কিছুতেই বিতর্কমুক্ত হতে পারছে না সরকারের মাঠ প্রশাসন। একের পর এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্ম দিয়েই চলেছেন মাঠ কর্মকর্তারা। সম্প্রতি শেরপুরের নকলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং লালমনিরহাট সদরে সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাংবাদিকদের সঙ্গে অসদাচরণ করে প্রশাসনকে প্রশ্নের মুখে ফেলেন। চাকরিতে যোগদানের পর নানা ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় কর্মকর্তাদের। তারপরও কেন তারা জনবান্ধব প্রশাসন গড়ে তুলতে পারছেন না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
কর্মকর্তারা জানান, ইউএনও পদে দায়িত্ব পাওয়া পর্যন্ত পাঁচ রকমের প্রশিক্ষণ পান একজন কর্মকর্তা। এসিল্যান্ড হওয়ার আগ পর্যন্ত নানা প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কর্মজীবনের প্রতিটি স্তরেই কর্মকর্তাদের জন্য নানা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। এসব প্রশিক্ষণের মূল উদ্দেশ্য হলো সুষ্ঠুভাবে সরকারি কাজ সম্পাদন এবং জনসেবা। কিন্তু এতসব প্রশিক্ষণেও কোনো কোনো কর্মকর্তার আচরণে পরিবর্তন আসছে না। বিশেষজ্ঞদের মতেÑ পারিবারিক মূল্যবোধের অভাব, পরিপক্বতার ঘাটতি এবং সেবাপ্রত্যাশীদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের অভাব থেকেই তারা বেপরোয়া আচরণ করেন।
বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সাবেক রেক্টর (সচিব) এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার কালবেলাকে বলেন, কর্মকর্তা এবং সাংবাদিকÑ দুপক্ষই এ দেশের গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। তারা উভয়ই মানুষের কল্যাণে কাজ করেন। কিন্তু জাতীয়ভাবে আমাদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও আস্থা নেই। আমরা একে অন্যকে প্রতিপক্ষ মনে করি। মনস্তাত্ত্বিকভাবে একে অন্যের প্রতি ঈর্ষান্বিত। তাই অনেক সময় আমরা ধৈর্যচ্যুত হই। সমঝোতা ও সহযোগিতার বদলে পরস্পরকে হেয় করে তৃপ্তি পায়; কিন্তু এমন মনোভাব জাতির জন্য কল্যাণকর নয়।
কর্মকর্তাদের জন্য প্রণীত প্রশিক্ষণের সিলেবাসে কোনো সংযোজন বা বিয়োজন প্রয়োজন আছে কি না এমন প্রশ্নে প্রশাসন বিশেষজ্ঞ আউয়াল মজুমদার বলেন, আসলে কারিকুলামের পরিবর্তন প্রয়োজন নেই। এটা ব্যক্তির দোষ। একেকজনের আচরণ,
মেজাজ-মর্জি একেক রকম হয়ে থাকে। প্রশিক্ষণ দিয়ে তা পুরোপুরি দূর করা সম্ভব নয়।
বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের একাধিক কর্মকর্তা এই প্রতিবেদকের সঙ্গে তাদের অভিজ্ঞতা বিনিময় করেছেন। তারা বলেন, এক সময় ১১-১২ বছর চাকরি করার পর ইউএনও করা হতো। এখন চাকরির ৫-৬ বছরের মাথায় কর্মকর্তারা ইউএনও হচ্ছেন। ফলে তাদের মধ্যে পরিপক্বতা ঘাটতি দেখা যায়। ডিসিদের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। এখন ১২ বছরের মাথায় ডিসি হচ্ছেন কর্মকর্তারা। অথচ এক যুগ আগেও
