

ভোটের আগে ও পরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক থাকে। ভোটের দিনের শুরুর পরিস্থিতিও থাকে ভালো। এর ফাঁকেই ঘটে অঘটন। খোদ প্রার্থীর ওপরই ঘটে হামলার ঘটনা। হামলাকারীদের গলায় ব্যাজ থাকে সরকার সমর্থক প্রার্থীর। তবে হঠাৎ এই হামলার নেপথ্যে তৃতীয় পক্ষের ইন্ধনের গন্ধ পাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গত সোমবার ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচন চলাকালে রাজধানীর বনানীতে ভোটকেন্দ্র এলাকায় স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলমের ওপর হামলা হয়। এর আগে গত ১২ জুন বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে হামলার শিকার হন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মেয়র প্রার্থী সৈয়দ ফয়জুল করীম। হিরো আলমের ওপর হামলার ঘটনায় এ পর্যন্ত সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও বরিশালের ঘটনায় প্রায় দেড় মাসে গ্রেপ্তার হয়েছে মাত্র একজন। এদিকে হিরো আলমের ওপর হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। গতকাল মঙ্গলবার তিনি ডিএমপি কমিশনারকে ফোন করে এ নির্দেশনা দেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, হিরো আলমের ওপর হামলার ঘটনায় কাদের ইন্ধন ছিল, এর তদন্ত করা হচ্ছে। যারা দোষী তাদের সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গতকাল সচিবালয়ে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক গোয়াইন লুইসের সঙ্গে বৈঠকের পর মন্ত্রী সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, কারা, কী উদ্দেশ্যে হিরো আলমের ওপর হামলা করেছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পুলিশ কোনো
গাফিলতি করলে আমরা সেটাও দেখব। তিনি আরও বলেন, এ ঘটনা থেকে মেসেজ পাওয়া গেল যে, আমাদের আরও সতর্ক থাকতে হবে। পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা মনে করছেন, সামনে জাতীয় নির্বাচনের পরিবেশ ঘোলাটে করতে কেউ পরিকল্পিতভাবে এমন হামলা করতে পারে। এ ধরনের হামলায় সরকারের পাশাপাশি কেন্দ্রে দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও বিব্রত হতে হচ্ছে। হামলার সময় কেন্দ্রে বা নির্বাচনী দায়িত্ব পালনকারী পুলিশ সদস্যদের কারও গাফিলতি ছিল কি না, তাও যাচাই করা হচ্ছে। গতকাল এ নিয়ে বৈঠক করেছেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। দুটি হামলার ঘটনাতেই ছড়িয়ে পড়া ফুটেজে দেখা গেছে, নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর ব্যাজ ধারণ করে একদল যুবক হামলায় অংশ নেয়। তবে সরকারি দলের পক্ষ থেকে সব সময়ই এ ধরনের হামলায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করা হয়। প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে নৌকার ব্যাজধারী এই হামলাকারীরা কারা। নির্বাচনী পরিবেশ নষ্ট করতে তৃতীয় কোনো পক্ষ এ ধরনের হামলার নেপথ্যে কি না, সে গুঞ্জনও রয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। ভোট শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ আগে গতকাল বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্র এলাকায় হামলার শিকার হন হিরো আলম। ওই ঘটনার ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, একতারা প্রতীকের প্রার্থী হিরো আলমকে কেন্দ্রের বাইরের সড়কে ফেলে কিল-ঘুসি ও লাথি মারা হচ্ছে। তিনি রাস্তায় পড়ে গেলেও তাকে এলোপাতাড়ি মারধর করা হচ্ছিল। যারা এটা করছিলেন, তাদের প্রায় সবার গলায় ছিল আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর ব্যাজ। হিরো আলমের ওপর হামলাকারী কারা: হিরো আলমের ওপর হামলায় জড়িত সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তারা হলেন—সানোয়ার কাজী (২৮), বিপ্লব হোসেন (৩১), মাহমুদুল হাসান মেহেদী (২৭), মোজাহিদ খান (২৭), আশিক সরকার (২৪), হৃদয় শেখ (২৪) ও সোহেল মোল্লা। পুলিশ ওই সাতজনের ‘রাজনৈতিক পরিচয় না পেলেও’ স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, হামলাকারী সবাই ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মী। তাদের নানা কর্মসূচিতে দেখা গেলেও সংগঠনে কোনো পদ নেই। বনানী থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মিরাজুল মাহফুজ অবশ্য কালবেলার কাছে দাবি করেন, বনানী বিদ্যানিকেতন কেন্দ্রে ছাত্রলীগের কেউ ছিল না। যারা হামলায় অংশ নিয়েছে, তাদের তিনি চেনেনও না। তিনি বলেন, এই হামলাকারীরা বাইরের। তারা হয়তো সংগঠনের দুর্নাম করতে এ ধরনের কাজ করেছে। আমরাও চাই তাদের চিহ্নিত করে পুলিশ গ্রেপ্তার করুক। