সংসদ বাতিল করে নতুন নির্বাচনের দাবিতে ঈদুল ফিতরের পর রাজপথের কর্মসূচিতে সক্রিয় হবে বিএনপি। যুগপতের শরিকদের সঙ্গে আলোচনা করে এর আগেই চূড়ান্ত করা হবে নতুন কর্মসূচি। এর পাশাপাশি জাতীয় কাউন্সিল আয়োজনের লক্ষ্য নিয়ে সাংগঠনিক পুনর্গঠন কার্যক্রমও জোরদার করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
আগামী দিনের আন্দোলন প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান কালবেলাকে বলেন, ‘বিএনপির আন্দোলনের মূল লক্ষ্য এ দেশের ভোটবঞ্চিত জনগণের ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে দেশে একদলীয় শাসনের পরিবর্তে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা। সেই লক্ষ্য থেকে বিএনপি বিন্দুমাত্র পিছপা হয়নি। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের যে আন্দোলন চলছে, সেটি অব্যাহত থাকবে। বিএনপি রাজপথে থাকা সব বিরোধী দলকে সঙ্গে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাবে।’
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে এক বছরেও বেশি সময় ধরে আন্দোলন চালিয়েছে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। তাদের দাবি উপেক্ষা করেই অনুষ্ঠিত হয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আন্দোলনকারী দলগুলো ওই নির্বাচন বর্জন করে। এতে নিরঙ্কুশ জয়ের মধ্য দিয়ে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। বিএনপির অভিযোগ, নির্বাচনের আগে তাদের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ ২৭ হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে কারাগারে রেখে জবরদস্তি করে ভোট করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তা সত্ত্বেও দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ‘একতরফা’ ও ‘আসন ভাগাভাগির’ ওই নির্বাচন বর্জন করেছে। এতে ক্ষমতাসীনদের নৈতিক পরাজয় হয়েছে বলেও বিএনপির মূল্যায়ন।
তবে রাজপথের দীর্ঘ আন্দোলনে সরকারের পতন না হওয়ায় প্রধান শরিক বিএনপিকে আন্দোলনের সফলতা-ব্যর্থতা মূল্যায়নের তাগিদ দেয় মিত্ররা। সেইসঙ্গে সংসদ বাতিল ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখারও সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি ও যুগপতের শরিকরা। তবে নির্বাচনের পর বিএনপির অগ্রাধিকার ছিল কারাবন্দি নেতাদের মুক্ত করা। তাই কৌশলের অংশ হিসেবে নেতাদের কারামুক্তির জটিলতা এড়াতে সরকারবিরোধী বড় কোনো কর্মসূচিতে যায়নি দলটি। গত তিন মাসে বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের বেশিরভাগ নেতা কারামুক্ত হয়েছেন। গত বছরের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ ঘিরে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনার জেরে দায়ের করা বিভিন্ন মামলায় আসামি হয়ে আত্মগোপনে থাকা নেতারাও ইতোমধ্যে জামিন পেয়ে দলীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছেন।
এ অবস্থায় সারা দেশে ঝিমিয়ে পড়া সংগঠন ও হতাশাগ্রস্ত নেতাকর্মীদের চাঙ্গা ও উজ্জীবিত করতে রমজানে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত ইফতার মাহফিল করার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। নেতাকর্মীদের ব্যাপক উপস্থিতির মধ্য দিয়ে দেশব্যাপী মহানগর, জেলা ও উপজেলা এবং ঢাকা মহানগরে ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত এসব ইফতার মাহফিল করছে দলটি। সেখানে দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সংগঠনের সদ্য কারামুক্ত নেতাদের ফুলের মালা পরিয়ে সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছে। নেতাকর্মীদের উৎসাহিত করতে অনেক ইফতার মাহফিলে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভার্চুয়ালি যোগ দিচ্ছেন। এ ছাড়া ঈদ সামনে রেখে এবারও বিভিন্ন সময়ে গুম-খুন ও পঙ্গুত্বের শিকার বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের সহস্রাধিক নেতাকর্মীর পরিবারে দলের পক্ষ থেকে সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। এসব কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে বিপর্যস্ত অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে বিএনপি।