১৭-১৮ বছর চাকরি করার পর ডিসি পদে পদায়ন করা হতো। সুতরাং এ ক্ষেত্রেও পরিপক্বতার অভাব রয়েছে। উপসচিব পদে পদোন্নতির অন্তত ৩ বছর পর ডিসি পদে পদায়ন করা উচিত। তাহলে কর্মকর্তারা পদের মর্যাদাটা ধারণ করতে পারবেন।
কয়েকটি সমালোচিত কাণ্ড: গত ৫ মার্চ শেরপুরের নকলা উপজেলায় স্থানীয় সংবাদিক শফিউজ্জামান রানা ইউএনওর কাছে তথ্য অধিকার আইনে তথ্য চেয়ে আবেদন করার জেরে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে তাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেন সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. শিহাবুল আরিফ। জানা গেছে, একটি প্রকল্পের তথ্য চেয়ে সম্প্রতি ইউএনও কার্যালয়ে আবেদন করেন রানা। তথ্য চাওয়ায় তার ওপর ক্ষুব্ধ হন ইউএনও সাদিয়া উম্মুল বানিন। তিনি বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ৩৪তম ব্যাচের কর্মকর্তা। একপর্যায়ে নকলা থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে ইউএনওর সঙ্গে অসদাচরণের অভিযোগে রানাকে গ্রেপ্তার করে। পরে নকলা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. শিহাবুল আরিফ ওই কার্যালয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে রানাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেন। এ ঘটনা সারা দেশে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
এদিকে গত ১৪ মার্চ লালমনিরহাটে ভূমি অফিসে গিয়ে হেনস্তার শিকার হন স্থানীয় ৫ সাংবাদিক। তাদের তালাবদ্ধ করে রাখেন সহকারী কমিশনার (ভূমি) আব্দুল্লাহ আল নোমান। বিতর্কের মুখে তাকে বদলি করেন রংপুর বিভাগীয় কমিশনার। নকলা ও লালমনিরহাট ছাড়াও গত কয়েক বছরে বেশ কিছু বিতর্কিত ঘটনার জন্ম দেন মাঠ প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা। কেউ কেউ নারী কেলেঙ্কারির সঙ্গেও জড়িয়েছেন। সেবাপ্রত্যাশী সাধারণ মানুষের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করার ঘটনা ঘটছে অহরহ। তবে মাঠ পর্যায়ের কর্তাদের সবচেয়ে বেশি ঝামেলার ঘটনা ঘটছে স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে।
২০২২ সালের অক্টোবরে ‘ছাগলে ফুল খাওয়ার অপরাধে’ মালিককে দুই হাজার টাকা জরিমানা করে সমালোচনার জন্ম দেন বগুড়ার আদমদিঘী উপজেলার ইউএনও সীমা শারমীন। ছাগলে ফুল খাওয়ার দায়ে তার মালিককে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে সরকার ও প্রশাসনকে চরম লজ্জায় ফেলেন তিনি। একই বছর কুমিল্লার বুড়িচংয়ের ইউএনও সাবিনা ইয়াছমিনকে ‘আপা’ সম্বোধন করায় ক্ষেপে গিয়ে আপা না বলে ‘মা’ ডাকার পরামর্শ দেন। মানিকগঞ্জের সিংগাইরের ইউএনও রুনা লায়লাকে ‘স্যার’ না বলে ‘আপা’ ডাকায় পুলিশ দিয়ে ব্যবসায়ীকে পেটানোর ঘটনাও ঘটে। একের পর এক ঘটে যাওয়া এসব ঘটনায় সরকারের শীর্ষ প্রশাসন বিব্রত। অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের তাৎক্ষণিক বদলি করেই সমস্যার সমাধান খোঁজে প্রশাসন। কিন্তু স্থায়ী কোনো সমাধান আসছে না।