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গ্রেপ্তার সাতজনের মধ্যে ছানোয়ারের বাড়ি গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী, তিনি মহাখালী এলাকায় থাকেন। মুকসুদপুরের বিপ্লব থাকেন পল্লবীর বাউনিয়া বাঁধে। মুকসুদপুরের মেহেদীও থাকেন মহাখালী এলাকায়, গোপালগঞ্জ সদরের মোজাহিদ থাকেন তেজগাঁওয়ের নাখালপাড়ায়, কুমিল্লার হোমনা উপজেলার আশিক সরকার থাকেন বনানীর কড়াইলে, শরীয়তপুরের জাজিরার হৃদয় শেখও থাকেন কড়াইল এলাকায় এবং কাশিয়ানীর সোহেল মোল্লা থাকেন খিলক্ষেতের মধ্যপাড়া এলাকায়। স্থানীয় ও পুলিশ সূত্র জানায়, বিপ্লব এক সময় শ্রমিক লীগের রাজনীতি করতেন। হৃদয় ও সোহেল ছাত্রলীগের কর্মী। দুজনই বনানী থানা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি শেখ মেহেদীর অনুসারী। পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন: হিরো আলমের সমর্থকরা দাবি করেছেন, পুলিশ হিরো আলমকে কেন্দ্রের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার পর মূলত হামলার ঘটনাটি ঘটে। তারা জানান, সেখানে ভোটকেন্দ্র পরিদর্শনে গেলে নৌকা প্রতীকের কর্মী ও সমর্থকরা পেছন থেকে হিরো আলমকে গালাগাল করতে থাকেন এবং কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে চলে যেতে বলেন। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলে কেন্দ্রটির দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা হিরো আলমকে কর্ডন করে স্কুলের ফটকের দিকে নিয়ে যান। তখনই পিছু নেন হামলাকারীরা। স্কুল প্রাঙ্গণ থেকে বেরোনোর পরে হিরো আলমের পাশে পুলিশ সদস্যরা ছিলেন না। হামলাকারীরা তাকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে এলোপাতাড়ি মারধর করতে থাকেন। অবশ্য গতকাল মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, হিরো আলমের ওপর হামলা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। তিনি বলেন, গলায় ব্যাজ ধারণ করে যারা এ হামলা করেছে তাদের উদ্দেশ্য কী ছিল, নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেই হামলা কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। দলের ব্যাজ ধারণ করা লোকজনের মধ্যে তৃতীয় কোনো পক্ষ ছিল কি না, জানার চেষ্টা চলছে। পুলিশের ভূমিকার বিষয়ে তিনি বলেন, ৩ থেকে ৪ মিনিটের মধ্যে ঘটনাটি কেন্দ্রের বাইরে ঘটেছে। কিন্তু পুলিশ ভেতর থেকে বাইরে যেতে পারবে না, কারণ ব্যালট বাক্স রয়েছে। যারা গোয়েন্দা হিসেবে বাইরে ছিলেন, তারা দ্রুত সেখানে হাজির হয়েছেন। আমাদের মধ্য থেকে একজন আহত হয়েছেন। হামলাকারীরা যে দলেরই হোক, কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ ঘটনায় পুলিশের গাফিলতি থাকলে সেটাও আমরা দেখব। হামলার ঘটনায় মামলা, রিমান্ডে দুজন: এদিকে হিরো আলমের ওপর হামলার ঘটনায় গতকাল বনানী থানায় অজ্ঞাতপরিচয় ১৫ থেকে ২০ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ওই প্রার্থীর ব্যক্তিগত সহকারী সুজন রহমান শুভ বাদী হয়ে ওই মামলা করেন। এতে অভিযোগ করা হয়, হিরো আলমকে শ্বাসরোধে হত্যার উদ্দেশ্যে এক আসামি তার কলার চেপে ধরে এবং অন্য একজন তলপেটে লাথি মারে। তখন হিরো আলম রাস্তায় পড়ে গেলে অন্য আসামিরা কিল-ঘুসি ও লাথি মেরে তাকে আহত করে। বনানী থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ওই মামলায় সাতজনকে গ্রেপ্তার করে আদালতে নেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে ছানোয়ার ও বিপ্লব নামে দুই আসামিকে তিন দিন করে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। অন্য ৫ আসামিকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত।
মন্তব্য করুন