এদিকে নির্বাচনের পর দলীয়ভাবে কিছু কর্মসূচি পালিত হলেও যুগপৎভাবে কোনো কর্মসূচি হয়নি। তবে মিত্রদের সঙ্গে বিএনপির নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। এই সময়ে বিএনপি সংসদ বাতিল, একদফা দাবি এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে দলীয়ভাবে কালো পতাকা মিছিল, লিফলেট বিতরণ ও গণসংযোগের মতো কর্মসূচি পালন করেছে। যুগপতের মিত্ররাও তাদের মতো করে একই ধরনের কর্মসূচি পালন করে।
জানা গেছে, বিএনপি এখন ঈদের পর সরকারবিরোধী আন্দোলনের কর্মসূচি ও কৌশল নিয়ে ভাবছে। সম্প্রতি স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ নিয়ে একদফা আলোচনা হয়েছে। তবে সিদ্ধান্ত হয়নি।
জানা গেছে, আন্দোলনের ধরন নিয়ে ঈদের পর যুগপতের মিত্রদের সঙ্গে বৈঠকে বসতে পারে বিএনপি। সেখানে নতুন কর্মসূচির বিষয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হবে। নির্বাচনের পরে গণতন্ত্র মঞ্চসহ শরিকদের সঙ্গে বিএনপির পৃথক বৈঠক হলেও কর্মসূচির বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সেখানে মূলত বিগত আন্দোলনের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা-বিশ্লেষণ হয়। গণতন্ত্র মঞ্চের পক্ষ থেকে ভবিষ্যতের স্বার্থে বিএনপিকে বিগত আন্দোলন সফল না হওয়ার একটি সঠিক ও যথাযথ মূল্যায়ন করার তাগিদ দেওয়া হয়।
মঞ্চের নেতারা মনে করেন, পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়নের ভিত্তিতে পরবর্তী করণীয় নির্ধারিত না হলে আগামীর আন্দোলনে সফলতা নিয়েও সংশয় থেকে যাবে। এ ছাড়া সরকারি চাপ ও প্রলোভন উপেক্ষা করে রাজপথে একদফার আন্দোলনে সক্রিয় থাকায় বিএনপির হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে শরিকদের ধন্যবাদ জানানো হয়।
এদিকে কারামুক্তির পর বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও বিগত আন্দোলনের সফলতা-ব্যর্থতার একটি পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়নের পরামর্শ দেন বলে জানা গেছে।
এদিকে রাজপথের কর্মসূচিতে সরকারের পতন না হওয়ায় নির্বাচনের পরপরই আন্দোলনের সাফল্য-ব্যর্থতার মূল্যায়ন শুরু করে বিএনপির হাইকমান্ড। সীমিত পরিসরের ওই মূল্যায়নে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গসংগঠনগুলো রাজপথে কার্যকর ও প্রত্যাশিত ভূমিকা না রাখায় সরকারবিরোধী আন্দোলনে চূড়ান্ত সাফল্য আসেনি বলে মনে করে দল। এমন মূল্যায়নের ভিত্তিতে অঙ্গসংগঠনের কমিটি ভেঙে দেওয়াসহ বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেই সিদ্ধান্তের আলোকে গত ১ মার্চ ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত করে নতুন আংশিক কমিটি গঠন করা হয়। একই সঙ্গে গঠন করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের আংশিক কমিটিও।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আগামীর আন্দোলন সামনে রেখে সংগঠন পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার মধ্যে জাতীয় কাউন্সিল নিয়েও ভাবছে বিএনপি। দীর্ঘ প্রায় আট বছরেও কাউন্সিল হয়নি দেশের অন্যতম বৃহৎ এই রাজনৈতিক দলটির। এমন প্রেক্ষাপটে কাউন্সিল করা উচিত বলে মত আসছে বিএনপিতে। এ নিয়ে স্থায়ী কমিটির মিটিংয়ে একাধিকবার আলোচনাও হয়েছে। সর্বশেষ গত ৪ মার্চ স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে কাউন্সিল নিয়ে আলোচনা হয়। তখন হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে বলা হয়, আরও আলোচনা করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
জানা গেছে, সারা দেশের নেতাকর্মীরা কারামুক্ত এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে আসায় চলতি বছরের শেষ দিকে বিএনপি তাদের সপ্তম জাতীয় কাউন্সিল করতে পারে। দলটির নেতারা বলছেন, কাউন্সিল করতে হলে জেলার মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিগুলো নতুন করে করতে হবে। অঙ্গসংগঠনগুলোও পুনর্গঠন করতে হবে। ঈদের পর পর্যায়ক্রমে এসব কাজ শুরু হতে পারে বলে জানা গেছে।