প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেন, সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে জনসেবা দিতে বিপুল অর্থ খরচ করে কর্মকর্তাদের দেশ-বিদেশে নানা প্রশিক্ষণ দেয় সরকার। কিন্তু এত প্রশিক্ষণের পরও জনবান্ধব আচরণ এবং সন্তোষজনক সেবা নিশ্চিত করতে পারছেন না তারা। বিশেষ করে নবীন কর্মকর্তাদের মধ্যেই ক্ষমতা দেখানোর প্রবণতা বেশি। চাকরিতে যোগ দিয়েই কেউ কেউ নিজেকে ‘রাজা’ ভাবতে শুরু করেন। আর সেবাপ্রত্যাশী সাধারণ জনগণকে মনে করেন ‘প্রজা’। অথচ সংবিধান অনুযায়ী তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। জনগণের সেবা করাই তাদের মূল কাজ।
যেসব প্রশিক্ষণ নেন কর্মকর্তারা : বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং বাংলাদেশ প্রশাসন সার্ভিস একাডেমির তথ্যানুযায়ী, কর্মকর্তারা কর্মজীবনের নানা স্তরে ১০ থেকে ১২ ধরনের প্রশিক্ষণ নেন। কেউ কেউ চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর স্কলারশিপে বিদেশ থেকে উচ্চতর ডিগ্রিও নেন। চাকরিতে যোগদানের পর কর্মকর্তাদের প্রথমেই বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ নিতে হয়। এতে সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনা, দাপ্তরিক বিষয়াদি ও জনগণকে সেবা দেওয়া সম্পর্কে শেখানো হয়। কিন্তু এ প্রশিক্ষণ সব কর্মকর্তা ধারণ করতে পারেন না। ফলে দপ্তর চালাতে গিয়ে সেবাপ্রত্যাশীদের সঙ্গে তাদের দূরত্ব তৈরি হচ্ছে।
বিসিএস জনপ্রশাসন ক্যাডারের নবনিযুক্ত কর্মকর্তাদের জন্য পাঁচ মাস মেয়াদি আইন ও প্রশাসনবিষয়ক মৌলিক কোর্সটি পরিচালনা করা হয়। এ কোর্সে ফৌজদারি আইন, জনপ্রশাসন, ব্যবস্থাপনা, অর্থনীতি, ইংরেজি ভাষা, তথ্যপ্রযুক্তি, আচরণগত বিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়গুলো সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দেওয়া হয়। স্বতন্ত্র ও দলগত অনুশীলন, বিশ্লেষণাত্মক পর্যালোচনা এবং প্রশ্নোত্তর পর্বের মাধ্যমে পাঠ্য বিষয়ে নিবিড় তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে প্রশিক্ষণার্থীদের জ্ঞান অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালনের প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়। বেসামরিক চাকরির আচরণবিধি, আদর্শ ও মূল্যবোধ সম্পর্কেও প্রশিক্ষণার্থীদের প্রয়োজনীয় ধারণা দেওয়া হয়।
সিনিয়র সহকারী সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাÑযারা ইউএনও হিসেবে নিযুক্তির জন্য যোগ্যতার তালিকাভুক্ত হন, তাদের জন্য দুই সপ্তাহ ধরে ইউএনও ফিটলিস্টের ওরিয়েন্টেশন কোর্স করানো হয়। এ কোর্সে প্রশিক্ষণার্থীরা যেন অধিকতর যোগ্যতা ও আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে উপজেলা প্রশাসন পরিচালনা করতে পারে, সে শিক্ষা দেওয়া হয়। এ ছাড়া ইউএনওদের জন্যও উপজেলা প্রশাসন ও উন্নয়নবিষয়ক কোর্সের আয়োজন করা হয়। এই কোর্সটিও দুই সপ্তাহ মেয়াদি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধিই এ কোর্সের অন্যতম উদ্দেশ্য। এ ছাড়া আরও বেশ কয়েক ধরনের প্রশিক্ষণ নেন কর্মকর্তারা। তবু মানুষের প্রতি, দেশের প্রতি কারও কারও দায়বদ্ধতার ঘাটতি দেখা যায়। এ কারণে বিতর্কমুক্ত হতে পারছে না প্রশাসন।