলাকে বলেন, ‘সর্বজনীন পেনশনের কাজটি প্রথমে আমার হাত দিয়েই শুরু হয়। পরে তার ধারাবাহিকতায় আজকের বাস্তবতায় গড়িয়েছে। আমি মনে করেছিলাম, এটা চালু হওয়ার পর ব্যাপক সাড়া মিলবে। ভবিষ্যতে হয়তো হবে। তবে শুরুতে এত নিম্নগতি আশা করিনি। এভাবে থাকলে তো সরকারের লক্ষ্য অর্জনে ওই রকম সময়ই লাগার কথা।’
সাড়া না পাওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক এই সিনিয়র অর্থসচিব দাবি করেন, ‘অনেক কারণ থাকতে পারে। তবে মোটাদাগে তিনটি কারণ উল্লেখ করা যেতেই পারে। এর প্রথমটি হচ্ছে—দেশে এখন ঊর্ধ্বগতির মূল্যস্ফীতি চলছে। এতে আয়ের তুলনায় ব্যয়ের পাল্লা বেশি হচ্ছে। ফলে মানুষ সময়ের বাস্তবতার কারণে সঞ্চয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে। তারা কোনোভাবে দিন পার করতে চাইছে। অনেকের হাতে হয়তো এর মাসিক নিয়মিত চাঁদা দেওয়ার মতো বাড়তি অর্থ হাতে থাকছে না কিংবা সেটি কন্টিনিউ করতে পারবে না—এমন সংশয় কাজ করছে। ফলে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তারা সর্বজনীন পেনশন স্কিমে ভিড়ছে না।’
তার মতে, দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে সর্বজনীন পেনশন স্কিম নিয়ে আসলে একটা রাজনীতিও ঢুকে গেছে। রাজনৈতিকভাবেও এটার বিরোধিতা করা হচ্ছে। তৃতীয় কারণটি হতে পারে—নানা কারণে ব্যাংকিং সিস্টেমের ওপর মানুষের একটা অনাস্থা তৈরি হওয়া। ফলে অনেকে সর্বজনীন পেনশন স্কিমকেও সেভাবেই দেখে থাকতে পারে, যা মানুষের আগ্রহ নষ্ট করছে।
কী উপায়ে এর গতিশীলতা বাড়ানো যায়—এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষে এখন শুধু সরকারি চাকরিজীবীরাই কাজ করছেন। আমি মনে করি, এটি শুধু চাকরিজীবী দিয়ে লক্ষ্য অর্জন হবে না। সেখানে সিভিল সোসাইটিকেও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সাধারণকে উদ্বুদ্ধ করার মতো ম্যাসিব কর্মসূচি থাকতে হবে। তাদের দ্বারপ্রান্তে যেতে হবে। আবার সাধারণের মানসিকতারও পরিবর্তন জরুরি। কারণ, সর্বজনীন পেনশন স্কিম সামাজিক নিরাপত্তামূলক একটি উত্তম কর্মসূচি। সরকারি সব কর্মসূচিতেই জনগণের কল্যাণ নিহিত থাকে। এক্ষেত্রে সরকার পরিবর্তন হলেও তার কল্যাণ প্রাপ্তির ধারাবাহিকতা বজায় থাকে। তাই সাধারণের অনাস্থা বা সংশয় আগে দূর হওয়াও জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
অবশ্য বেসরকারি আর্থিক গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর দাবি করেন, সর্বজনীন পেনশন যেভাবে শুরু করা হয়েছে, এভাবে চলতে থাকলে এটির কোনো ভবিষ্যত নেই। এ দিয়ে ফলপ্রসূ কিছু হবে না।
করণীয় বিষয়ে জানতে চাইলে কালবেলাকে তিনি বলেন, এটিকে পুরোপুরি নতুনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে। এখানে অনেক ফিচার যোগ করতে হবে। অনেক ধরনের প্রচারণা চালাতে হবে। একটি কক্ষে বসে সভা-সেমিনার করে সবাইকে আস্থায় আনা যাবে না। এর জন্য স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের সহায়তা প্রয়োজন হবে। এখন পর্যন্ত সে ধরনের উদ্যোগ দৃশ্যমান হচ্ছে না। মানুষকে সচেতনতা বাড়াতে হবে। তার জন্য কর্তৃপক্ষের প্রধান কার্যালয়টি আরও বড়সড় পরিসরে হওয়া দরকার। মাঠপর্যায়েও শাখা খুলতে হবে। এর জন্য প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দিতে হবে। এর পাশাপাশি কর্তৃপক্ষের সব উদ্যোগে সিভিল সোসাইটিকে যুক্ত করতে হবে। বিশেষ করে এখানে এমপ্লয়ার কন্ট্রিবিউশন জরুরি। চাকরিজীবীরা তখনই আসবেন, যখন তাদের এমপ্লয়ার কন্ট্রিবিউশনের সুযোগ তৈরি হবে। এক্ষেত্রে সর্বজনীন পেনশন স্কিমে বেসরকারি ব্যাংক-বীমা ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি করপোরেট হাউস ও বড় বড় প্রতিষ্ঠানকে ধাপে ধাপে অন্তর্ভুক্তি বাধ্যতামূলক করার দিকে যেতে হবে।
জানতে চাইলে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য মো. গোলাম মোস্তফা কালবেলাকে বলেন, ‘চীন, যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারতসহ বিশ্বের যেসব দেশ সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করেছে, তাদের কারোর যাত্রাই সুখকর ছিল না। সাফল্য পেতেও তাদের অনেকের ৩০ বছরের বেশি সময় লেগেছে। সবচেয়ে কম সময়ে সাফল্য পেয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া। তবু তাদের ১১ বছর লেগেছে। কিন্তু বাংলাদেশ সর্বজনীন পেনশন স্কিমে সাফল্য দক্ষিণ কোরিয়ার আগেই মিলবে।’
তিনি বলেন, ‘জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ এক্ষেত্রে যতটা সম্ভব করছে; কিন্তু এটা শুধু আমাদের একক তৎপরতায় হবে না। জেলা ও উপজেলা প্রশাসন থেকে ইউনিয়ন পরিষদ এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধেরও এই কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত করতে হবে। তাদের সবাইকে সম্পৃক্ত করে শিগগির মাঠপর্যায়ে গ্রামে গ্রামে পাড়া-মহল্লায় উঠোন বৈঠক করার পরিকল্পনা রয়েছে। সবাইকে নিয়ে এই তৎপরতা অব্যাহত রাখলে আমরা আগামী কয়েক বছরেই আশা করছি লক্ষ্যে পৌঁছাব।’