দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও দলীয়ভাবে অংশ না নেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। তবে বিগত আন্দোলন ব্যর্থতায় ঝিমিয়ে পড়া সংগঠন ও তৃণমূলকে চাঙ্গা করতে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এ ক্ষেত্রে কৌশলী ভূমিকা নিতে পারে দলটি। এর অংশ হিসেবে দলের কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে নমনীয়তা দেখানো হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সাংগঠনিক ব্যবস্থা না নিয়ে তার ব্যাপারে ‘বেখেয়াল’ হতে পারেন হাইকমান্ড, এড়িয়ে যেতে পারেন বিষয়টি। কেউ কেউ বলছেন, নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলেও এর মধ্য দিয়ে তাদের প্রতি এক ধরনের ‘মৌন সমর্থন’ থাকবে দলের। তবে উপজেলা নির্বাচন নিয়ে দলের এই অবস্থান আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করবে না বিএনপি। দলটি মনে করছে, জাতীয় নির্বাচন বর্জনের মাত্র চার মাসের মাথায় আওয়ামী লীগ সরকার ও বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে উপজেলার ভোটে যাওয়ার ঘোষণা দিলে দেশবাসীর কাছে বিএনপি সম্পর্কে ভুল বার্তা যেতে পারে। যদিও বিএনপি এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত দলীয়ভাবে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
এবার চার ধাপে ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদে ভোট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন, যার প্রথমটি হবে আগামী ৪ মে। ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে এ নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে অংশ না নেওয়ার কথা জানানো হয়েছে।
বিএনপির বর্জন ও আন্দোলনের মধ্যেই গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের মধ্য দিয়ে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। এমন অবস্থায় নির্বাচনের পর নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন। কারণ, একদফা দাবিতে বিএনপির বছরের অধিক সময় ধরে চলা রাজপথের আন্দোলনে চূড়ান্ত সফলতা না আসায় দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা বিরাজ করছে। একই সঙ্গে ঝিমিয়ে পড়েছে সারা দেশের সংগঠন। এমন অবস্থায় নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের সময় এসেছে বলে মনে করছেন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। সংগত কারণে আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে দুই ধরনের মত তৈরি হয়েছে বিএনপিতে।
দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির একপক্ষ মনে করছে, উপজেলা নির্বাচনে যাওয়ার কৌশল খোঁজা উচিত। তৃণমূলের এ অংশ মনে করে, নির্বাচনে গেলে বিএনপির রাজনীতিতে চাঙ্গাভাব ফিরে আসবে। নির্বাচনে যাওয়ার এই সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। এর মাধ্যমে বিএনপি স্বাভাবিক রাজনীতিতে ফিরতে পারবে। কারণ, আন্দোলন ব্যর্থতায় বিএনপির তৃণমূল এখন খুবই বিপর্যস্ত। এমন অবস্থায় শুধু সরকারবিরোধী কর্মসূচি দিয়ে তাদের মনোবল চাঙ্গা করা যাবে না। কারচুপি হলেও নির্বাচন সবসময় উৎসবের আবহ তৈরি করে। বিএনপি উপজেলা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হলে হাজার হাজার নেতাকর্মী সক্রিয় হওয়ার সুযোগ পাবেন। দলের অনেকে বিজয়ীও হবেন। তাদের দাবি, বিএনপি নির্বাচনমুখী দল হওয়ায় স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচনে অংশ না নিলে মাঠপর্যায়ে জনপ্রতিনিধিত্বশীল নেতাদের ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। সেক্ষেত্রে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে অনেকে নির্বাচন করতে পারেন। দলটির অন্য পক্ষের দাবি, বিএনপি ঘোষণা দিয়ে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিলে বিরোধীদের কাছ থেকে সরকারের ‘বৈধতা’ পাওয়ার বিষয়টি সামনে চলে আসবে। এতে মনে হতে পারে, বিএনপি সরকারকে মেনে নিয়েছে। এর সুযোগ নেবে সরকার।
এমন প্রেক্ষাপটে গত ২ মার্চ বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে বৈঠকে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার পক্ষে মতামত তুলে ধরেন যুগপৎ আন্দোলনের শরিক ১২ দলীয় জোটের এক নেতা। তিনি বলেন, একের পর এক নির্বাচন বর্জন করলে সংগঠন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জাতীয় নির্বাচনের পর আসন্ন উপজেলা নির্বাচনেও না গেলে তৃণমূলে নেতাকর্মীদের ধরে রাখা কঠিন হয়ে যাবে। তা ছাড়া আনুষ্ঠানিকভাবে ভোটে না গেলেও নেতাকর্মীরা স্থানীয় নানা কারণে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়তে পারেন। তাই উপজেলার ব্যাপারে ইতিবাচক চিন্তাভাবনা করা যেতে পারে। সূত্র মতে, এ সময় বৈঠকে উপস্থিত ১২ দলীয় জোটের অন্য নেতারাও তার বক্তব্যকে সমর্থন করেন। এ ছাড়া আন্দোলন ব্যর্থতায় সংগঠনকে চাঙ্গা করতে উপজেলা নির্বাচনে যেতে বিএনপির ওপর তৃণমূলের নেতাদেরও চাপ রয়েছে বলে জানা যায়।
জানা গেছে, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপির স্থায়ী কমিটির দু-একটি বৈঠকে এ বিষয়ে অল্পবিস্তর আলোচনা হলেও এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সর্বশেষ গত সোমবার অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকেও উপজেলা নির্বাচনের বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি।
উপজেলা নির্বাচন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী কালবেলাকে বলেন, বিএনপি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করবে না। যারাই দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন, তাদের বিরুদ্ধেই সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বিএনপি ২০২১ সাল থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে সব ধরনের নির্বাচন বর্জন করে আসছে। ওই বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভায় নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত হয়। জানা যায়, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন বর্জনের পর বিএনপি উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনের পরও স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোতে প্রথম দিকে অংশ নিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সরকারের ‘নগ্ন হস্তক্ষেপের’ অভিযোগে নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। এর ধারাবাহিকতায় সব সিটি করপোরেশন নির্বাচনও বর্জন করে।